১০.১০.২০
“জ্ঞানতাপস”
—-হারুন-অর-রশিদ মজুমদার
সপ্তম অধ্যায়
এক.
পলাশীর যুদ্ধ সবে শেষ হলো। মুর্শিদাবাদের নবাব কে? ইংরেজ নাকি মীরজাফর? তা নিয়ে মুর্শিদাবাদে তো বটেই,বাংলা বিহার উড়িষ্যার জনমনে ও সর্বমহলে একই প্রশ্ন। ঠিক এই সময়ে পুরো সুবে বাংলা জুড়ে আলোড়িত হলো,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানতাপস অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক,দিল্লীর সম্রাট আকবরের অর্থানুকুল্যে ভারতবর্ষের উজিরে আজম বৈরাম খান এর সহযাত্রী হিসেবে,আগামী হজ্ব মৌসুমে হজ্জব্রত পালন করতে,এই বছরই পবিত্র হজ্বে গমন করবেন। লোকমুখে শুনে ও লোক মারফত খবর পাঠিয়ে,খবরের সত্যাসত্য নিশ্চিত হলেন মহতাব চাঁদ জগৎশেঠ।
এক শুভদিন দেখে জ্ঞানতাপস অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক এর সদয় পূর্বানুমতি সাপেক্ষে,তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছেন বিশিষ্ট ব্যাবসায়ী ও ধনকুবের মহতাব চাঁদ জগৎশেঠ। আজকাল সিনেমা,নাটক ও কিংবদন্তীর কল্যাণে অনেকেই জগৎশেঠকে,কোনো একজন ব্যাক্তি বলে মনে করেন। আসলে জগৎশেঠ উপাধি মাত্র। জগৎশেঠ কোন একজন ব্যাক্তি মাত্র নন। জগৎশেঠ একটি পারিবারিক উপাধি। যদিও পিতা মানিক চাঁদ এর মতো পুত্র মহতাব চাঁদও,মোঘল সম্রাটের কাছ থেকে জগৎশেঠ উপাধি লাভ করেন।
কাজেই পিতার জগৎশেঠ উপাধি সামনে ও নিজের জগৎশেঠ উপাধি পেছনে রেখে,নিজের নাম এভাবে লিখতে পারতেন,”জগৎশেঠ মহতাব চাঁদ জগৎশেঠ”। এমন নজির ইতিহাসে আছে। কিন্তু মহতাব চাঁদ এভাবে নিজের নাম লিখেছেন,ইতিহাসে তার কোনো প্রমান নেই। এই মহতাব চাঁদ জগৎশেঠ-ই সর্বপ্রথম,ইংরেজদের সাথেও বংশানুক্রমিক চড়া সুদের,দাদন ব্যাবসার সূচনা করেন। ইংরেজদের সাথে দহরম-মহরম গড়ে তোলেন। ইতোপূর্বে জগৎশেঠ পরিবার কেবলমাত্র ভারতীয় নবাব,জমিদার ও বড়ো ব্যাবসায়ীদের কাছে,উচ্চ সুদের বিনিময়ে টাকা লগ্নি করতেন।
এর কারণ ছিল যিনিই সেই সময়ে নবাব হতেন,তাঁর সাথে এই জগৎশেঠ পরিবারের উত্তোরাধিকার সূত্রে,দহরম-মহরম সম্পর্ক থাকার সুবাদে এই জগৎশেঠ পরিবার নবাব ও জমিদারদের মধ্যে,বিরোধ মিটিয়ে দেওয়ার মাধ্যম হিসেবেও কাজ করতেন।পাশাপাশি নবাবের কাছ থেকে জমিদারী কেনা বা বাৎসরিক ধার্যকৃত কর পরিশোধে,জমিদারদের টাকার টান পড়লে জগৎশেঠ পরিবার,চড়া সুদের বিনিময়ে জমিদারদের টাকা ধার দিতেন। কিছু বকেয়া থাকলে নবাব ও জমিদারের মধ্যে চাহিদা মাফিক সময় নিয়ে দিয়ে,উভয় পক্ষের মধ্যে একটা দফারফাও করে দিতেন।
