#রুদ্র_নীল
লেখক, কলামিস্ট ও সংগঠক
“নিঃশঙ্ক চিত্তের চেয়ে জীবনে আর বড় কোনো সম্পদ নেই”—এই একটি বাক্যেই কর্ণেল আবু তাহের নিজেকে সংজ্ঞায়িত করে গেছেন। কর্ণেল তাহেরের জীবনের সংগ্রামের ইতিহাস পড়ছিলাম। তিনি ছিলেন এক অকুতোভয়ী সৈনিক। মুক্তিযুদ্ধের বীর, ১১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক, একজন যুদ্ধাহত বিপ্লবী সেনা কর্মকর্তা, যিনি লড়াই করেছিলেন কেবল পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে নয়, বরং স্বাধীন বাংলাদেশের ভেতরের নতুন শোষক ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধেও। কিন্তু যে রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্নে তিনি জীবন বাজি রেখেছিলেন, সেই রাষ্ট্রই তাকে এক সকালে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়। এই মৃত্যু ছিল শুধু একজন মানুষের হত্যা নয়—এটি ছিল এক বিপ্লবী চিন্তার ফাঁসি। ২১ জুলাই তাই কেবল তাহেরের “মৃত্যুদিবস” নয়, এটি গণআকাঙ্ক্ষা ও সমাজতান্ত্রিক ভবিষ্যতের সম্ভাবনার ধ্বংসের দিনও।
তাহেরের নাম শুনলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে স্বাধীনতা যুদ্ধের এক সাহসী যোদ্ধার মুখ। তিনি শুধু সামরিক নেতৃত্বই দেননি, দিয়েছেন আদর্শের প্রেরণাও। তিনি বিশ্বাস করতেন, রাজনৈতিক স্বাধীনতা যতদিন না অর্থনৈতিক মুক্তির দ্বার উন্মুক্ত করে, ততদিন তা পূর্ণ স্বাধীনতা নয়। সেই বিশ্বাস থেকেই ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর তিনি নেতৃত্ব দেন ‘সিপাহি-জনতার বিপ্লব’-এ। তৎকালীন রাজনৈতিক শূন্যতার মধ্যে তিনি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে পারতেন, যদি চাইতেন। কিন্তু কর্ণেল তাহের ক্ষমতালিপ্সু নন, বরং এক গণক্ষমতার স্বপ্নদ্রষ্টা। তাই তিনি রাষ্ট্রক্ষমতা সেনাদের হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন: “Zia, free all political prisoners and take charge.”
৭ নভেম্বর নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক বহু পুরনো। একপক্ষ একে জিয়ার মুক্তি দিবস হিসেবে দেখে, অন্যপক্ষ শ্রমিক-কৃষক-সৈনিকের ঐক্যের বিপ্লব বলে গণ্য করে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—যে মানুষটি এই অভ্যুত্থান সংঘটিত করেছিলেন, সেই কর্ণেল তাহেরকে কয়েক মাস পরই রাষ্ট্রের ‘শত্রু’ ঘোষণা করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এই বিচারের নাম ছিল সামরিক ট্রাইব্যুনাল। বিচার হয়েছিল গোপনে, মাত্র চারদিনে। রাষ্ট্রপতি জিয়ার অনুমোদন, মধ্যরাতে কারাগারে ফাঁসি, আর ভোরে নিঃশব্দে দাফন। ২০১১ সালে হাইকোর্ট এই বিচারকে “প্রহসন”, “অবৈধ”, ও “ঠাণ্ডা মাথার হত্যাকাণ্ড” বলে রায় দেয়। তাহলে প্রশ্ন জাগে—৭ নভেম্বর কার বিজয় ছিল?
তাহের চেয়েছিলেন একটি শোষণমুক্ত, সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ। যেখানে সেনাবাহিনী হবে গণবাহিনী, অর্থনীতি হবে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রিত, ক্ষমতা হবে জনগণের। অন্যদিকে জিয়া রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিলেন যুক্তরাষ্ট্রঘেঁষা পুঁজিবাদী মডেল, বিশ্বব্যাংক নির্ভর উন্নয়ন ও ধারাবাহিক সামরিক কর্তৃত্বের পথে। তাহের ছিলেন বিপ্লবের কাণ্ডারি, আর জিয়া সেই বিপ্লবকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে নিজেকে রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন।
কর্ণেল তাহের হত্যার চার দশকের বেশি কেটে গেছে। কিন্তু আজও বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, সামরিক শাসনের অবশিষ্ট সংস্কৃতি ও মতপ্রকাশের দমন বিদ্যমান। কর্ণেল তাহেরের মতো মানুষরা প্রশ্ন করতেন—“ক্ষমতার উৎস কি সত্যিই জনগণ?” আজকের বাংলাদেশেও এই প্রশ্নটি অনুরণিত হওয়া প্রয়োজন। কর্ণেল তাহেরের স্বপ্ন ছিল—একটি এমন সমাজ, যেখানে মুক্তিযোদ্ধা শুধু রাষ্ট্রীয় সনদ নয়, সম্মান ও নিরাপত্তা পায়। যেখানে সেনা অফিসার হোন বা সাধারণ সিপাহী—সকলেই মানুষের মর্যাদা নিয়ে বাঁচে।
কর্ণেল তাহের আমাদের সামনে রেখে গেছেন কেবল একটি মৃত্যুকথা নয়, বরং একটি বিকল্প রাষ্ট্রচিন্তার দিগদর্শন। তাঁর মৃত্যু ছিল রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়াশীল বলয়ের হাতে এক বিপ্লবী শক্তির কন্ঠরোধ। আজকের প্রজন্মের কাছে কর্ণেল তাহেরকে জানতে হবে, পড়তে হবে এবং বুঝতে হবে—যে তিনি ছিলেন সময়ের চেয়ে বড় এক যোদ্ধা। তাহের শুধু অতীতের স্মৃতি নন—তিনি ভবিষ্যতের প্রশ্ন। ছিয়াত্তরের ক্ষুদিরাম, কর্ণেল তাহের— আজ তোমার মৃত্যু দিবসে তোমায় লাল সালাম।
Leave a Reply