পৃথিবীর সভ্যতার সূত্রপাত হতে মানুষের ধর্ম বিশ্বাসের পরিবর্তন কিভাবে হয়েছে, এবং ঐশী ধর্মের উৎপত্তি ও তাঁর বিস্তার কিভাবে হয়েছে এবং তারই ধারাবাহিকতায় ইসলাম ধর্ম কিভাবে এসেছে, মহামানব উপন্যাসে তাই চিত্রায়িত করা হয়েছে।
মহামানব।
খলিলুল্লাহ উটে চড়ে রশি ঢিল দিলেন। উটটি চলা শুরু করল তাঁর ইচ্ছেমতো। কিছুক্ষণ চলার পর, আকাশে উড়ে এল একখন্ড মেঘ। মেঘ উড়ে যায়, পাশাপাশি তাঁরাও যায়।
একটু পরে বুঝতে পারে ইব্রাহিম, মেঘ দেখেই উট এগিয়ে যায়। যাত্রাপথ তিনি উটের ইচ্ছার উপর ছেড়ে দিলেন। বৃদ্ধ ইব্রাহিমের শুরু হল আর এক নতুন ভ্রমণ। তাঁর জীবনে ভ্রমণ যেন আর শেষ হয় না!
ইব্রাহিম বর্তমানে বসবাস করে কেনান অঞ্চলে যা প্যালেষ্টাইন বা ফিলিস্তিন নামে পরিচিত। কেনান, ভূমধ্যসাগরের পার্শ্ববর্তী লেভাল্টের অংশ। লেবানন, ফিলিস্তিন ও ইসরাইল ছিল লেভাল্ট অঞ্চলের অন্তর্গত।
কেনানের কোন এক জায়গায় ইব্রাহিম বেশীদিন স্থির থাকেন নাই। একেশ্বরবাদ প্রাচারের জন্য বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় বসবাস করতেন। তাঁর জন্মস্থান ছিল মেসোপটিমিয়ার উর শহরে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার নির্দেশে তিনি হিজরত করেছিলেন এ অঞ্চলে। হিজরতের পূর্বেই সৃষ্টিকর্তা তাঁকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও উর্বর অঞ্চলে থাকার।
নীলনদের অববাহিকা থেকে লেভাল্ট হয়ে মেসোপটেমিয়ার অববাহিকা পর্যন্ত জায়গাটি একটি চন্দ্রের আকৃতি দাঁড়ায়। অত্যন্ত উর্বর এ জায়গাটিকে ফার্টাইল ক্রিসেন্ট বলা হয়। প্রাচীনকালের বেশীরভাগ সভ্যতার উম্মেষ ঘটেছিল এ ক্রিসেন্ট এলাকার মাঝেই। এরমাঝে লেভাল্ট শুধু উর্বরই ছিলোনা বরং ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল, তিনটি মহাদেশের সংযোগস্থল। এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে যেতে হলে অথবা আক্রমণ করতে হলে লেভাল্টের উপর দিয়েই যাতায়াত করতে হতো।
সেই সময় সভ্য পৃথিবী বলতে বোঝাত শুধু মিশর ও মেসোপটেমিয়াকে। ইউরোপে তখনও সভ্যতার ছোঁয়া লাগে নাই। চীনের ইয়েলো নদীর সভ্যতা তখনও শুরু হয়নি। ভারতের সিন্ধু নদের অববাহিকায় সভ্যতা থাকলেও তা ছিল নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
ইব্রাহিম তাঁর জীবন ব্যাপী ক্রিসেন্টের মেসোপটেমিয়ার একপ্রান্ত থেকে শুরু করে ঘড়ির কাঁটার উল্টাদিকে ভ্রমণ শুরু করে, একের পর এক শহর আর অঞ্চল ঘুরতে ঘুরতে ক্রিসেন্টের অপরপ্রান্তে পৌঁছান। হিজরতের প্রথমে তিনি গিয়েছিলেন মেসোপটেমিয়ার উত্তরে হারান শহরে, সঙ্গে ছিল স্ত্রী সারাহ আর ভাতিজা লূত।