এর মধ্য দিয়ে জগৎশেঠ পরিবার বিপুল ধন-সম্পদের পাশাপাশি,প্রভূত পরিমান প্রভাব প্রতিপত্তির অধিকারিও হয়ে উঠেন। যে প্রভূত প্রভাব প্রতিপত্তির শুরু,মহতাব চাঁদ জগৎশেঠ এর পূর্ব পুরুষ মানিক চাঁদ এর হাত ধরে। মানিক চাঁদ যখন সাবালক হয়ে পৈত্রিক ব্যাবসায় পদার্পণ করেন তখন,সুবে বাংলার মসনদে ছিলেন মুঘল বংশীয় সর্বশেষ শাসক আজিম-উস-সান। এই আজিম-উস-সান এর নামানুসারে আজকের ঢাকার আজিমপুর এলাকার নামকরন। মুর্শিদ কুলি খাঁ ছিলেন তৎকালীন মুঘল বংশীয় শাসক আজিম-উস-সান এর দেওয়ান। আজিম-উস-সান এর সময়ে বাংলার রাজধানী ছিলো ঢাকায়।
ঢাকা বাংলার রাজধানী কাজেই মানিক চাঁদ,নিজেও তার গদি ঢাকায় স্হাপন করেছিলেন। এই ঢাকাতেই মুর্শিদ কুলী খাঁ-র সঙ্গে,মানিক চাঁদ এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠে। পরবর্তী সময়ে দেওয়ান মুর্শিদ কুলী খাঁ এর সাথে,মুঘল বংশীয় শাসক আজিম-উস-সান এর সম্পর্কের টানাপোড়েন হলে,মুর্শিদ কুলী খাঁ ঢাকা ছেড়ে মুর্শিদাবাদে চলে যান। ঘনিষ্ঠতার সূত্র ধরে মানিক চাঁদও মুর্শিদাবাদে চলে আসেন মুর্শিদ কুলী খাঁ এর সঙ্গে। এটাই এই জগৎশেঠ বংশের প্রবল প্রতিপত্তিশালী হয়ে উঠার টার্নিং পয়েন্ট। পরবর্তীকালে মুর্শিদ কুলী খাঁ দিল্লীর মুঘল সম্রাটের কাছ থেকে, বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নিজামতি লাভ করেন।
ঢাকা থেকে সুবে বাংলার রাজধানী স্থানান্তর করেন,নিজ নামে গড়ে তোলা নতুন শহর মুর্শিদাবাদে। নবাব হওয়ার পর মুর্শিদ কুলি খাঁ মুর্শিদাবাদে,মানিক চাঁদ এর পরামর্শে টাকশাল স্হাপন করলে,মানিক চাঁদ হয়ে উঠেন মুর্শিদ কুলী খাঁ-র টাকশাল বিষয়ক প্রধান পরামর্শক। তিনি নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ এর সাথে,ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত হয়ে ব্যাপক ক্ষমতাধর হন। আর এই মানিক চাঁদ শেঠ এর মধ্য দিয়ে,যে প্রতিপত্তির সূত্রপাত হয় মুর্শিদাবাদ এর নবাব পরিবারে,তা অব্যাহত ছিলো মহতাব চাঁদ জগৎশেঠ পর্যন্ত।
বাংলার সর্বশেষ স্বাধীনচেতা নবাব মীর জাফর জামাতা মীর কাসিম আলী কতৃক,ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগঠিত মুঙ্গারের যুদ্ধের পর। যুদ্ধে পরাজিত মীর কাসিম কতৃক নবাবের সাথে বেঈমানীর সূত্র ধরে,নবাবের আদেশে মহতাব চাঁদ জগৎশেঠ পরিবারের সকলকে একে একে বস্তাবদ্ধ করে,নদীতে নিক্ষেপ করে হত্যা করলে এই নির্মম মৃত্যুর মধ্য দিয়ে,জগৎশেঠ পরিবারের যবনিকাপাত ঘটে।
দুই.
