১১ জুলাই। এক বছর আগে এই দিনে তীব্র স্লোগান, নিঃশ্বাস আটকে রাখা উত্তেজনা, আর রক্তমাখা রাজপথে ইতিহাসের ঘূর্ণিঝড় বয়ে গিয়েছিল। সেই আন্দোলন ছিল এক জাতির ক্রন্দনের বিস্ফোরণ, যে জাতি তার কণ্ঠের স্বাধীনতা, মত প্রকাশের অধিকার, এবং মর্যাদার ন্যূনতম নিশ্চয়তা চাইতে রাস্তায় নেমেছিল। একবছর পর, আমরা দাঁড়িয়ে আছি সেই বিপ্লবের বার্ষিকীতে—কিন্তু চারপাশে যা ঘটছে, তাতে যেন স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি বুনো আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে।
এই একটি দিনে, মাত্র চব্বিশ ঘণ্টার ভেতর, দেশের তিন কোণে তিনটি রক্তাক্ত দৃশ্য আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে পরিবর্তন শুধু কাঠামোর নয়, মননেরও প্রয়োজন।
চাঁদপুরে, এক মসজিদে খুতবা শুনে একজন মুসল্লি রাগে উন্মত্ত হয়ে খতিব আ.ন.ম. নুরুল রহমান মাদানীর উপর চাপাতি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ধর্ম, যা সহনশীলতার পরম পাঠশালা, সেখানে এখন ভিন্নমত মানেই মৃত্যুদণ্ড? কে তৈরি করছে এই জিহাদি মানসিকতা, কে উসকে দিচ্ছে এই সহিংসতা?
একই সময়ে, খুলনার রাস্তায় পড়ে থাকে এক যুবদল নেতার নিথর দেহ—গুলি ও রগ কাটার রোমহর্ষক কাহিনী। অপরাধের কারণ? ক্ষমতার দ্বন্দ্ব? রাজনৈতিক বিভাজন? নাকি নিছক প্রতিহিংসা? উপদেষ্টাদের ভাষণে যখন বলা হয় “নতুন বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার স্থান নেই”, তখন এই ধরনের হত্যাকাণ্ড যেন ব্যঙ্গচিত্র হয়ে দাঁড়ায়।
আর রাজধানীর বুকে, ইতিহাসের গন্ধমাখা পুরান ঢাকায়, মিটফোর্ড হাসপাতাল চত্বরে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয় এক ভাঙ্গারি ব্যবসায়ীকে—চাঁদা না দেওয়ার “অপরাধে”! অভিযুক্ত? একটি জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বিএনপির একদল নেতাকর্মী । জনসমক্ষে পাথর দিয়ে থেঁতলে দেওয়া—এ যেন রাষ্ট্রীয় আশ্বাসের কফিনে শেষ পেরেক।
এক বছর আগেও মানুষ বলেছিল, “এইবার বদল আনব। এইবার সত্যি মুক্তি আসবে।” তখনকার স্বৈরতন্ত্র বিদায় নেয় ঠিকই, কিন্তু শেকড়ের বদল হয়নি। পুরোনো ধ্বংসস্তূপের উপর গড়ে উঠেছে নতুন ধ্বংসযজ্ঞের ঘরবাড়ি।
রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ এখনো চলমান। সড়কে সাঁজোয়া গাড়ি, অফিসে নজরদারির ক্যামেরা, সংবাদপত্রে বারবার “নিরাপত্তা” শব্দের আবৃত্তি—এসবই এক নিরাপত্তার চাদরে মোড়ানো প্রিয় স্বদেশের চেহারা। কিন্তু সেই চাদরের নিচে কি নিরাপদ মানুষ? নাকি প্রতিটি নাগরিক একেকটি শঙ্কার প্রতিমা?
স্বপ্ন ছিল মানবিকতা, বিচার ও সমতার। বাস্তবতা দাঁড়িয়ে আছে চাপাতি, গুলি, পাথর আর রক্তের ভেতর।
বছর ঘুরল। আমরা একটুখানি প্রশ্ন তুলতেই পারি— এই কি তবে অভ্যুত্থানের প্রতিদান? এই কি ‘নতুন বাংলাদেশ’?
✍️ কলাম: রুদ্রনীল
লেখক,সংগঠক ও সাংস্কৃতিক কর্মী
Leave a Reply