…………………..
(পর্ব -০১)
সব কথা বলতে পারো, শেষ কথাটি
কেনো পারোনা বলতে?
এমোন কি রহস্য লুকানো তোমার বুকের গোপন পুকুরে;
এমোন কি-ই বা আছে সেখানে
ব্যথার সরোবরে নীল বিষ?
প্রশ্ন করলেই তুমি সচকিয়ে ওঠো শিহরিয়ে
করো না কোন উত্তর?
বন্ধু আমার আজন্মের সাথী তুমি জীবন-মরণের
জন্ম সূত্রে পেয়েছি অধিকার তোমাকে ভালোবাসিবার
দিবসে আকন্ঠ করি পান তোমার রূপ-যৌবন
নিশিতে মন্হন করে চর্বিতচর্বনের মতো
তা আবার করি চয়ন।
বইয়ের পাতার মতো যখন মেলে ধরি সামনে
তোমার অতীত, পেয়ে যাই হাজারো উপাখ্যান
কত বৈচিত্রের; যা প্রেমের-বিরহের-ভালোবাসার
আঘাতের-রক্তপাতের-বিদ্রোহের
কখনো বা উপচে ওঠা ব্যথা-কান্নার।
তোমাকে দেখেছি শত রূপে, তুমি অপরূপা,
তুমি রবীঠাকুরের অমর স্মৃতি – সোনার তরী-চিত্রা,
তুমি মহুয়া- মলুয়া- বেহুলা- চন্দ্রাবতীর
প্রেমিক হারা প্রিয়ার উদাস চাওয়া — বিরহীনির বিরহ;
তুমি জীবনানন্দের নিবিড় ভালোবাসা —
বনলতা সেন – রূপসী বাংলা।
ইউরোপ-আরব-পর্ত্তুগীজ-মারাঠা-বর্গী-বৃটিশ আর
পাকিস্হানীদের হাতে আঘাত খাওয়া —
তুমি শরবিদ্ধ আহত পাখি ;
তুমি বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনে শহীদের রক্তে
আপ্লুত রাজপথ — ফেব্রুয়ারীর রক্তাক্ত একুশ।
তুমি ঊনসত্তর-সত্তরের বিজয় উল্লাসের মরণ পন
সুকান্ত-নজরুলের মতো গর্জে ওঠা লক্ষ-কোটি মায়ের
দামাল ছেলের বিশ্ব কাঁপানো সশস্ত্র বিদ্রোহ;
তুমি একাত্তরের করুণ ইতিহাস, –ছাইয়ের
ভস্মাস্তুপে পাওয়া মানুষের আধাপোড়া বিকৃত লাশ;
ত্রিশ লক্ষ প্রাণের রক্তাস্নাতা রক্তগঙ্গা,
কত হাজারো বোনের ইজ্জত হারানো
তুমি নিদারুণ ব্যথা
তুমি স্বামীহারা বিধবা পুত্রহারা মায়ের
আকুল আহাজারী,– গুমড়ে ওঠা শোক কান্না।
সেই তুমি, আমার সাধনার ধন — পরম পাওয়া।
হে আমার তৃষিত প্রেমের অতৃপ্ত সুধা — অপ্সরী,
সমস্ত দেহ জুড়ে বসিয়েছো রূপের মেলা
ললাটে লাল টুকটুকে সিঁদুরের টিপ পরে
সজ্জিত হয়েছো মনোরম সাজে — বধুর মতন,
সুডৌল অঙ্গে তোমার লুটোপুটি খায় মায়াবী হাসি
যেন অনাবিল প্রেমের বাজার,
সেখানে আমি এক স্বপ্নাবিষ্ট পর্যটক —
রূপের খরিদ্দার।
এত প্রেমোসম্ভার সঞ্চিত রেখেছো তোমার অঙ্গরাগে
বিমুগ্ধ চেতনে কেবলই আমায় করছো অচেতন
বিপুল বিস্ময়ে, ভুলায়ে ভুলায়ে ক্রমেই নিয়ে চলছো
নিরুদ্দেশে তোমার আত্মার একান্ত সন্নিকটে, সেখানে
সর্পিল পথ এঁকে-বেঁকে চলে গেছে দূর দূরান্তে
ছায়াচ্ছন্ন বন-বনানীর কোল ঘেঁষে শ্যামলীমা ঘেরা
কোন স্বপ্নপুরী গ্রামে। সেখানে মিশে আছে
বাউলের দোতারার সুর
বিহঙ্গের কলকাকলি
গরুর গাড়ীর গোঁঙানি
আলাপচারী পথিকের কথার জের,
ছাতার আড়ালে সন্তর্পণে লুকিয়ে যাওয়া
কৃষাণ বধুর কাঁকনের নিক্কন,
গৃহস্হবাড়ী থেকে ভেসে আসা কর্মচঞ্চল মানুষের
কোলাহল, ঢেঁকিতে ধানভানার একটানা আওয়াজ,
