পৃথিবীর সপ্তাশ্চার্য,
প্লাজা থেকে সোজা একটা ব্রিজ চলে গেছে। অবশ্য এটি নদীর উপর পর্যন্ত গিয়ে ঝুলে আছে। এটি পর্যটকদের জন্য তৈরী একটি অবজারবেশন ডেক। এখান থেকে লিফটে করে নীচে নামা যায়। কিন্তু কোথায় নামে তা তখনও আমার অজানা। তবে লিফটটি যে ডেকের সাপোর্টের কাজও করছে তা নিশ্চিত।
ডেকে দাঁড়িয়ে ডানে উত্তর দিকে তাকালে কানাডা ও আমেরিকার সংযোগকারী ঝুলন্ত সেতু চোখে পড়ে। সেতুটি বেশ নান্দনিক।
আর বায়ে তাকালে দুটি জলপ্রপাতের দৃশ্যই একফ্রেমে দেখা যায়।
প্রথম দর্শনে এতোই মুগ্ধ হলাম যে, মনে হল স্বর্গ দর্শন করছি। দুটি প্রপাতেই সাদা কুয়াশার সৃষ্টি হয়ে জায়গাটিতে এক ঐশ্বরিক ভাবের সৃষ্টি করেছে।
নায়াগ্রা ফলস, আসলে তিনটি জলপ্রপাত। আমার পাশে আমেরিকান ফল, আর ঐ দূরে কানাডিয়ান ফল। আমেরিকান ফলের পাশে সরু ফিতার মতো অরেকটি ফল আছে যাকে ব্রাইডাল ভেইল বলে।
তবে একে আমেরিকান ফল থেকে আলাদা করা মুশকিল। একটু খেয়াল করলে বোঝা যায় ছোট্ট একটি ভূখন্ড, একে আমেরিকান ফল থেকে আলাদা করেছে। ভূখন্ডটির নাম লুনার আইল্যান্ড। এই ফলের অন্যপার্শ্বে আছে গোট আইল্যান্ড বা ছাগল আইল্যান্ড। আর গোট আইল্যান্ডের পর থেকেই কানাডিয়ান ফলের শুরু।
কানাডিয়ান ফলটি অর্ধ চন্দ্রাকৃতির। এজন্য একে হর্স সু ফল বলে। তিনটির মাঝে সবচেয়ে বড় এবং উঁচু হল এই জলপ্রপাতটি, চওড়া প্রায় ছাব্বিশশ ফুট, উচ্চতা প্রায় একশত ছিয়াত্তুর ফুট। সৌন্দর্য্যের দিক দিয়ে অতুলনীয় এ জলপ্রপাতের সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য কানাডিয়ান পার্শ্ব থেকে দেখা যায়।
নদীতে দুটি জাহাজ দেখা যাচ্ছে, একটি আমেরিকার সীমান্ত ঘেঁষা আরেকটি কানাডিয়ান সীমান্ত ঘেঁষা। বোঝাই যাচ্ছে জলপ্রপাতের কাছ থেকে ঘুরে আসাই এগুলির কাজ। সবার দেখাদেখি আমরা লিফটে করে নীচে নামলাম, দরজা খোলার পর বেড়িয়ে এসে দেখি নদীর তীরে পৌঁছে গেছি।
নায়াগ্রা নদীর মাঝ বরাবর আমেরিকা ও কানাডার সীমান্ত। নদীর উভয় পার তীব্র খাড়া। আমরা আছি লিফটের উত্তরে। একটি জাহাজে লাইন ধরে পর্যটকরা উঠছে। আমারাও লাইনে দাঁড়ালাম, কিন্তু উঠার আগেই জাহাজ ভর্তি হয়ে গেল পর্যটকে।
অহেতুক দাঁড়িয়ে না থেকে আমরা অন্যান্য লোকজনকে অনুসরণ করে উল্টো দিকে হেঁটে লিফট অতিক্রম করলাম। সোজা তাঁকাতেই খুশিতে মনটা ভরে উঠল। একটা সিঁড়ি একেবেকে উপরে উঠে আমেরিকান ফলের নিকটে নিয়ে গেছে। উৎসাহ নিয়ে ফলের পাশ দিয়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠছি। মাঝামাঝি এসে দেখলাম, তীব্রবেগে জলরাশি উপর থেকে পড়ছে। নীচে প্রচুর জলীয় কণা বাতাসে ভেসে কুয়াশার সৃষ্টি করেছে। তবে তা প্রপাতের উচ্চতাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ঠ নয়।প্রপাতের নীচে বড় বড় পাথর পড়ে যথেষ্ঠ উঁচু হয়ে আছে।
আরও কিছুদূর উঠার পর সিঁড়ি ছোট্ট এক প্ল্যাটফর্মে থমকে গেছে। এতো কাছ থেকে বিশাল একটি জলপ্রপাত দেখব কোনদিন চিন্তাও করিনি। জলপ্রপাত বলতে মাধবকুন্ডু দেখে অভ্যস্ত আমরা। কেমন যেন অবিশ্বাস্য ঠেকে সবকিছু, কোন স্বপ্ন দেখছি না তো?