মহতাব চাঁদ জগৎশেঠ ইংরেজদের কাছে,বিপুল পরিমাণ টাকা উচ্চ সুদের বিনিময়ে লগ্নি করে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং ইংরেজদের সঙ্গে মিলে নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। তাই ক্ষিপ্ত নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা যখন তাঁকে,প্রকাশ্য দরবারে চড় মেরে অপমান করেছিলেন। তখন ইংরেজ বেনিয়াদের সাথে হাত মিলিয়ে,এই মহতাব চাঁদ জগৎশেঠ নিজ উদ্যোগে লর্ড ক্লাইভ,মীর জাফর,ঘষেটি বেগম সহ সকল সিরাজ বিরোধীদের সমন্বয় করে,র্পদার অন্তরালে থেকে পলাশী যুদ্ধের ট্র্যাজিডি ঘটান। ইহাই ইতিহাস। তাই মহতাব চাঁদ জগৎশেঠ এর আগমনকে,অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক ভালোভাবে নিলেননা। তিনি মহতাব চাঁদ জগৎশেঠকে দেশদ্রোহী মনে করেন।
তবু ভদ্রতার খাতিরে তাঁর সঙ্গে দেখা করাকে এড়িয়ে গেলেন না। পূর্ব নির্ধারিত বৈঠক। কাজেই অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক এর অতি ঘনিষ্ঠ সরদার ফজলুল করিম,প্রফেসর আনিসুজ্জামান,শিল্পী এস এম সুলতান,ডঃ কামাল হোসেন,আহমদ ছফা,হুমায়ুন আজাদ ও সলিমুল্লাহ খান,আগে থেকেই এসে গেছেন জগৎশেঠকে অভ্যর্থনা জানাতে। যথাসময়ে জগৎশেঠ দলবল নিয়ে হাজির,অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক এর ঢা.বি এলাকার ফুলার রোডের বাড়িতে। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক লুঙ্গি ও ফতুয়া পরে,কাঁধে একটা গামচা ফেলে বসে আছেন তার শোবার ঘরে।
লোক-লস্কর হাতি-পালকি ঐশ্বর্য প্রদর্শনের,যা কিছু অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক এর অপছন্দ,তার সব কিছুই কিছুটা দুরে নীলক্ষেত এলাকায় রেখে,জগৎশেঠ হেঁটে এসে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক এর বাংলোয় পৌঁছালে,আহমদ ছফা ও সলিমুল্লাহ খান তড়িঘড়ি করে তাঁকে নিয়ে গেলেন,অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক এর শোবার ঘরে।
মহতাব চাঁদ জগৎশেঠ অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক এর স্যাঁতস্যাঁতে প্লাস্টার খসে পড়া ঘর দেখে,তৎক্ষনাৎ অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে বললেন,”স্যার,আপনি অনুমতি দিলে আমি আহসান মঞ্জিল নামক,ইসলামপুরের ফরাসি ফিরিঙ্গিদের প্রাসাদোপম নান্দনিক কুঠিটি,ফরাসী ফিরিঙ্গিদের কাছ থেকে আপনাকে কিনে দিতে চাই। যেখানে আরাম আয়েসে আপনি জীবন কাটিয়ে দিতে পরবেন”।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক সেদিকে না গিয়ে বললেন,”অনেক দূর-দুরান্ত থেইক্কা কষ্ট কইরা আইছেন। আগে এই চৌকিটাতে এট্রু আরাম কইরা বয়েন। হেরপর আপনের পূর্ব পুরুষ,যিনি সুবে বাংলায় প্রথ্বম আইছিলেন,তার নামডা এট্রু জানলে কয়েন”।
জগৎশেঠ বললেন,”বিলকুল জানি স্যার,শ্রদ্ধেয় স্বর্গীয় হীরানন্দ চাঁদ”।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বললেন,”হীরানন্দ চাঁদ ভারতবর্ষের কোন অঞ্চল থেইক্কা সুবে বাংলায় আইছে হেইডা জানেন”?
জগৎশেঠ বললেন,”বিলকুল জানি স্যার। রাজস্থান এর জোতপুর এর নাগর অঞ্চল থেকে”।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বললেন,”আপনাগো আসল ধর্ম কোনডা? আর নকল ধর্ম কোনডা হেইডা জানলে এট্রু কয়েন”?