হঠাৎ চমকে ওঠা হাঁস-মোরগের কলহ
গোয়ালে বাঁধা ছোট্র বাছুরটির হাম্ভা হাম্ভা রব।
কোথাও অসীম আকাশ তলে সবুজের বুকে
কার্পেট বিছানো মুক্ত মাঠ, যেন একটি
প্রশস্ত জায়নামাজ ভোরের সূর্যালোকে
রজত কনিকার কারুকার্য, শিশুর মুখের প্রাণবন্ত হাসি।
তোমার যৌবন মদিরার লোভনিয় ঘ্রাণে আকুল ভোমরা
ফুলে ফুলে আসে প্রজন্মের উল্লাসে।
তেপান্তর তেপান্তরে মুক্তা ছড়ানো শস্য খেতে
যেন নূপুর পরা নর্তকী নাচে মধ্যাহ্ন বাতাসে,
রাখাল বাজায় বেণু একান্ত নির্জনে, সেই বীণের
মোহন সুরে উদ্বেলিয়ে ওঠো তুমি দুলে ঊর্মির তরঙ্গে।
অনর্গল নিসৃত হচ্ছে দুগ্ধ তোমার সতেজ স্তন থেকে
ঝর্ণা হয়ে দুর্বার বেগে নামছে চর্তুদিকে।
যেখানে ইটের স্তরে স্তরে একের পর এক গড়ে উঠেছে
আকাশ ছোঁয়া দালান বিশাল নগর, সেখানে সন্ধ্যানামে
যানবাহনের হর্ণে, ভোর হয় কারখানার
ভেঁপুর সাইরেণে, সবাই ব্যস্ত থাকে – সবাই
কর্মমুখর সেখানে।
হায় প্রেয়সী, এতই সৌন্দর্যের অধিকারিনী তুমি,
রূপের ঝলকে ঝলকে আমায় করছো দিশাহারা কেবলই
টিকটিকির ক্ষীণ লেজের মতো বাঁশ ঝাড়ের
লিকলিকে মাথাগুলো ডাকে যেমন ইশারায়
তেমনি তোমার দেহের সমস্ত সৌন্দর্য ডাকে আমায়
অব্যক্ত আহ্বানে, মিশে যেতে
একে অন্যের গহীন সত্তায়!
প্রদীপ জ্বালা নিশীথের এই নিভৃত স্হানে বাসর জাগা
লক্ষ-কোটি তারার ভীড়ে বসেছি দু’জনে মুখো মুখি
প্রেমের টানে, আমি বলছি তুমি শুনছো
উদাসীনের মতো ভাব গম্ভীর হয়ে।
(পর্ব-০২)
আজও বুঝতে পারিনি তুমি যে কি চাও
এ তোমার কেমন প্রেম বুঝিনা কিছুই
এক অঙ্গে ধরো শত রূপ,– কখনো মাতৃরূপে আসো
আমার নিদ্রিত ললাটে বুলিয়ে যাও হাত,
টেনে দাও দেহে উষ্ণ লেপ ;
আধোঘুম থেকে ডেকে উঠি আমি — মা
তৃষিত মুখে স্বস্নেহে তুলে ধরো স্তন,
শ্রদ্ধায় নত করি শির।
কখনো ভগ্নি হয়ে আসো সামনে, কথায় কথায় শাসাও
দাও হিতপোদেশ, সুখে দুঃখে টেনে নাও কাছে
ভ্রাতৃস্নেহে করো আদর সোহাগ। কখনো ভাবির মতো
করো ঠাট্রা-চতুরী, কনিষ্ঠ দেবর হয়ে আমি
তোমার হৃদয়ের কূলে কূলে খুঁজতে থাকি
ভালোবাসা-প্রেম। কখনো প্রিয়া হয়ে
গভীর নিশিতে চুপিসারে আসো অভিসারে,
ঠোঁটে ঠোঁট রেখে করো চুম্বন, তোমার উরুতে
আমার মাথা রেখে চুলের মধ্যে করো মৃদু মৃদু
আঙ্গুল সঞ্চালন, জুড়ে দাও রাজ্যের আলাপ সব।
কখনো খলখলিয়ে হেসে ওঠো
কখনো মৌন হয়ে চেয়ে থাকো অনিমেষ
কখনো দেখি আবার বধু হয়ে ঘরে এসে
করছো দিব্বি ঘর-সংসার আদর্শ গৃহীনির মতো,
নিপূণ হাতে গুঁছিয়ে নাও সব জামেলা আমার,
সবুজরঙ্গা শাড়ি পরে কপালে লাল টুকটুকে টিপ আর
সুগন্ধি প্রসাধুনিতে সেজে গুজে যখন এসে দাঁড়াও
সামনে, তখন তোমাকে বড় সুন্দর মানায়
প্রাণ ভরে আমি শুধু দেখি আর দেখি, কখন যে দু’জনার
মধ্যে হয়ে যায় চুম্বনের লেন দেন টেরও পাই না।
আমি বুঝতেই পারিনা তুমি যে কী চাও
এ তোমার কেমন প্রেম কিছুই বুঝি না!