এটি চওড়ায় ষোলোশ ফুট, উচ্চতায় সত্তুর ফুট। উপর থেকে দেখলাম একটা জাহাজ ফিরে আসছে ঘাটের দিকে। এখানে আর না দাঁড়িয়ে নীচে নামা শুরু করলাম।
পর্যটকেরা জাহাজের ছাদে দাঁড়ানো। সবাই খুব আনন্দে আছে। সাধারণত সাদা চামড়ার লোকদের আনন্দের বহিঃপ্রকাশ কম। কিন্তু এখানে যারা আছে তাঁদের ক্ষেত্রে এ নিয়ম খাটল না। মহাকাশ যাত্রী যাত্রার পূর্বে যেমন হাসিখুশি থাকে, সবার চোখমুখে সেই আনন্দিত চেহেরা। নীল রঙের পাতলা পলিথিনের পোশাক জড়িয়ে অপেক্ষায় আছে সবাই। অজানা অচেনা জায়গা আবিষ্কারের নেশায় রোমাঞ্চিত হয়ে আছে সবাই।
জাহাজ যাত্রা শুরু করল কিছুক্ষণ পরে। জাহাজ না বলে ষ্টীমার বলাটাই যুক্তিযুক্ত। ক্যাপ্টেন লাউড স্পিকারে জাহাজের ইতিহাস বলতে লাগল। নদীর উপর যখন কোন ব্রীজ ছিলনা, তখন ফেরি হিসাবে ব্যবহৃত হতো। ব্রীজ হওয়ার পর পর্যটনের কাজে ব্যবহার করা শুরু হয়।
জাহাজের নাম, ‘মেইড অব দ্য মিস্ট’ অর্থাৎ কুয়াশার দাসী। জাহাজের গায়ে নামটি লেখা আছে। যেমনটি আমাদের দেশের লঞ্চ বা ষ্টীমারের গায়ে লেখা থাকে এমভি রুস্তম, এমভি সোহরাব অনেকটা সেরকম।
ধীরে ধীরে আমেরিকান ফলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, এক অজনা ভয়ে ভীত সবাই। পানি পতনের শব্দে ক্যাপ্টেনের কথা আর শোনা গেলনা। পানির ছিটা এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে আমাদের। সতর্কতার জন্য ছবি তোলা বাদ দিয়ে ক্যামেরাটিকে পলিথিনের ভিতর নিয়ে নিলাম।
দেখলাম আমার স্ত্রী পাশে এসে কিছু একটা বলতে চাচ্ছে। মাথা এগিয়ে দিলাম তাঁর দিকে কিন্তু শুনতে পেলাম না। ইশারায় বুঝিয়ে দিলাম যে কিছুই শুনি না। ও হেসে দিল। এসময় জাহজ কুয়াশার ভিতরে ঢুকে পড়ল। আশেপাশে দাঁড়ানো লোকজন কুয়াশার আড়ালে চলে গেল। শুধু ওকে দেখতে পাচ্ছি। হঠাৎই মনে পড়ে গেল নায়াগ্রা নিয়ে আমার কল্পনার কথা! কল্পনা যে এভাবে বাস্তব রূপ লাভ করবে তা এই জাহাজের ডেকে না আসলে বুঝতাম না। নায়াগ্রা আসার পথে ট্রেনে বসে ঝিমুচ্ছিলাম আর জলপ্রপাতের কথা ভাবছিলাম। কল্পনায় আমি আর আমার স্ত্রী প্রচন্ড শব্দের কারণে ইশারায় কথা বলছি আর পানির ছিটা এসে আমাদের ভিজিয়ে দিচ্ছে!
