১০. ০৫. ২০২৩ইং
সমাজ বাস্তবতার কবিতা
—–হারুন-অর-রশিদ মজুমদার
নব্বইয়ের দশক। খুব বেশিদিন আগের কথা না। সেসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুপুর বেলাটা ছিল মিছিল-শ্লোগানে মুখর। বন্ধ ব্যাতিত নিত্যদিন।
একদিকে চলতো সংখ্যায় গুরুর,”সিকিম নয়,ভুটান নয়,এদেশ জিয়ার বাংলাদেশ”।
অন্যদিকে কেবল ধ্বনিত হতো সংখ্যায় সীমিত’র,”জয় বাংলা,জয় বঙ্গবন্ধু”।
আরেকদিকে চলতো গুটিক’য়ের,”মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক”।
শ্লোগানে-শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠতো কলা ভবনের আশপাশ,ঢা.বি কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ও মধুর ক্যান্টিন চত্বর। মধুর ক্যান্টিনে প্রত্যেক ছাত্র সংগঠনের ছিল আলাদা টেবিল-চেয়ার গুচ্ছ। সকাল থেকে সে গুচ্ছে গোল হয়ে কেবল নিজেরা নিজেরা বসা। এক গুচ্ছের সাইডে আরেক গুচ্ছের বসা নীতি বিরুদ্ধ। বহুত পুরনো রীতি। দুপুরে আলাদা আলাদা মিছিল করেও বিকেলে টিএসসিতে,বেগম রোকেয়া হলের গেইটে,হাকিম চত্বরের চায়ের আড্ডায়,ভিন্ন ভিন্ন ছাত্র সংগঠনের বন্ধুরা সবাই একাকার। কী চমৎকার! সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ যে ছিলো!!
আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের বন্ধু,এক সময়ের তুখোড় ছাত্র নেতা ও সুবক্তা,ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার এককলীন সভাপতি নজরুল ইসলাম। ছাত্র ইউনিয়নের আদর্শে বিশ্বাসী না হয়েও,শুধু নজরুলের সম্মোহনী বক্তৃতা শোনার জন্য,ছাত্র ইউনিয়নের সভাস্হল “অপরাজেয় বাংলা”-র পাদদেশ থেকে,একটু দূরে “বটতলা”-য় দাঁড়িয়ে থাকতাম।
শেখ হাসিনার গত পনেরো বছরের শাসনামল নিয়ে, ঐতিহাসিকগণ ভবিষ্যতে চুলচেরা বিশ্লেষণ করবেন। আমার দেখা প্রধান তিনটি বাঁকঃ
১.এই শাসনামলে ঢা.বি ক্যাম্পাসের,সেই সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশটা একেবারে ধুলিস্যাত হয়ে গেছে।
২.এই শাসনামলেই বহু বাম ১৮০° ঘুরে শরীরে চিকনাই জমিয়ে,চিকচিকে বুর্জোয়ায় পরিণত হয়েছেন। যেমন রাশেদ খান মেনন,হাসানুল হক ইনু,দিলীপ বড়ুয়া প্রমূখ। অন্যদিকে উগ্রবাদের প্রতীক ডান জ্বলজ্বলে নিদর্শন,চরমোনাইয়ের পীর ফজলুল করিম,মাইজভান্ডারীর পীর নজিবুল বশর প্রমূখ ৯০° ঘুরে,গিরগিটি মধ্যপন্হায় নেমেছেন।
৩.এই শাসনামলেই বেড়েছে দেশে দিল্লীর আগ্রাসনের দৌরাত্ম্য।
যাহোক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমাদের বন্ধুদের একটি হোয়াটসআপ গ্রুপ আছে। সেখানে বন্ধু নজরুল একটি কালেকটেড কবিতা ক’দিন আগে পোস্ট দিয়েছিলো। এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইদানীং এটি বেশ ঘোরা-ফেরা করছে। আমি বিশ্বাস করি এই কালেকটেড কবিতাটি হলো দ্বিতীয় পর্ব। এই কবিতার অন্তর্নিহিত আরেকটি পর্ব আছে। মূলতঃ সেটিই দ্বিতীয় পর্বের সূত্রপাত প্রথম পর্ব।
কবিতার অলিখিত সেই প্রথম পর্বটুকু আমি লিখে দিয়ে দিলাম,তার নিচে কালেকটেড দ্বিতীয় কাব্যাংশ সমেত। যে প্রেক্ষাপটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘূর্ণায়মান কাব্যাংশের উদ্ভব। আমার লিখে দেয়া প্রথম এই কাব্যাংশটুকু না পড়লে,অর্ধসত্য জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াবে। পাশাপাশি রেখে কাব্যাংশ দু’টো না পড়লে,কেবল কালেকটেড অংশ পাঠে,সম্মানিত পাঠক সোনালি অতীতের যাবর কাটবেন। অনুশোচনায় ভুগবেন। পাশাপাশি রেখে পড়লে দু’টো প্রেক্ষাপটের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হবেন। ছাড়বেন স্বস্তির নিঃশ্বাস।
১০. ০৫. ২৩
বাঁশডলা
—–হারুন-অর-রশিদ মজুমদার
–এ্যাইইই গফুর মিয়া বাড়ি আছো?