সেখানে কিছুদিন থাকার পর তিনি চলে আসেন কেনান অঞ্চলে। শুরুতে সে অঞ্চলের সাকাম নামক স্থানে বসবাস করতেন। কিছুদিন সেখানে থেকে চলে আসেন বেথেলে। বেথেলেও বেশীদিন থাকলেন না, চলে গেলেন নাগেবে। অনেকটা যাযাবরের মতোই ঘুরতেন তিনি।
মিশরের সিনাই উপত্যকা সংলগ্ন নাগেব ছিল মরু অঞ্চল। সেখানে বসবাস করার সময় ভীষণ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ইব্রাহিম তখন বাধ্য হয়ে চলে যায় মিশরে। মিশরে অবস্থানকালে তাঁর পারিবারিক জীবনে নেমে আসে অন্যরকম একটি দুর্যোগ।
ইব্রাহিমের স্ত্রী সারাহ ছিল খুবই সুন্দরী। কথিত আছে হাওয়া ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী নারী। হাওয়ার পর সৌন্দর্য্যের দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠা ছিল সারাহ। তাঁর সৌন্দর্য্যের খবর পৌঁছে গেল ফেরাউনের কাছে। মিশরের ফেরাউনের নাম তখন আমলাক, ভীষণ দুশ্চরিত্রের অধিকারী। তাঁর সৈন্যরা একদিন সারাহকে ধরে নিয়ে গেল তাঁর রাজপ্রাসাদে।
নীল নদের পারেই ছিল ফেরাউনের রাজ প্রাসাদ। প্রবেশ পথের দুইপাশে বিশাল বিশাল আকৃতির মূর্তি দাঁড়ানো। অর্ধেক মানুষ আর মূখগুলো পশুর আকৃতি দেওয়া মূর্তিগুলো দেখে প্রজাদের পিলে চমকাতো। বিশাল কাঠামোর রাজপ্রাসাদের সাথে এ মূর্তিগুলো দেখলে রাজভক্তি এমনিতেই বেড়ে যেতো।
প্রবেশদ্বার পার হয়ে ভিতরে গেলে চোখে পড়ে পাথরের তৈরী বিশালাকার কলামের সারি। এসব কলামের পাশ দিয়ে কখনও ডানে, কখনও বামে ঘুরে অগনিত কক্ষ পার হয়ে ফেরাউন গেল সারাহর কাছে। চলার পথেই রাজকীয় সৈন্যরা নিরাপত্তার জন্য যে যার অবস্থানে এক এক করে দাঁড়িয়ে যেতে লাগল। সারাহর কক্ষের কাছাকাছি এসে ফেরাউন একা হয়ে গেল। তাঁর মনে কামনার আগুন, আর কিছুক্ষণ পরেই সে পেয়ে যাবে তাঁর স্বপ্নরানী সারাহকে।
হঠাতই কি যেন ঘটে গেল ফেরাউনের! আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। দরজার কাছাকাছি শুধু মুখ থুবরে পড়ে গেল।
পাথরের মেঝেতে শব্দ শোনা গেল, ধপাস!
অসুস্থ ফেরাউন রাজকীয় বিছানায় শুয়ে আছে। চোখ, মুখ, হাত, পা স্থির হয়ে আছে, কোন অঙ্গপ্রতংগই নাড়াতে পারছেন না তিনি। শুধু চোখের ইশারায় ভাব বিনিময় করতে পারছে। চিকিৎসকের কপালে চিন্তার বলিরেখা ফুটে উঠেছে। সুস্থতার কোন লক্ষণ নাই ফেরাউনের।
সারাহ প্রাসাদেই বন্দি ছিল। ফেরাউনের অসুস্থতার খবর তাঁর কানে গেল। মানব দরদী সারাহ ফেরাউনের সুস্থতার জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া চাইলেন। চিকিৎসকের চিকিৎসা, না সারাহর দোয়া; ঠিক কোন কারণে যে ফেরাউন সুস্থ হয়ে উঠল তা কেউ বোঝার চেষ্টা করল না। নচেৎ, ফেরাউন কি আর দ্বিতীয়বার সারাহকে পাওয়ার চেষ্টা করে!
সুস্থ হয়েই ফেরাউনের মনে আবার কামনা জেগে উঠল। আবার একদিন সারাহর কাছে গেল। ফেরাউনের চিন্তাতেও ছিলোনা যে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে!
