বিবেক
আমাদের ছোটবেলায় যখন শীত জেঁকে বসতো, যখন সন্ধ্যা হলেই কুয়াসার চাঁদরে ঢেকে যেত চরাচর, তখন সেই কুয়াসাচ্ছন্ন কলেজের বিশাল মাঠে জ্বলে উঠতো লাল নীল বাতি। মাইকে ঘোষণা আসতো সুচিত্রা সেন- নাম্বার টেন, হ্যাজব্রেন্ড এন্ড ওয়াইফ – সিক্সটি ফাইভ , সাথী হারা সারথি – সেভেন জিরে সেভেনটি । বড় বেশী আকর্ষণ করতো এই অন্ত্যমিলের কবিতা ! আমাদের ছোটদের হাতে তখন কোন পয়সা থাকতো না। পকেটের ভাজে যা থাকতো তা দিয়ে বড় জোর কেনা যেত বাদাম বা কটকটি। কপর্দকশূন্য আমি দাড়িয়ে দাড়িয়ে শুনতাম সেই ছন্দময় কবিতা। সেই সুর থামিয়ে কেউ যখন বলে উঠত হাঊজী হাউজী, তখন থাকতো না আনন্দের সীমা।
হাউজীঘর পেড়িয়ে কলেজের শেষ প্রান্তে বিশাল সামিয়ানায় ঢাকা এক রহস্যপুরী। সেখানে শুধু বড়দের প্রবেশাধিকার। সেই রহস্যপুরীর বাতায়ন পথে ভেসে আসতো সানাই, ঢোলকের সাথে পুরুষ আর নারীকন্ঠের কতো আবেগময় কথামালা ! সামিয়ানার ফাঁক ফোঁকরে চোখ রেখে মিটত না সে দেখার তৃষ্ণা। মনে মনে ভাবতেম কবে বড় হবো, আর সামনে বসে দেখব অপার্থিব জগতের সেই সুন্দর মানুষদের অবয়ব, আর কান পেতে শুনবো ওদের কাব্যিক সংলাপ !
আশ্চর্যভাবে সময় আমায় বড় হবার সময় না দিয়েই একদিন সুযোগ নিয়ে এগিয়ে আসে। অবারিত হয় আমার সেই রহস্যপুরীর দ্বার। সবাধীনতাত্তোর আমরা যে বাড়ীতে দু তিনটে পরিবার পরম আত্মীয়ের মতো বড় হয়েছি, তাদেরই মাঝে একদিন হাজির হন ধূতি পরিহিত একজন মধ্যবয়সী ব্যক্তি, এক যাত্রাপালার প্রমটার। আমরা তাকে কাকাবাবু বলি। অল্প সময়ে সে কাকাবাবু আমাদের খুব আপন হয়ে যান। আর তার সাথে আপন হয়ে যান যাত্রা পালার অনেক কলাকুশলী। ওরা মাঝে মাঝে দল বেধে বাসায় আসে।অতি সাধারণ মানুষ ওরা ! অতি সাধারণ ওদের চেহারা। আলো ঝলমল রাতের বাতাবরণে রঙ মেখে রাজকন্যা সেজে, ধনীর দুলালী হয়ে কতোই না ঢঙ করে – কিন্তু রাত শেসে ওরা আমাদেরই মতো মুখে তুলে নেয় গুড় দিয়ে রুটি আর বিস্কিট চুবিয়ে চা ।
একদিন সময় আসে ওদের অভিনয়কে খুব কাছ থেকে দেখার। কাকাবাবু আমাকে বসিয়ে দেন মঞ্চের গা ঘেঁসে বসে থাকে বাদ্য যন্ত্রীদের সাথে। খড়ের আসনে বসে বসে দেখি ওদের গমনাগমন। সানাই বেজে ওঠে, ঢোলবাদক ঢোলে চাটি দিয়ে বেড় করে আনে কাঙ্ক্ষিত চটুল সুর। আমার দেখা অতি সাধারণ দরিদ্র নর্তকীরা দল বেধে নেচে চলে, ওদের চোখে মুখে নেচে ওঠে আদিম আহ্বান। দর্শকের আসন থেকে ভেসে আসে শীষ আর অশ্লীল কথোপকথন। সকালে যে ব্যক্তিটা কাকাবাবুর সাথে বিড়ী ফুঁকছিলেন, তিনি আসেন রাজপুত্রের বেশ ধরে। গায়ে তার জড়িদার বর্ণীল পোশাক, মাথায় রাজ মুকুট, সারা শরীরে মনিমাণিক্য। তিনি অট্টহাসিতে মঞ্চ কাপিয়ে তোলেন। হাসতে হাসতে তিনি চলে আসেন মঞ্চের সীমানায়। ছোট বলে আমি মাথা উঁচু করে আরও বেশী করে দেখার চেষ্টা করি; বাদ্যকরের দল আমায় টেনে ধরে। হঠাৎ করে রাজপুত্র তার কোশ থেকে বেড় করে আনে সুদীর্ঘ এক তরবারি। তরবারির আঘাতে আমি মাথা নিচু করে দুঃখ দুঃখ মন করে বসে থাকি। তিনি ক্ষণিক থেমে আবারো অকস্মাৎ ফেটে পড়েন অট্টহাসিতে। হঠাৎ মঞ্চে আসে গেরুয়া বসন পরিহিত মুখে সুদীর্ঘ দাড়ি, জটাযুক্ত মাথার চুল, পাদুকাহীন পা দুটোতে দীর্ঘ পথচলার চিহ্ন নিয়ে এক পথের মানুষ। সে নির্লিপ্ত হয়ে গান ধরে – ওরে , ওরে ও পাপী, একদিন আসবে অন্ধকার, ভেবে দেখ কেমনে হবি ভবসিন্ধূ পার, সামনে আসছে অন্ধকার…। নেমে আসে শুনশান নীরবতা। এতক্ষণ যারা শিষ দিয়ে চটুল কৌতুকে মেতেছিল তারাও কোলাহল ভুলে চুপচাপ বসে থাকে। শত শত মানুষের হৃদয়ের মাঝে বাস করা বিবেকের কথা কেড়ে নিয়ে অকুতোভয়ী সে উগড়ে দেয় কথার বান। আমি তাকিয়ে থাকি, বুঝতে পারি না গানের কথা, কিন্তু কেন যেন মনে হয় এ জগতে ভোগ -বিলাস, লোভ-মোহের বাইরে যে আরেক খানি জগত আছে, যে জগতে কেউ কখনো প্রাপ্তির আশা না করে নীরবে কাজ করে যায়, যেখানে কেউ জয়ের আশা, পরাজয়ের ভীতিকে ত্যাগ করে নিজের মনের মাঝে গড়ে তোলে আনন্দের জগত – সে যেন এসেছে সেই আনন্দলোক থেকে।
বড় হবার সাথে সাথে ছোটবেলার দেখা সেই বিবেককে আমি কতো ভাবে আবিষ্কার করি – কখনো নাটকে, কখনো সিনেমায়, আবার কখনো নিজের মাঝে। মনের মাঝে প্রশ্ন আসে – আচ্ছা, বিবেকের গায়ে কেন ছিন্ন পোশাক, কেন তার মাথা জটাযুক্ত, কেন সে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জানিয়ে দেয় এই শরীরের নশ্বরতা, এই ভোগ বিলাসপূর্ণ জীবনের অসারতা ? আচ্ছা, কে এই বিবেক? কোথা হতে আসে, কেন আসে সে?….
Leave a Reply