–ক্যাডায়?
–হামারা পঁচা ও বধির।
–ক্যান আইছো?
–তোমারে নায়েব মশাই ডাকতাছে।
–ক্যান ডাকতাছে?
–হেইডা কাচারিতে গেলে হুনবায়।
–হামি অক্ষণে ভাত খাইবার নাগছি।
–রাকখো তোমার খাওয়া। নায়েব মশাই তুমারে লিয়া যাইবার হুকুম দিছে।
–যায়া কও হামি ভাত খায়া,এক চিলুম তামুক খায়া আমুনে।
–কাকা,আব্বায় ত ভাত খাইবার নাগছে। কাকা,ভাত খায়া যাইবোনে।
–হ পঁচা ভাই,বধির ভাই অহনে যানছে। খাওনের বাদে হেরে হামি পাডামুনে,যান।
–না। অক্ষণে নায়েব মশাই ধরি লি যাইবার কইছে। তা নইলে কামডা বালা অয়বো না কইলাম।
–হ জমিদার মশাই ত আমাগো খোদা।
–এই পঁচা তুই ঠ্যাং ধর,হামি কল্লাত ধরি,নে চল।
–মা-গো,বাবা-গো হামার আব্বারে এইডা ক্যাম্বায় করো গো? মাইরা ফালাইলা গো।
–হায়!হায়রে!! নোকটারে দুই নোকমা শান্তিতে খাইবার দিলায় নায়রে।
–এই আনছোস গফুররে?
–জ্বী নায়েব মশাই গফুররে লিয়া আইছি।
–বাঁশে তেল মাখছোস?
–হ মাকছি। হরিদাসের সরিষার তেল। কালকা রাইতেই মাখছি।
–তরা তাইলে জানস,গফুররে কি শাস্তি ফরমান করছে জমিদার মশায়?
–জে,বাঁশ ডলা মশাই।
–তাইলে বইয়া রইছিস ক্যা? জমিদার মহাশয়ের হুকুম তামিল কর।
–ও ভাইরে পঁচা দাদারে,ও ভাইরে বধির দাদারে,মুই ত মরবার নাগছিরে। হামাগোরে এতোডা অবিচার আল্লায় সইবোনারে। লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের
কালেক্টেড কবিতাটি হলোঃ
এই সমাজঃ
-এইযে,আপনাকে চেনা চেনা লাগছে!
-জ্বী,আমি এপাড়াতেই থাকতাম,
-ও, তা কাকে চাচ্ছেন?
-না পুরোনো কাউকে দেখছিনাতো, তাই খুঁজছিলাম…
আচ্ছা,ওই বাড়িটতে সত্য থাকতো না?
-জ্বী ওটা চাতুর্যরা দখল করে নিয়েছে,কথা বলবেন?
-না থাক,আর ওই বাড়িটা?
-ওহ! বিবেকদের বাড়ির কথা বলছেন?
ওরাও নেই এখন,বাড়িটা খালি পড়ে আছে,
শুনেছি, লালসা ওটা কিনে নিবে,নিলাম হয়েছে।
-ওরা এখন কোথায় থাকে জানেন?
-কি মুশকিল! আমি কি করে জানব?
-আচ্ছা মানবিকতা আর মূল্যবোধ ওরা?ওরাও চলে গেছে?
-ওদের কথা শুনেছিলাম,
ওদিকটায় থাকত শুনেছি,এখন আর চোখে পড়ে না।
ওবাড়িতে সঠতা আর কুটচাল থাকে।
-আচ্ছা সততার কি খবর বলতে পারেন?
-কোন সততা?