ঘটলও তাই, ফেরাউনের আবার হাত পা বাকিয়ে গেল। আবারও চিকিৎসক ব্যার্থ হলো। দেশ বিদেশের নামকরা পুরোহিত আর তান্ত্রিক এলো কিন্তু কোন কিছুতেই কোন উন্নতি হলোনা তাঁর।
দু’একজন রক্ষীর মনে ভেসে এলো সারাহর আগের বারের প্রার্থনার কথা। সেবার কাউকে সারাহর কৃতিত্ব বলতে না পারলেও, এবার তাঁরা সারাহর কথা বলল। চিকিৎসক সবশুনে সারাহর শরণাপন্ন হল। চেষ্টা করে দেখতেতো সমস্যা নাই। মহতী সারাহ আবার হাত তুললেন সৃষ্টিকর্তার কাছে।
সুস্থ হয়ে গেল ফেরাউন।
কিন্তু এতকিছুর পরেও হুঁশ হলোনা ফেরাউনের। সে তাঁর মনষ্কামনা পূর্ণ করার জন্য আবার ব্যাস্ত হয়ে পড়ল। সবকিছু জেনেশুনেও সে নিজের কামনা বাসনার কাছে হার মানল! পূর্বেকার ঘটনাগুলো কাকতালীয় ভেবে, একদিন ঠিকই ছুটে গেল সারাহর কাছে।
এবার ফেরাউনের জীবন মরণ সমস্যা দেখা দিল। চিকিৎসার সীমাবদ্ধতা বুঝতে পেরে চিকিৎসকেরা এবার নিরাশ হয়ে রইল। সভাসদ আর রাজন্যবর্গ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। শেষ চেষ্টা হিসাবে সবাই মিলে আবার সারাহর কাছে গেল। দয়ালু সারাহ আবার প্রার্থনা করলেন!
ধীরে ধীরে ফেরাউন সুস্থ হয়ে উঠল। এবার আর ফেরাউনের উপলব্ধি ঘটল। অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করল। শুধু তাই নয়, সারাহকে সসম্মানে তাঁর স্বামীর কাছে পাঠিয়ে দিল। কৃতজ্ঞতা হিসাবে সঙ্গে দিল প্রাসাদের একজন রাজবংশীয় ক্রীতদাসী।
সেই ক্রীতদাসীটিই ছিল হাজেরা। শুরু হল জীবনের আরেকটি নতুন অধ্যায়।
ইব্রাহিম নবী-২
সারাহকে অক্ষত দেখতে পেয়ে, সৃষ্টিকর্তার প্রতি ইব্রাহিম আঃ-এর কৃতজ্ঞতাবোধ আরও বেড়ে গেল।
এদিকে কেনান অঞ্চলে দুর্ভিক্ষের প্রকোপ কমে এসেছে। ইব্রাহীম তাই সপরিবারে নাগেবে ফিরে আসলেন। এখানে থাকার পর তিনি আবার চলে যান কেনানের মধ্যাঞ্চল, জুডিয়ান পাহাড়ী এলাকায়। শহরটির নাম ছিল হেবরন। পরে মামর নামক এলাকায় গিয়ে বসবাস করা শুরু করেন।
প্রতিটি অঞ্চলেই তিনি একেশ্বরবাদের প্রাচার করে বেড়াতেন। মামরে থাকা অবস্থায় ভাতিজা লুতকে একেশ্বরবাদ প্রচার করতে জর্ডান উপত্যকায় পাঠান।
ইব্রাহিমের বয়স ৮৫ পার হয়েছে। সারাহর সন্তান হওয়ার বয়স গত হয়েছে। দীর্ঘ জীবন পার হল, তিনি এখনও নিঃসন্তান! এ নিয়ে মনে বেশ হাহাকার ছিল। মনের দূঃখে একদিন প্রার্থনা করলেনঃ
হে প্রভু, আমাকে একটি সৎ সন্তান দান করো।
সন্তান না হওয়ায়, সারাহ নিজেও ছিল মনোঃকষ্টে। অতঃপর স্বামীর আকাঙ্খা পূর্ণ করার আশায় নিজেই উদ্যোগী হয়ে দাসী হাজেরার সাথে ইব্রাহিমকে বিয়ে দিলেন।
হাজেরা গর্ভ ধারণ করল, নির্দিষ্ট সময়ে পুত্র সন্তান ঈসমাইল জন্মগ্রহণ করল। ইব্রাহিমের বয়স তখন ছিয়াশি। বৃদ্ধ বয়সে শিশুপুত্রের হাসি দেখে মন ভরে উঠল তাঁর।