জলপ্রপাতের কাছে প্রচুর কুয়াশা আর শব্দ। এর গোড়ায় পাথরের স্তুপ, তাই জাহাজ বেশী নিকটে যেতে পারল না। জাহাজ কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল জানিনা। চলছে কি, না? তাও জানিনা। তবে একসময় কুয়াশা ফিকে হয়ে এল। নদীর পানি দেখা গেল, নদীর পার চোখে পড়ল। জলপ্রপাত থেকে বের হয়ে এসেছি। ক্যাপ্টেন ঘোষণা দিল, এবার যাচ্ছি কানাডিয়ান ফলসের দিকে। সকল পর্যটক, ‘ওয়াও’ ধ্বনি দিয়ে স্বাগত জানাল এ যাত্রাকে।
দুইপাশের প্রায় শতফুট উঁচু পার, নদীটিকে গীরিখাতের রূপ দিয়েছে। কানাডিয়ান পারের উপারে, টাওয়ার আর কয়েকটি উঁচু ভবন চোখে পড়লেও আমেরিকান অংশে শুধুই গাছপালা চোখে পড়ে। জলপ্রপাতের পানি নদীতে তীব্র স্রোতের সৃষ্টি করেছে। এ স্রোত মনে ভয় ধরিয়ে দিলেও এর সৌন্দর্য্য অসাধারণ! অনেকটা গোখরা সাপের ফনার মতো সুন্দর আর আকর্ষণীয়!
জাহাজ এগিয়ে চলছে, ক্যাপ্টেন স্পীকারে জাহাজের নাম নিয়ে কিছু একটা বলে যাচ্ছে। সৌন্দর্য্য উপভোগে নিবিষ্ট সবাই, শুনায় কোন আগ্রহ নাই।
অনেক আগে ইউরোপিয়ানদের আগমনেরও বহুপূর্বে। নায়াগ্রার তীরে লিলাওয়ালা নামে এক মেয়ে তাঁর পরিবারসহ বসবাস করত। স্বামী মারা যাওয়ায় সে মনের দূঃখে, একদিন নদীতে নৌকা ভাসিয়ে দিল। নিজেকে সমর্পণ করল নায়াগ্রার স্রোতের কাছে। নৌকা ভাসতে ভাসতে জলপ্রপাতের প্রান্তে চলে আসল।
বজ্রের দেবতা, ‘কেনো’ লিলাওয়ালাকে জলপ্রপাতের নীচ থেকে অর্ধমৃত অবস্থায় উদ্ধার করে নিয়ে আসে নিজ বাড়িতে। তাঁর বাড়ি ছিল জলপ্রপাতের পিছনে। সেখানে, ‘কেনো’ ও তাঁর ছেলে মিলে সেবা শশ্রুষা করে লিলাওয়ালাকে সুস্থ করে তুলল। লিলাওয়ালা, দেবতা কেনোর ছেলের প্রেমে পড়ে যায় ও তাঁকে বিয়ে করে। তাঁরা সুখেই জীবন যাপন করতে থাকে।
কিন্তু এতো সুখে থেকেও তাঁর মন বিষন্ন হয়ে উঠে নিজ গ্রামের লোকদের দেখার জন্য। একদিন সেই সুযোগ চলে আসে। দেবতা কেনো তাঁকে জানায় বিশাল একটি সাপ নদীর পানিতে বিষ মিশাচ্ছে। নদীর পারের লোকজন পানি খেয়ে যখন মারা যাবে, তখন সাপটি তার উদরপূর্তি করবে। দেবতা কেনো লিলাওয়ালাকে অনুমতি দিল তাঁর গ্রামের সকল লোকজনকে সতর্ক করে দিয়ে আসার জন্য।
লিলাওয়ালা গ্রামে গিয়ে সাপের ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করল। তাঁর কথা শুনে লোকজন উজানে চলে গেল। গ্রামের সবাই চলে গেলে, সে জলপ্রপাতের পিছনে ফিরে আসে।
এদিকে সাপটি গ্রামে এসে কাউকে না পেয়ে লোকজনদের ধরার জন্য উজানে রওনা দিল।
দেবতা কেনো তখন লোকজন বাঁচাতে জলপ্রপাতের তরঙ্গ ভেদ করে উপরে উঠে এসে সাপটির দিকে বজ্র নিক্ষেপ করে। বজ্রের আঘাতে সাপটি মরে গেল, মৃত সাপটি পানিতে ভেসে জলপ্রপাতের নীচে পড়ে গিয়ে পানির প্রবাহে বাঁধা সৃষ্টি করল। বাঁধা পেয়ে, পানি জলধারার পিছনে দেবতা কেনোর বাড়িতে ঢুকে পড়ল। বাড়িটি ধ্বংসের আগেই কেনো এসে তাঁর ছেলে ও লিলাওয়ালাকে উদ্ধার করে আকাশে তুলে নিয়ে গেল। সেখানে একটি নতুন প্রাসাদে সবাইকে রাখা হল। সেই থেকে লিলাওয়ালার স্থান হল আকাশের উপরে।
