চৈতী হাওয়া
পর্ব-৫০
প্রকৃতি থেকে ক্রমশ শীত বিদায় নিচ্ছে। রুক্ষ হয়ে উঠছে চারিপাশের প্রকৃতি। এর মধ্যেই অধিকাংশ গাছপালা তাদের পুরনো পাতা পাল্টে ফেলছে। আম, জাম,গাব,কড়াই, বকুল গাছ সহ অনেক গাছে রংবেরঙের নতুন পাতা চিকচিক করছে। শুধু যেসব আম গাছে মুকুল এসেছে তারা আছে পুরনো পাতা নিয়েই। আমের “কুসুমিত মঞ্জুরী” ঘিরে ভ্রমরের দল ঘুরে ঘুরে গান করে। মুকুল এসেছে আরও অনেক গাছে। জাম,কড়ই, ছাতিয়ান, হিজল প্রভৃতি। ছাতিয়ান ফুলের ঘ্রাণে মন মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। গাছেরা সব নতুন পাতার সঙ্গে তাদের আগামীর সম্ভাবনায় বিকশিত হচ্ছে। চারদিকে চলছে সৃষ্টির একটি নীরব আয়োজন।
ঝরাপাতা গাছের নিচে পুরু হয়ে বিছিয়ে থাকে। গায়ের বউ ঝিরা ঝুড়ি আর চটের বস্তা নিয়ে সে সব পাতা ঝাড়ু দিয়ে নিয়ে আসে। এ-সব শুকনো পাতা তারা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে। জয়গুনের মনে আছে তারা পাতা কুড়াতে যেতো বিভিন্ন ভিটায়,জঙ্গলে। তারা একসঙ্গে ৩/৪ জন যেতো। বলা তো যায়না কখন কোন হার্মাদের হাতে পড়ে যায়। বদখাসলত লোকের লোলুপ দৃষ্টি থেকে বাঁচতেই এ ব্যবস্থা। এমনতরো বিপদে পড়ার অনেক কাহিনি লোকজনের মুখে মুখে ফেরে।
এক উদাস দুপুরে জয়গুনের দৃষ্টি চলে যায় দীঘির পশ্চিম পাড়ের বড়ো মান্দার গাছটার দিকে। দূর থেকেও দেখা যায়,গাছটি আগুনের মতো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। শিমুল গাছটাকে জয়গুনের বড্ড আপন মনে হয়। কত স্মৃতি সোনা ভাইদের শিমুল গাছটাকে নিয়ে। অজস্র লাল টকটকে ফুলে ছেয়ে থাকা গাছে কত পাখ পাখালিরা আনন্দে কিচির মিচির করে। বুলবুলি,শালিক আরও নাম না-জানা পাখিরা এসে ফুল থেকে মধু খায়। তাদের পায়ের ছোঁয়ায় কিছু কিছু ফুল ঝুপঝাপ করে নিচে পড়ে। পাড়ার ছেলেমেয়েরা সে ফুল কুড়িয়ে মালা গাঁথে। জয়গুনের মনে পড়ে হালিমা, ময়না, আমেনা, খোদেজা,রহিমারা কাড়াকাড়ি করে সে ফুল কুড়িয়ে কোরচ ভর্তি করে ফেলতো। তারপর “আমগুরুজের” লতা দিয়ে চলতো মালা গাঁথা। জয়গুন কিছু সময়ের জন্য আনমনা হয়ে পড়ে। কেন যে শৈশব কালটা হারিয়ে যায়!
