প্রীতির নীরব কান্না।
কাশেম সাহেবের স্ত্রী গত হয়েছেন আট বছর আগে। বাসায় তাঁর কলেজ পড়ুয়া মেয়ে প্রীতি। মেয়ে আর বাবার সংসার। বাসার তৃতীয় সদস্য ছোট্ট কাজের মেয়ে মিনি। বার্ধক্যে এসে নানান রোগ শোকে আক্রান্ত জনাব কাশেম। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে বাসার রান্না বান্না, বাবাকে ডাক্তার দেখানো, ঔষধ খাওয়ানো, বাজার সদাই এর সবকিছুই প্রীতিকে একা সামলাতে হয়। উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিকস, হাই কোলেস্টেরলের রোগী জনাব কাশেম। মাসে অন্তত চার পাঁচ দিন ডাক্তার দেখাতে হয় তাঁকে। বাসায় ডাইনিং টেবিলে শুধু ঔষধের ছড়াছড়ি। প্রীতির বড় বোন তিথির বিয়ে হয়েছে বেশ কবছর আগে। স্বামী সন্তান নিয়ে তিথি স্থায়ীভাবে থাকেন লন্ডনে। প্রীতিকে তাই বাসার সবকিছু একাই দেখতে হয়। বিভিন্ন রোগ শোকের কারণে কাশেম সাহেবের খাবারে প্রচুর বিধি নিষেধ। ডাক্তারের পরামর্শ মতে কিছু কিছু খাবার জনাব কাশেমের জন্য একেবারেই নিষিদ্ধ। খেতে বসলে যখন ওই সমস্ত খাবার ডাইনিং টেবিলে দেয়া হয় তখন এক বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরী হয় প্রীতির জন্য। প্রিয় সেই খাবার গুলো খেতে খুব ইচ্ছে হয় বাবার। কিন্তু ডাক্তারের বারণ থাকায় ইচ্ছাটাকে দমিয়ে রাখেন কাশেম সাহেব। মনে কষ্ট পেলে ও বাবার অসুস্থতার কথা মনে রেখে প্রীতি সেগুলো খেতে দেয় না বাবাকে। ডাইনিং টেবিলের ওইসব খাবারের দিকে তাকিয়ে থেকে কাশেম সাহেব আবার ফাঁকে ফাঁকে প্রীতির চোখের দিকে ও তাকান। প্রীতি বাবার এই চাহনীর কারণ স্পষ্ট বুঝতে পারে। বাবা হয়তো মনে মনে ভাবেন এই হয়তো বা প্রীতি বলবে, কোন অসুবিধা নেই বাবা, একটু করে খেয়ে নাও। এই অল্প একটু খেলে কিই বা আর হবে? কিন্তু প্রীতি তা বলতে পারেনা। তাই খুব কষ্টে তখন আবেগ মনে চেপে রাখে প্রীতি। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হতে থাকে তার। অজান্তেই তার চোখ দুটো আদ্র হয়ে উঠে। থেকে থেকে তার দিকে বাবার এই করুন চাহনী খুব কষ্ট দেয় তাকে। দোটানায় পড়ে যায় প্রীতি। মায়ের কথা তখন খুব মনে পড়ে যায় তার। ছোটকালে বৃদ্ধ বয়সে প্রীতির দাদা ও বিভিন্ন খাবারের ব্যাপারে ডাক্তারের বারণ থাকার পর ও খেতে বসলে কাশেম সাহেবের মতই এরকম আচরণ করতেন। মা তখন প্রীতিকে বলতেন, জানিস মা, মানুষ বুড়ো হলে আবারো শিশু হয়ে যায়। দেখবি আমি মরে গেলে তোর বাবা ও বৃদ্ধ বয়সে এমনই করবে। খাবার টেবিলে বসে দাদার এই করুন চাহনী দেখে ভীষণ কষ্ট পেতো প্রীতি। সবার অগোচরে তাই লুকিয়ে লুকিয়ে দাদাকে প্রিয় খাবার গুলো গোপনে খাইয়ে দিয়ে আসতো সে। দাদার মুখে তখন কি এক প্রশান্তির হাসি? দাদার এই হাসিমুখ দেখে মনটা আনন্দে ভরে যেতো শিশু প্রীতির। মাথায় পরম মমতার দুটো হাত বুলিয়ে দিয়ে দাদা তখন দোয়া করে দিতেন শিশু প্রীতিকে। বলতেন অনেক বড় হও দাদু।
আজ দাদার মত বাবার ও একই রকম করুন চাহনী তার দিকে। কিন্তু বাবার চোখের দিকে সেই তাকাতে পারে না। বাবার চোখের করুন চাহনী দেখলে সে নিজেকে আর স্থির রাখতে পারেনা। এক পলকে চোখ দুটো ভিজে আসে তার। কি করবে বুঝে উঠতে পারেনা সে। দাদার মতো বাবার জন্য ও যে তার মনে হিমালয়সম সঞ্চিত এক ভালোবাসা। কিন্তু সে আজ কঠিন এক প্রশ্নের মুখোমুখি। কে জিতবে আজ এই পরীক্ষায়? বাবার জন্য প্রীতির ভালোবাসা না নির্মম এক বাস্তবতা?