লিলাওয়ালা আকাশের উপর থেকে প্রতিদিন নিজ গ্রামের লোকদের দেখে। তাঁর ইচ্ছে করে সেখানে যেতে, তাঁদের আনন্দ বেদনায় অংশগ্রহণ করতে। কিন্তু সে পারে না! কোনদিন পারবেও না। নায়াগ্রার কুয়াশার শেষ দাসী লিলাওয়ালার ক্রন্দন, অন্তরেই গুমরে মরে। এটাই মেইড অব দ্য মিস্ট নামের মিথ।
চলে এসেছি হর্স সু ফলের কাছাকাছি। দেখে মনে হয় কেউ যেন কেকের উপর ছুড়ি চালিয়ে এই আকৃতি দিয়েছে। আর উচ্চতার কারণে এর রূপ দাঁড়িয়েছে অর্ধ সিলিন্ডারের মতো।
পানির চাদর সিলিন্ডারকে করেছে আরও মসৃণ। আর সিলিন্ডারের কাঠিণ্য ভেঙ্গে দিয়ে, আশ্চর্যজনক গতিশীল রূপ দিয়েছে। বাতাসে ভর করে কানে বেজে উঠল বিপুল পরিমাণ পানির ক্রমাগত পতনের শব্দ। সেই শব্দ প্রকৃতিতে গুঞ্জনাকারে ছড়িয়ে পড়ছে আর পানির ফোটা নানারকম মুদ্রায় নেচে চলেছে।
সূর্যের আলোয় রংধণু সৃষ্টি হল। ভূবন ভুলানো সৌন্দর্য্য নিয়ে জলপ্রপাতটি আমাদের সামনে উপস্থিত। ঐশ্বরিক এ প্রবেশদ্বার কি আমাদের জন্য করা হল? এ দ্বার পার হয়েই কি আমাদেরকে যেতে হবে দেবতা কেনোর বাড়িতে।
আরো নিকটবর্তী হলে আমাদের বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা লোপ পেল। গুঞ্জন পরিণত হল গর্জনে, বাতাস রূপ নিল ঘন কুয়াশায়। তখনও কিছু ভিজিবিলিটি ছিল। জাহাজটি একটু ডানে টার্ন নিয়ে বৃত্তের কেন্দ্রে রওনা দিল। রংধণু পার হয়ে গেছি, না বাতাসে মিলিয়ে গেছে বুঝতে পারলাম না।
ডেকের উপর আমরা সব পর্যটক মন্ত্রমুগ্ধের মতো জলপ্রপাতের দিকে তাঁকিয়ে আছি। তারপর কুয়াশাযর ভিতর জাহাজ ঢুকে পড়ল। তখন মনে হল যেন সবাই ম্যাজিক কার্পেটে ভেসে বেড়াচ্ছি। এখনে জলকণা বৃষ্টিপাতের মত ফোটায় ফোটায় তীব্র গতিতে পড়তে লাগল, আর গর্জন শোনা যেতে লাগল বজ্রনিণাদের মতো। কিছুই আর দৃশ্যমান রইল না, প্রচন্ড শব্দের মাঝে পৃথিবীর সব শব্দই হারিয়ে গেল। অস্তিত্ব রইল শুধু জলধারার!
উপজাতিদের কথা মনে পড়ে গল। পৃথিবীতে বজ্রের দেবতার বাসস্থান নির্ধারণের জন্য নায়াগ্রা জলপ্রপাতের চেয়ে উপযুক্ত জায়গা আর কি হতে পারে? আমি অন্তত দেখি না। নিশ্চয়ই তাঁদের কোন এক সাহসী পুরুষ শতশত বছর পূর্বে, তাঁর ছোট্ট ক্যানয় নিয়ে নায়াগ্রার এ কানাডিয়ান অংশের ভিতর এসেছিল। শুনেছিল ভয়ংকর গর্জন, ডুবে গিয়েছিল তার কেনোখানি। তারপর কোনরকমে সাঁতরে সে তীরে এসেছিল, বলেছিল তার অভিজ্ঞতার কথা। আর সেখান থেকেই ধীরে ধীরে তাদের মাঝে জন্ম নেয় দেবতা, ‘কেনো’র গল্প। সেই সাহসী পুরুষের বুকের ছাতি নিশ্চয়ই ছিল সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক বিশাল!
Leave a Reply