আমি কি তা’হলে তোমার মাতৃভক্ত বায়োজিদ?
আমি কি আরেক বৃন্দাবনের কোন নয়া কৃষ্ণ?
তুমি রাধীকা, আমি কি তোমার কানাই-গোবিন্দ?
তুমি জুলেখা, আমি কি তোমার ইউছুব?
আমি ফরহাদ, তুমি কি আমার প্রাণের প্রাণ শিরী?
যদি না-ই হও, তবে কিসের আসায়-কিসের লোভে
এত ভাবে, এত রূপে, এত ছলায়-কলায়
তোমার গহীন সত্তার সাথে একান্ত ভাবে
আমাকে জড়াতে চাও?
হে তিলোত্তমা, হে মহীয়সী হৃদয়ের অধীশ্বরী রাণী,
হে আদরণী, হে ধাত্রী, হে জননী;
তুমি মাতা, তুমি ভগ্নি,
তুমি প্রিয়া, তুমি বধু, তুমি ভাবি,
তুমি চিরঞ্জীব উর্বশী, তুমি দেবী।
কখনো তুমি হয়ে ওঠো দারুণ স্বেচ্ছাচারী
বড় অভিমানী, রাগ-অনুরাগে ভেতরে ভেতরে
প্রচন্ড খরায় আপনাকে করো ছাই।
কি সে তোমার এত অনুরাগ কিছুই করোনা প্রকাশ
ব্যথাহত প্রাণে আমিও চেয়ে থাকি
তোমার ম্লান মুখ পানে,
যেমন চেয়ে থাকে হাটুর উপর থুথনী রেখে বিষন্ন কৃষক
বৈশাখের খর তাপে পুড়ে যাওয়া
অথবা অকাল বর্ষায় ডুবে যাওয়া
বিনষ্ট ফসলী জমির দিকে।
কখনো আকুল কান্নায় ভাসিয়ে দাও বুক, উপচে ওঠা
হৃদয়ের নিসৃত ব্যথার ঢলে ডুবিয়ে দাও সব, সেই
প্লাবনের জলে আপন মনে করে নাও স্নান,
জানি না — কেন এমন হয়ে পড়ো বছর বছর।
কিসে এত জ্বালা তোমার? কেঁদে কেঁদে
কেন হও একাকার! না কি
এ কান্না কাঁদছো তুমি তোমার অবাধ্য সন্তানদের
বিপথে যাওয়ার দুঃখ-তাপে?
যারা টেরা চোখে তোমাকে বিদ্রুপ হানে
নিশিদিন যারা মেতে থাকে হানাহানি লুটতরাজে?
যারা কেড়ে নেয় তোমার দুর্বল সন্তানদের
কষ্টে যোগাড় করা এক বেলার কাঙ্খিত ডাল-ভাত?
বলো বন্ধু —
মানুষরূপী সেই নিষ্ঠুর পশুদের আচরণেই কী
তোমার এতো ব্যথা, এতো কান্না?
কখনো ফণী মনসার ধরো ফণা
তর্জণ-গর্জণে করতে থাকো ফোঁস-ফাঁস,
এ কী জালিমের প্রতি তোমার বিদ্রোহ প্রকাশ?
জারিকৃত কঠোর ফরমান?
অন্তর নিংড়ানো দীর্ঘশ্বাস —
এ কী অসহায় মজলুম আর ক্ষুধিতদের জন্যে
তোমার সমবেদনা?
জলোচ্ছাস, —
সে কী অত্যাচারীর উপর হঠাৎ নিক্ষেপ করা
তোমার ঘৃণার থু থু?