মানুষ বিচিত্র, তাঁর কর্মকাণ্ড আরও বিচিত্র। একদা যে হাজেরাকে নিজেই বিয়ে দিয়েছিলেন, সন্তান জন্মানোর পর সারাহ আর সহ্য করতে পারতোনা তাঁকে। এর কিছু কারণও ছিল। ইব্রাহীম যেন হাজেরার প্রতি একটু বেশিই অনুরক্ত। সারাহ ব্যাপারটা মেনে নিতে পারলোনা। পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল যে, হাজেরার উপস্থিতিই তাঁর কাছে বিষের মতো লাগল।
আবার হাজেরাও কিছুটা উপেক্ষা করতো তাঁকে। এতসব জ্বালা সইতে না পেরে, সারাহ একদিন বলেই ফেললঃ
হাজেরা আর ঈসমাইলকে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিতে হবে। তা নাহলে আমিই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো!
এরূপ কথায় ব্যাথিত হয়ে ইব্রাহিম বললেনঃ
কেবলইতো সন্তান জন্মালো, এরমাঝে তুমি এসব কি বলছো!
সারাহ কোন উত্তর না দিয়ে বলে উঠলেনঃ
কবে এদের বিদায় করবা, সেটা বলো?
ইব্রাহিম উত্তর না দিয়ে নির্বাক হয়ে রইল।
সে ভাবল কিছুদিন অতিবাহিত হলে পরিস্থিতি এমনিতেই স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
কিন্তু সেরকম কিছুতো ঘটলই না বরং পরিস্থিতি দিনের পর দিন খারাপ হতে লাগল। একদিন রাগের চোটে হাজেরার নাক, কান ফুটো করে দিল। তাঁর এ কুৎসিত চেহারা দেখে মন কিছুটা হলেও শান্তি পেলো।
হাজারাকে দেখে বড়ই ব্যথিত হল ইব্রাহিম। নাক আর কানের ফুটো না যাতে চোখে না পড়ে তাই গহনা পরিয়ে দিলো।
হাজেরাকে এখন বেশ সুন্দর দেখাতে লাগল।
কথিত আছে এরপর থেকেই মেয়েদের নাক ও কানের গহনার প্রচলন হয়। আরবে এ প্রথা জনপ্রিয় হয়ে উঠলে, সেখান থেকে মুঘলরা আমাদের উপমহাদেশে নিয়ে আসে।
হাজেরাকে সুন্দর দেখালে কি হবে! কিন্তু কোন স্থায়ী সমাধানতো হলোনা। দুশ্চিন্তায় পড়ে রইলেন ইব্রাহিম। কি করবেন, কি করা উচিত ? এহেন আকাশ পাতাল প্রায়শই চিন্তা করেন তিনি। এমত চিন্তিত অবস্থায় একদিন জিব্রাইল এসে হাজির। জিব্রাইলকে দেখে তিনি জিজ্ঞাসু নয়নে তাঁকালেন।
জিব্রাইল বললেনঃ
হে খলিলুল্লাহ! আল্লাহ তায়ালা ইসমাঈল ও হাজেরাকে নির্বাসনে দিতে বলেছেন।
ইব্রাহিম ব্যথিত হৃদয়ে বললেনঃ
নির্বাসনে পাঠালে ঈসমাইল বাঁচবে কিভাবে?
জিব্রাইল বললেনঃ
এ ফয়সালা বুঝার সাধ্য আমার আপনার নাই! এখন আপনি যত দ্রুত এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবেন ততোই মঙ্গল।
বেদনা ভারাক্রান্ত হৃদয়ে একদিন হাজেরাকে কিছু না বলে পুত্রসহ তাঁকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লেন অজানার উদ্দেশ্যে। আর তাঁকে পথ দেখিয়ে চললেন জিব্রাইল আঃ।
Leave a Reply