প্রতি বছর ঈদ আসলে প্রীতির বৃদ্ধ বাবাকে দেখার জন্য অনেক আত্মীয় স্বজন বাসায় আসেন। বাবার পছন্দের খাবার সহ আরো অনেক ভালো ভালো খাবার রান্না হয়ে সেদিন। মেহমানদের সাথে প্রীতির বাবাও খেতে বসেন ডাইনিং টেবিলে। আত্মীয় স্বজনদের অনেকেই তখন প্রীতির বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকেন আরে চাচ্চু, আরে দাদু, আরে খালু, আরে বেয়াই আজকে আমাদের সাথে না হয় বিসমিল্লাহ বলে একটু করে খান। ইনশাআল্লাহ কিচ্ছু হবেনা এতে। আজ পবিত্র এই ঈদের দিনের বরকতে আমাদের সবার সাথে একটু খেলে আল্লাহ চাহেত আপনার কোন অসুবিধা হবে না। সবার ক্রমাগত অনুরোধে কাশেম সাহেবের খেতে ইচ্ছে হলে ও তিনি বারবার মেয়ের চোখের দিকে তাকান। মনে মনে প্রত্যাশা করেন প্রীতি অন্তত আজ এই ঈদের দিনে সবার সামনে তাঁকে এগুলো খেতে বারণ করবে না। বাবার এই করুন চাহনী দেখে প্রীতির মনটা বিষন্নতায় ভরে ওঠে। বাবার প্রতি প্রচন্ড এক মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় তখন তার মন। প্রীতি হেসে বলে উঠে বাবা সবাই তোমাকে এত অনুরোধ করছে খেতে। অবশ্যই তুমি এগুলো খাবে। কেন খাবে না? মেহমানদের অনুরোধ রক্ষা করলে আল্লাহ ও যে খুশী হন। এই বলে প্রীতি পরম এক মমতায় বাবার প্লেটে তাঁর পছন্দের খাবারগুলো তুলে দেয়। নিজ হাতে বাবাকে আজ খাইয়ে দেয় সে। বাবার মুখে তখন নিষ্পাপ শিশুর মত এক হাসি। এক স্বর্গীয় অনুভূতি ভর করে তখন প্রীতির মনে।
প্রীতি ভাবে আজ সে হারেনি। তার ভালোবাসার জয় হয়েছে আজ। প্রীতি তখন মনে মনে ভাবে এমন যদি হতো আজকের মত প্রতিটি দিনই জয় হতো তার এই ভালোবাসার। ভাবে আজকের মত প্রতিটি দিনই যদি হয়ে উঠতো বাবা মেয়ের জন্য ভালোবাসা, মায়া মমতা আর প্রাণস্পন্দনে ভরা হাসিখুশি এক গৃহকোণ।
টরন্টো, কানাডা থেকে।
মোঃ আওরঙ্গজেব চৌধুরী।
২৮ আগষ্ট ২০২৩।
রাত সাড়ে এগারোটা।
Leave a Reply