এই গভীর দর্জশনজাত প্রশ্নে ঘাবড়ে না গিয়ে,কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্বে না ভোগে গভীর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জগৎশেঠ বললেন,”আমাদের আসল ধর্ম জৈন ধর্ম আর,নকল ধর্ম বৈষ্ণব ধর্ম। সঠিক উত্তর দিলাম নাকি স্যার”?
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বললেন,”আপনে অতীত মনে রাখছেন। কেউ কেউ ছুডোলোক থেইক্কা বড়োলোক অইলে অতীতটা ভুইল্যা যায়। আপনে এক্কেরে মহত্বের পরিচয় দিলেন। আপনের টনটনে কাণ্ডজ্ঞান দেইখ্যা দিলখোশ অইছে। তয় জৈন ধর্মে তো জীব হত্যা মহাপাপ। তাইলে আপনে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলারে এই যে নির্মমভাবে পরাজয়ের চক আঁটলেন ও তাঁকে হত্যা করালেন,এইডা জৈন ধর্মের আচারের লগে যায়? যায় না। তাইলে কামডা বালা করছেন?
রাজস্থান থেইকা ভাগ্যান্বেষণে আপনের পূর্বপুরুষ,সুজলা-সুফলা শষ্য-শ্যামলা ঐশ্বর্যপূর্ণ সুবে বাংলায় আইছেন। ঐশ্বর্যপূর্ণ সুবে বাংলা ক্যান কইলাম? ইতিহাস কয় সিরাজের পতনের আগ পর্যন্ত সুবে বাংলার মানুষ-মেয়েরা মসলিন,জামদানী,কাতান। ছেলে-পেলে পুরুষেরা ফতুয়া,ধুতি,পাজামা,পাঞ্জাবি প্রভৃতি উন্নত মানের কাপড় চোপড় পরিধান করতো। দুধ,পনির,ঘি ছিল তাগো নিত্য দিনের আহার্য। তৎকালে ইউরোপও অতো শানশওকত পূর্ণ জীবন যাপন করবার পারতো না।
দেহেন ১৭৭০ইং অর্থাৎ বাংলা ১১৭৬ সনের আগের বচ্ছর,ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি খাজনা আদায়ের ইস্টিম রোলার চালায়। মোঘল সম্রাটের কাছ থেইক্কা দেড় লাখ ট্যাকায়,বাংলা বিহার উড়িষ্যা বিস্তৃত সুবে বাংলার মসনদ কিন্যা,কোম্পনি দেড় কোটি ট্যাকা খাজনা আদায় কইরা লইছে। তবে খাজনা আদায়ে ব্যাপক নির্যাতনের গ্যাড়াকলে পরের বচ্ছর দুর্ভিক্ষে,সুবে বাংলার তিন কোটি অধিবাসীর এক কোটিই মইরা গ্যাছিলো। যারে কয় ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। আরও দেহেন মন্বন্তরের বচ্ছর আগের বচ্ছর থেইক্কা,আরও পাঁচ লাখ বাইশ হাজার ট্যাকা বেশি খাজনা আদায় করছে কোম্পানি।
জনগণ ঐশ্বর্যশালী ছিল বইলাই তো দিবার ও নিবার পারছে। ঐশ্বর্য যদি না-ই থাকতো তয়,এতো খাজনা পাইতো কোত্থেইকা? এহেন ঐশ্বর্যপূর্ণ সুবে বাংলার মানুষের ট্যাকায় আপনেগো ঐশ্বর্য অইছে। আপনাগো গদিতে অহনে বাৎসরিক দশ কোটি ট্যাকার বাণিজ্য অয়। হেইডা কুনো সমস্যা না। সমস্যা অইতাছে আপনেরা বাংলার মানুষের ট্যাকায় ধনী অইয়া,বাংলার মানুষের ভরসাস্হল নওয়াবগো লগে গাদ্দারী করছেন পুরুষানুক্রমে। আপনের পূর্ব পুরুষ মানিক চাঁদ-কে বাংলার নওয়াব মুর্শিদ কুলী খাঁ,তাঁর একক প্রচেষ্টায় মোঘল সম্রাটের কাছ থেইকা সর্বপথ্বম “শেঠ” উপাধি আইন্যা দিছিলে। এইডা মিছা”?