-ঐযে বিবেক এর ছেলে আর সত্যের বড় ভাই।
-ওহ,আর বলবেন না,বেচারা ক্যান্সার হয়ে রোগে ধুকছে, -শুনেছি খুব অসুস্থ
মনে হয় বাঁচবে না।
-আর লজ্জা ওদের বাড়িও কি খালি?
-না না খালি কি আর থাকে?
তবে লজ্জা আর নম্রতা ওদের আর দেখি না।
ওদের বাড়িতে এখন নগ্নতা আর উগ্রতারা থাকে।
-কোন বাড়ি?
-ওইযে দেখছেন রাস্তায় ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে?
ওর নাম কাম,ওটাই নগ্নতার বাড়ি।
-আচ্ছা পাড়ার মুরুব্বী ছিল মর্যাদা আর সম্মান
তাদের সাথে একটু কাজ ছিল,
-আর বলবেন না,সম্মানকে তো অবিশ্বাস আর তার দল অপবাদ দিয়েই তাড়ালো
আর মর্যাদা? রাতের আঁধারে পালিয়ে বাঁচল।
ওই বাড়িতে এখন বিত্ত আর বৈষম্য থাকে।
-আচ্ছা হাসিদের বাড়িটা কোনটা বলতে পারেন?
-হাসি মানে আনন্দ এর বোনের কথা বলছেন?
-জ্বী জ্বী ওরাই,
-কিযে বলেন ওরাতো কবেই কান্নার কাছে বাড়ি বিক্রি করে চলে গেছে।
-কি বললেন? ভালবাসা?
-না ভাই, বিশ্বাস যেদিন মারা গেল,এরপর ভালবাসাকে কেউ দেখেনি।
ওর বাড়িতে তালা ঝুলছে।
-আচ্ছা পুরোনো কেউই কি নেই?
-পুরোনো বলতে,
ওইযে ডানে বড় বাড়িটা দেখছেন?
পাঁচ তলা? হ্যাঁ,ওটা দুঃখের বাড়ি,একতলা ছিল ।
তার পাশেই তিন তলাটায় যন্ত্রনা থাকে,দশতলা ফাউন্ডেশন করেছে।
মাঠের পাশের বাড়িটা দেখছেন?
ওটা প্রতারকদের,কুড়ে ঘর ছিল এখন দালান হয়েছে।
অবিশ্বাস ওখানে ভাড়া থাকে,
আর ওইযে পুকুরপাড়ে,ওটা অভাবের,আগের মতই আছে।
-আপনার নাম ?
-হা হা হা চিনলেন না? আমি নিয়তি,দেখননি কখনো তবে নাম শুনে থাকবেন
-আচ্ছা আপনারা কারা ভাই?
-আমি জীবন,আর ও শান্তি
-ওহো! আপনাদের জন্যইতো এতকাল অপেক্ষা করছি।
-প্লিজ আসুন,
আজ থেকে আমাদের এই পাড়াতেই থাকবেন,
কি বলছেন? কোথায় থাকবেন?
কোন বাড়িটা লাগবে বলুন,প্লিজ বলুন তবু যাবেন না।
আপনাদের খুব দরকার।
-দুঃখিত ভাই,
যেখানে,বিশ্বাস,ভালবাসা,সততা,সম্মান,মর্যাদা কেউ নেই সেখানে জীবন আর শান্তি কিভাবে থাকে!
আসি,তারা আসুক,আবার দেখা হবে…
বি.দ্র. দেখা হয় হউক,সেটা হবে তাকানো। মিলন আর হবে না। আপনারা আপনাদের মতো ভালো থাকুন। আমরা আমাদের মতো ভালো-মন্দ মিলিয়ে আছি। বেহদ্দ বোকা না,বার্তাটা বুঝি। আবেগে টুইটুম্বুর পদ্য পয়দায় ফায়দা নেই। আমাদের বসবাস গনগনে গদ্যে। আকাশে হাঁটি না। পারলে তিস্তা’র পানির প্রাপ্য ন্যায্য হিস্যাটা দিয়েন। যদি নাইবা দেন রাষ্ট্রযন্ত্রে অযচাচিত নাক গলানোর যন্ত্রণাটা অন্তত দিয়েন না। আমাদেরকে সুড়সুড়ি দিবেন না,উত্যক্তও করবেন না,সুপ্ত আগ্নয়গিরিকে জাগিয়ে তুলবেন না। প্লিজ।
Leave a Reply