অকস্বাৎ কেঁপে উঠে তোমার হৃদপিন্ড,
কাঁপে সমস্ত শরীর থর থর!
এ কী তোমার ভয়?
তাড়া করছে কী তোমায় কোন স্বপ্ন দানব?
রাবন হয়ে সে কী চুরি করতে চায় সীতা?
বলছো না কিছুই
দিচ্ছো না কোন উত্তর।
(পর্ব – ০৩)
প্রিয়ে, রাত হয়েছে গভীর, পূবের তারা হেলেছে পশ্চিমে
গোবরে পোকারা এতক্ষণে পড়েছে ঘুমিয়ে
গৃহে গৃহের প্রদীপগুলো নিভে গেছে অনেক আগে,
স্বামী-স্ত্রীদের বিছানার কথোকপথন
হয় তো হয়েছে সমাপ্ত, কোথাও নেই জন-মানবের
সাড়া শব্দ, নিদ্রাদেবীর কোলে ঢুলে
সকলেই হয়েছে অচেতন; শুধু নির্ঘুম চোখে
এখনো বসে আছি আমরা দু’জন।
তবু ফুরায়না কথা
মিঠেনা স্বাদ দেখার।
আর কত প্রিয়তমা থাকবে চেয়ে মুখ পানে আমার?
বলো এবার বলো, —
এই ভালোবাসার কোথায় হবে শেষ,
কোথায় গিয়ে পাবো দু-জনে মিলনের সূর্যোদয়ের দেশ?
তবে কী সময় স্রোতের মতো শেষ কথাটির
নেই কোন শেষ?
জানতে আমার বড়ই সাধ প্রিয়ে, বলো না একটি বার —
তখনো কী টিকে থাকবে ভালোবাসা আমাদের
আজ থেকে হাজার কিংবা লক্ষ বছর পরে
তখনো কী তোমার থাকবে অটুট যৌবন
না কী তুমি বৃদ্ধা হয়ে যাবে?
আমি তো থাকবো না, তুমি কী সেই দিনও এমনি ভাবে
থাকবে ধ্যানে রত প্রেমিকের সামনে?
মাটি হয়ে যাওয়া আমার অস্হি-মজ্জা সেদিন কী
তোমার এই মৌন ধ্যান টের পাবে?
না জানি তুমি তখন কেমন থাকবে, হয়তো বা
সেদিন কেউ ভিন গ্রহে বসে তোমাকে ভাববে
আমারই মতো, কেউ চন্দ্রের উপত্যকা হেঁটে
আবার আসবে তোমার কাছে, কেউ বা
প্রজাপতির ন্যায় উড়ে বেড়াবে তোমার বুক থেকে
এ গ্রহে ও গ্রহে। না কী এরই আগে
তোমাকে ছিনিয়ে নিবে কোন দুর্মদ জলদস্যু
সতিত্ব করতে হরণ?
এই মুখশ্রী, এই গঠন-গাঠন, এই অবয়ব
সবই কী ঠিক থাকবে এমোন? না কী
ভূমিকম্পের প্রচন্ড আঘাতে কোন একদিন
তুমিও হয়ে যাবে শোকার্ত আর্মেনিয়ার মতো
ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত? না কী
আগ্নেয়গিরির উদগিরণে হরপ্পা আর
ময়েঞ্জোদাড়োর বিদস্ত নগরীর মতো
মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে শিলা বা মাটির নীচে?
না কী সাগর বক্ষে হঠাৎ যাবে তলিয়ে?
আজ থেকে হাজার কিংবা লক্ষ বছর পরে —
তুমি কী হবে বিলীন?
বলো সখী বলো, — এই সব কিছুরই কী
পাবোনা উত্তর? তবে কী আমার মতো
তুমিও মরে যাবে একদিন?
পরলোকে বসে আমি কী তা’হলে শুনবোনা সেদিন
তোমার প্রাণের গভীর থেকে উঠে আসা
রবীঠাকুরের দেওয়া আমার প্রিয় সেই গান
তোমার জাতীয় সঙ্গীত —
” আমার সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালোবাসি
চিরদিন তোমার আকাশ
তোমার বাতাস
আমার প্রাণে বাজায় বাঁশী”।
আমি কী শুনবোনা সে দিন
আকুল করা এই গান?
হে আমার প্রাণের প্রিয়া – প্রিয় বাংলাদেশ
বলো বন্ধু চুপটি করে থেকোনা আর
দাও উত্তর।
Leave a Reply