জগৎশেঠ বললেন,”বিলকুল সঠিক তথ্য স্যার”।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বললেন,”মুর্শিদকুলী খাঁ-র পুত্র নবাব সুজা উদ্দীনের মাধ্যমে ও সুজা উদ্দীনের একক প্রচেষ্টায়,নিঃসন্তান মানিক চাঁদ এর পালিত পুত্র ও ভাগ্নে,আপনের পিতা ফতে চাঁদ মোঘল সম্রাটের কাছ থেইকা,সর্বপ্রথম “জগৎশেঠ” উপাধি পান। ঠিক”?
তিন.
জগৎশেঠ বললেন,”বিলকুল ঠিক স্যার”।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বললেন,”ইনি অর্থাৎ আপনের পিতা ফতে চাঁদ-ই সত্যিকারের পথ্বম জগৎশেঠ। আপনের এই পূর্ব পুরুষ ও পিতা ফতে চাঁদকে তোয়াজ না কইরা চলায়,ফতে চাঁদ চক্রান্ত কইরা নওয়াব সুজা উদ্দীনের পুত্র নওয়াব সফররাজ খাঁ-কে,অন্যান্য লোভী জমিদার গো লগে মিল্যা ষঢ়যন্ত্রের মাধ্যমে উৎখাত কইরা,আজিমাবাদ এর জমিদার আলীবর্দী খাঁ-কে নওয়াব অওনে সহায়তা করছিলো। ঠিক”?
জগৎশেঠ বললেন,”জ্বী। বিলকুল ঠিক স্যার”।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বললেন,”ভুল কইলে ধরাইয়া দিয়েন। এই পর্যন্ত না অয় মাইন্যা নেওন যায়। কিন্তু এই যে ফতে চাঁদ জগৎশেঠ এর পুত্র আপনে মহতাব চাঁদ জগৎশেঠ,নিজে পৈত্রিক সূত্রে ব্যাবসাদার। কাজেই নিজ স্বার্থে ইংরেজগো লগে চড়া সুদে দাদনের ব্যাবসা শুরু করেন। আমাগো এতে কইরা কুনো আপত্তি নাই। আপনে হীরা বাঈয়ের লগেও ব্যাবসা করবার পারেন,আমরা আপত্তি করুম না”।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক-কে থামিয়ে দিয়ে জগৎশেঠ বললেন,”বিলকুল ঠিক না স্যার। এখানটায় আমার আপত্তি আছে। এতোটা নিচে নামিয়ে দিলেন স্যার”?
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক ক্ষোভের সহিত বললেন,”কখনও আপনের মুর্শিদাবাদের বিলাসবহুল বাগান বাড়িতে,কখনও কাশিম বাজার কুঠির জমজমাট নাচ ঘরে,কখনও ঘোর বর্ষায় ভরা নদীতে চাঁদনী রাইতে,প্রমোদ তরী নামক বিশাল বিলাসবহুল পানসী বজরা নৌকায়,সারারাইত ভইরা লর্ড ক্লাইভ ও তার সাঙ্গাত সাঙ্গোপাঙ্গ গো লইয়া,হীরা বাঈ এর ঝুমুর-ঝুমুর কোমর দোলাইন্যা নাচ দেখবার পারেন। ডলাডলি করবার পারেন। ইংরেজ গো লগে বইয়া সুরা খাইতে খাইতে,বেবাক ধন-রত্ন রাইতের মইদ্দ্যে হীরা বাঈরে লেইখা দেওনের মতো মাতাল অইয়া যান। আর দিনের বেলায় হীরা বাঈ এর নাম শুনবার পারেন না,গুনাওনা অইবো।