মতিয়ার,আতিয়ার দুই ভাই দুপুরের আগ দিয়ে দীঘিতে কিম্বা পাশের মা’ঝে মিয়াঁর পুকুরে চলে যায় হাতড়িয়ে মাছ ধরতে। পানি কমে আসায় এখন হাতড়িয়ে মাছ ধরা চলে। অল্প সময়ের মধ্যে খয়রা,রয়না,পুঁটি, কই,টাকি মাছে তাদের কুহ্নো ভরে আসে। মাছ ধরা শেষ হলে মতিয়ার মাছের পাত্র নিয়ে বাড়ির পথ ধরে। আতিয়ার থেকে যায় ভিজে কাপড় নিয়ে। সে তা’জের ভিটের সবচেয়ে বড়ো বরই গাছটায় উঠে পড়ে। এই বরই গাছটার বরই স্বাদে সেরা। মগডালের বরইতে সবে পাক ধরেছে। আতিয়ার কোরচ ভর্তি করে বরই পাড়ে। বরই গাছ থেকে নেমে পাশের কাঁটাঝোপ থেকে কিছু ডেঙ্কুরও তুলে নেয়।
বরই আর ডেঙ্কুর নিয়ে আতিয়ারের একটা গোপন উদ্দেশ্য আছে। সে খেয়াল করে দেখেছে তার “মা’জে বাবি” অজেদ চাচাদের তেঁতুল গাছের তলা থেকে তেঁতুল কুড়িয়ে এনে চুপিচুপি চুকচুক করে তেতুল খায়। সে শুনেছে মা’য়ে মানুষ পোয়াতি হলে “চুহো” জিনিস খেতে পছন্দ করে। বাড়ির লোকজনের ফিসফিসানি থেকে সে জেনেছে তার মা’জে বাবির সন্তান হবে। তার বিশ্বাস বরই আর ডেঙ্কুর পেলে তার বাবি খুব খুশি হবে। সে বুদ্ধি করে বাড়ি ফেরার পথে দীঘির পাড়ের হুজুতুল্যার জমি থেকে কয়গাছা “ধুনে” পাতাও ছিড়ে নেয়।
বরই আর ধনের পাতা পেয়ে জয়গুনের খুশির সীমা নেই । সে তখনই পাটাপুতো ধুয়ে বরই ছেঁচতে বসে যায়। আতিয়ার দূরে বসে তার বাবির খুশির আতিশয্য উপভোগ করে। সে তৃপ্ত-তার পরিশ্রম সার্থক হয়েছে। আতিয়ার কখনও পশ্চিম পাড়ায় গেলে ছব্দুল সেকের বাড়ি থেকে কয়েকটি কামরাঙা পেড়ে আনে। কামরাঙা জয়গুনের পছন্দের ফল। ভাবিকে খুশি করার আতিয়ারের এই প্রাণান্তকর চেষ্টায় জয়গুন খুশি হয়। জয়গুন জানে তার এই দেবরটা তাকে খুব পছন্দ করে আর তার মনটাও খুব ভালো। সে মনে মনে প্রার্থনা করে আতিয়ার যেন খুব ভালো মনের একটা বউ পায়।
রাতে বিছানায় শুয়ে জয়গুনের সঙ্গে খালেকের টুকটাক কথা হয়-
“আচ্চা, কও দেহি এ পাড়ায় সবচা’য়ে বড়ো পালা মানে খ্যাড়ের পালা আর চোতেলির ভূষির পালা কাগেরডা সবচা’য়ে বড়ো।”
“এ আবার কি কতা? চোক বোন্দ হরে এ্যাহ্নেই কবার পারি-মুনশি বাইগেরডা সবচা’য়ে বড়ো। তারপরেরডা মুজাম বাইগের। তিন নম্বরেরডা মনে কয় আমাগেরডা।”
“তুমি মনে কয় টিক কও নাই। তিন নম্বরডা ছনু ভাইগের। আমাগেরডা চার নম্বরে। পালার কতা কি জন্যি জিজ্ঞেস হরলাম কও দেহি?”
“কি জন্যি?”
“বাইরেত্তে মানষি পালা দেহে বাবে এরা কতো বড়লোক। তুমি চাওনা আমাগের বাড়ি বড়ো বড়ো পালা থাহুক?”
“চাইতো। নিচ্চয়ই চাই।”
“তুমি যহন চাও তহন এগ্দিন আমাগের বাড়িতিও বড়ো বড়ো পালা থাকপি।”
খ্যাড়ের পালা নিয়ে জয়গুনের একটা স্মৃতি মনে পড়ে যায়। সে কথা মনে পড়লে ভয়ে এখনো তার গা শিউরে ওঠে। ছোট বেলা একদিন সখিরা মিলে “পলাপলি” খেলার সময় সে মোল্লা বাড়ির একটা খ্যাড়ের পালার পাটাতনের নিচে পালাতে যায়। সেখানে একটা মুরগী তার একপাল বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে আগে থেকেই বসে ছিলো। একটা ফোঁস ফোঁস আওয়াজ পেয়ে জয়গুন পিছনে তাকিয়ে দেখে তার থেকে মাত্র কয়েক হাত দূরে একটা গোখরো সাপ ফনা তুলে দাঁড়িয়েছে। সেই দৃশ্য দেখে পড়িমরি করে পালার নিচে থেকে সে বেরিয়ে আসে। জয়গুন বুঝতে পারে অল্পের জন্যে সে বেঁচে গেছে। সে আরও বুঝতে পারে মুরগির ছাও ধরাই ছিলো সাপটার মূল উদ্দেশ্য। জয়গুন হঠাৎ করে সেখানে আবির্ভূত হওয়ায় সাপটি তাঁকে শত্রু বিবেচনা করে এবং ভয় দেখিয়ে সরিয়ে দিতে চায়। পরে দুই বাড়ির লোকজন মিলেও সাপটির হদিস করতে পারে নাই। কারণ, তার পালানোর জন্য মোল্লা বাড়িতে রয়েছে পুরাতন ইটের অনেক স্তুপ।
(চলমান)
(অসুস্থ শরীরে লেখা। ভুলত্রুটি মার্জনীয়।)
Leave a Reply