এইডা আপনেগো বদ্দরলোকি হীনমন্যতা। মনে রাইখেন আপনে এই যে অপসংস্কৃতিডা চালু করলেন,হের লাইগাই কিন্তুক ইতিহাস আপনেরে মনে রাখবো। আপনের ধন-সম্পদ প্রভাব প্রতিপত্তির লাইগা,লোকে আপনেরে মনে রাখবো না। আপনে মহতাব চাঁদ জগৎশেঠ অইবেন,পরবর্তী কালের কলকাতার বাবু কালচারের প্রবর্তক। আপনের পথ ধইরা হাঁটছেন কলকাতার দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুররের পিতামহ,প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর সহ অপরাপর বাবু কালচারের বাবুরা। যে বাবু কালচারের প্রবর্তন আপনে করলেন মুর্শিদাবাদ থেইক্কা। কলকাতা থেইক্কা না,আমি কইয়া গেলাম”।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বলে চলেন,”আপনে মহতাব চাঁদ জগৎশেঠ পিতা ফতে চাঁদ জগৎশেঠ এর সিলসিলা রক্ষা কইরা,ইংরেজ গো লগে ব্যাবসা চালাইয়া যাইবেন,এইডা আমরা ঠেকাইবার যামু না। কিন্তু কোন আক্কেলে আপনে লর্ড ক্লাইভ,মীর জাফর,ঘষেটি বেগম-গো লগে রাইখ্যা ইংরেজ গো ক্ষমতায় আনলেন? এই যে দ্যাশের মসনদের পাদ প্রদীপের তলে,বেনিয়া ইংরাজগো বসাইছেন কামডা বালা অয় নাই। ইতিহাস আপনেরে ক্ষমা করবো? করবো না”।
মহতাব চাঁদ জগৎশেঠ বললেন,”বিলকুল ঠিক না। আপনে একতরফা বিচার করলেন স্যার। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা আমাকে প্রকাশ্য দরবারে যে,চড় মেরেছিল সে কাজটা তিনি কি ভালো করেছেন স্যার”?
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বললেন,”আমি এক চউখা বিচার করুম না। কামডা খুবই খারাপ অইছে। ঠিক। আপনে আপনের বাপের মতো প্রসাদ ষড়যন্ত্র কইরা,সিরাজ-উদ-দৌলা-রে উচ্ছেদ কইরা এই দেশের হিন্দু-মুসলমান যে কাউরে,ক্ষমতার মসনদে বসাইবার পারতেন। নিজেও ইচ্ছা কইরলে নওয়াব অইবার পারতেন। তা না কইরা এই যে খাল কাইট্টা কুম্বির আনলেন। এই যে উমিচাঁদ গো লগে রাইখ্যা আকামডা করছেন,অক্ষণে মনে রাইখবেন কুম্বির আপনেরেও সাবাড় করবো। অনেকেই মনে করেন উমিচাঁদ আপনের বংশের লোক। কিন্তু উমিচাঁদ এর আদি নিবাস কই হেইডা জানেন”?
জগৎশেঠ বললেন,”বিলকুল জানি স্যার। পাঞ্জাব”।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বললেন,”হুনেন আপনে চোউক-কান খোলা,খোঁজ-খবর রাইখা চলা,বুদ্ধিমান কুনো সন্দ নাইক্কা। তয় উমিচাঁদ অইলো এক মহা ফাঁপরবাজ ধুরন্ধর। আপনেরে এই হাটে বেইচ্চা অই হাটে কিনবার পারে। কেবলমাত্র নামেই আপনের লগে মিল। আপনের ত যৎকিন্চিৎ অইলেও ন্যায়নীতি আছে। যেহেতু আপনেরা বংশপরস্পরায় ধনসম্পদ এর মালিক অইছেন।
এই উমিচাঁদ নিজেই একটি বংশের শুরু বা সূত্রপাত ঘটাইবার লাগছে,আপনের পরদাদা হীরানন্দ চাঁদের মতন। কাজেই হ্যারে নিয়ম নীতির তোয়াক্কা করলে,নীতি ফিতির ধার ধাইরলে চলবো ক্যামনে? আপনি এই উমি চাঁদরে লগে রাইখ্যা,ইংরাজগো ফান্দে পইড়া-কামডা বালা করেন নাই। আপনের আর উমিচাঁদের,সাদা ছামড়ার ইংরাজগো লগে,এই সাময়িক দাদন ব্যাবসা না আবার চীরদাদন অইয়া যায়। আল্লা মালুম! ইংরেজরা যা বাড় বাড়তাছে”।
চার.
জগৎশেঠ বললেন,”স্যার আমরা ব্যাবসা বানিজ্য করি,বাণিজ্য বসতে লক্ষ্মী। আমাদের স্বার্থ তো আমাদের নিজেদেরকেই দেখতে হবে। দেশি,বিদেশি,সাদা,কালো, ইংরেজ,ফরাসি,হিন্দু,মুসলিম বাছবিচার করলে তো আমরা ব্যাবসা বানিজ্য চালিয়ে যেতে পারবো না”।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বললেন,”ট্যাকা পইসা মালকড়ি অঢেল কামাইছেন। কব্বরে লইয়া যাইবার পাইরবেন? পাইরবেন না। তাইলে ক্যান নওয়াব সিরাজরে ডুবাইয়া,ইংরেজগো গদিতে বহাইবার লাগছেন? সিরাজ তো বনিক না। ইংরেজরা বনিক। মনে রাইখেন প্রথ্বমেই ইংরেজগো টক্করটা আপনের লগেই অইবো। আপনে নিজেও বনিক বইল্যা। আপনে চাইলে ভুল কইরা ফালাইছেন”।
জগৎশেঠ বললেন,”বিলকুল ঠিক না স্যার। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা নিজের পতন নিজে থেকে ডেকে এনেছেন। আমি তো স্যার বুদ্ধি খরচ করে,নগদ টাকা বিনিয়োগ করে ব্যাবসা করছি। এতে তো কারও ক্ষতি হওয়ার কথা নয়। তাই নয় কি স্যার”?
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বললেন,”পৃথিবীতে সম্পদের পরিমাণ সীমিত। আপনের কাছে সম্পদ বেশি চল্যা গেলে অন্যদের টানাপোড়েন অইবো। এই যে ধরেন এই বোতলটায় যে পরিমাণ পানি আছে,তার থেইকা আপনে বেশি খাইয়া ফেলাইলে,অন্যদের কম খাইতে অইবো। এমন আর কি”।
জগৎশেঠ বললেন,”আলবৎ। বোতলের পানির সাথে টাকা কড়ির মিল হবে কিভাবে স্যার”?
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বললেন,”মনে রাইখেন এই বোতালটায় পানি যেমন সীমিত। তেমনি এই দুইন্যায় সম্পদও সীমিত। দুইন্যার কুনো সম্পদই অঢেল ও অফুরন্ত না”।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বলে চললেন,”আপনাগো ধনবান লোকদের থেইক্কা কেউ কেউ কয়,ব্যায় কমাইও না,আয় বাড়াও। কেউ কেউ কয়,ব্যায় কমাইয়া দিয়া আয় বাড়াইয়া দ্যাও। দুইডার কুনোডাই বালা না। যখন দ্যাখবেন আপনের হাতে গড়পড়তা সমাজের অন্যগো থেইক্কা,বেশি পয়সা কড়ি আইসা পড়ছে তখন,আপনাগো উচিত একডা সার্কিট ব্র্যাকার বসাইয়া দিয়া,আয় কমাইয়া দিয়া ব্যায় বাড়াইয়া দেওন।
সম্পদ সমাজের সবার,আপনে একাই সব সম্পদ কুক্ষিগত কইরা ফালাইলে,এইডা একটা সামাজিক অপরাধ বিবেচনা অইবার পারে। আপনে হয়তো সাফাই গাইতে কইবেন,আমি তো জোর কইরা কেউর পকেটে হাত দিয়া,কানাকড়িও লইয়া যাই নাই,বুদ্ধি খরচা কইরা কামাইছি। জ্ঞানপাপী বলতে একটা কতার সমাজে প্রচলন আছে,তার লগে মিলাইলে আপনেরা ধনকুবেররা অইবেন তাইলে বুদ্ধিপাপী। এই আপনেগো মতন বুদ্ধিপাপীরা,সমাজে বৈষম্য গইড়া উঠনের প্রধান কারিগর। নওয়াব,জমিদার,মহাজন,নায়েব,গোমস্তা এরা অইলো,আপনেগো বুদ্ধিপাপী অইয়া উঠনের অনুঘটক।
বুদ্ধিপাপী আপনেগো সুমতি অইলে,তাতে কইরা সমাজের লগে একডা সমতা আইবো। কেউ খাইবো আর কেউ না খাইয়া মরবো,সমাজে এমন অবস্থা তাইলে কুনো কালেই অইবো না। আর বর্তমান মাৎসন্যায় চলতেই থাইকলে,দেখা যাইবো এক সময় না এক সময়,যে উত্তর পুরুষ গো লাইগা অঢেল ধন সম্পত্তি রাইখা যাইতাছেন,আপনাগো সেই উত্তর পুরুষরা দ্যাখবেন একদিন ভিক্ষা করতাছে। যেহেতু আপনারা যাগোর প্রতি অবিচার করতাছেন,তাগো বুদ্ধিমান উত্তর পুরুষ,কুনো না কুনো এক সময় আপনাগো অযোগ্য অলস উত্তর পুরুষ গো,সমস্ত সয়-সম্পত্তি ভাগাইয়া নিয়া যাইবো।
এইডা ক্যান অইবো জানেন? অইবো এই কারণে,যেই বিষবৃক্ষ আপনারাই রুইয়া যাইতাছেন,হেই বিষবৃক্ষ ডালপালা ছড়াইয়া যত দিন যাইবো ততোই বড়ো অইবো। আপনারা যাগোরে চুইষ্যা সম্পদের পাহাড় বানাইতাছেন,হেরা ততই রাগে ফুঁসতাছে। হেগো মদ্যে যোগ্যতর উত্তর পুরুষ কুনো না কুনো এক কালে আইবোই। তক্ষণ হেই নীপিড়িতের উত্তর পুরুষগো হিংসার আগুনে,কুনো এক সময়ে আপনাগো অযোগ্য অলস উত্তর পুরুষগোর উপর,হেরা প্রতিশোধের লেলিহান শিখা উগরাইয়া দিয়া,জ্বালাইয়া পোড়াইয়া খাক কইরা ফালাইবো।
আরবার আমি যা কইবার লাগছি লোভ সম্বরণ করবার পারলে,সমাজে ও অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা থাকবো। মাৎসন্যায় কুনো কালেই অইবো না। অর্থাৎ সমাজে বড়ো মাছ ছুডো মাছরে গিল্যা না খাইলে,কেউ হঠাৎ কইরা আকাশেও উঠবো না। আবার ধপাস কইরা কেউ পাতালেও পইড়্যা যাইবো না। হগলতে মিল্যামিশ্যা একটা স্থিতিশীল সমাজ ব্যাবস্হা কায়েম অইবো। আমার কাছে আইছেন আমি কইছি,অহনে মাইন্যা চলবেন না ফিক্কা ফালাইবেন,হেইডা আপনেগো বিবেচনা”। (চলবে)
বি.দ্র. ইহা উপন্যাস। আদৌ কোন সাক্ষাৎকার গ্রন্হ নয়। ইতিহাস গ্রন্হ,অর্থ বা দর্শন শাস্ত্রও নয়। জ্ঞানতাপস অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক সম্রাট আকবরের অর্থানুকুল্যে ও উজিরে আজম বৈরাম খান এর ঐকান্তিক ইচ্ছায়,পবিত্র মক্কায় হজ্বে গমন করবেন। সেই উপলক্ষ্যে তাঁর সাথে দেশের বিদেশের নানান শ্রেণি-পেশার মানুষ,যারা তৎকালীন রীতি অনুযায়ী,অনেকটা শেষ সাক্ষাৎ করতে ও আশীর্বাদ নিতে এসেছেন। সাক্ষাৎপ্রাথীদের সাথে তাঁর ইহা কাল্পনিক কথোপকথন মাত্র। বর্তমান ও ঐতিহাসিক বাস্তব ব্যাক্তি ও স্হানের কিছু নাম ভিন্ন বাস্তবতার সাথে,এই উপন্যাসের কোনো চরিত্রের লেশমাত্রও সম্পর্ক নেই। এই উপন্যাসে অতীত বর্তমান ভবিষ্যত একাকার। আশা করি সম্মানিত পাঠক কালোত্তীর্ণ হয়ে,নিজ বিবেচনায় সারমর্ম হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হবেন। এই উপন্যাসের শুরু আছে। শেষ কবে হবে? আদৌ হবে কিনা? তা বলা মুশকিল। শুভেচ্চা নিরন্তর।
Leave a Reply