আমার সিগারেট ছাড়ার গল্প
(ধূমপান বিষপান নয়! পর্ব-৫)
****-
ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়ে রাত কেটে গেল অফিসে।
সকালে বাসায় ফিরে দেখি কেউ নেই। সদর দরজাটা খোলা। সবাই যথারীতি অফিসে। দরজা খোলা থাকা এদেশে নতুন নয়। সুদানে কেউ দরজায় তালা লাগায় না। তালা নিয়ে ‘বিদ্বেষ’ আছে এমন দেশের তালিকা করা হলে সুদান প্রথম দিকে থাকবে। এরকম খোলা দরজার দেশ জগতে কম আছে। তো তালা মারে না কেন? উত্তর সোজা। এদেশে চোর নেই। চুরি বিদ্যা এখনও এদের অধরা, পাঠ্যসুচীতে ঢোকেনি। তাদের কারিকুলাম বোর্ডের দূর্বলতা এই জায়গাতে একেবারে পষ্ট। অথচ চৌর্যবৃত্তিকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে সে রকম গ্রেট দেশের সংখ্যা দুনিয়ায় নেহায়েত কম নয়। সংখ্যায় বেশুমার। অতএব এরা তাদের কাছ থেকে অভিজ্ঞতা নিলেই পারে। শুধু নলেজ দরকার, আর কিছু না। এক্ষেত্রে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কালক্ষেপণ মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়! অজানা কারণে তাঁরা এ ব্যাপারে চুড়ান্ত অলস বলে মনে হল!
অথচ কী সীমাহীন দারিদ্র্য এই দেশে! দিনে মাত্র দুইবেলা খায়। বেলা এগারোটা আর সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা। শুধূমাত্র অভাবের কারণে একটা জাতি তার দৈনন্দিন খাদ্যচক্র থেকে পুরো এক বেলা বাদ দিয়ে দিয়েছে। আমি বলতাম তাস খেলার মতো করে একবেলা খাবার ‘ট্রাম্প’ করে দিয়েছে। যদিও শুনতে খুব করুণ।
সুদানের দূর্ভিক্ষ ঐতিহাসিক। মনে আছে সেই বিখ্যাত ছবিটার কথা ? একটা শকুন এক মানব ছানার পিছে পিছে হাঁটছে। কখন মরবে সেই আশায়। কী তুমুল প্রতীক্ষা তার? ছবিটা তুলে ফেললেন এক দক্ষিণ আফ্রিকান আলোকচিত্রী কেভিন কার্টার। ছবি তুলে বিখ্যাত হয়ে গেলেন ঠিকই কিন্তু বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই মরে গিয়েছিল তাঁর। তাই বছর খানেকের মধ্যেই নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন দুনিয়া থেকে। অথচ কঙ নিয়ঙ নামের সেই ছেলেটি সে যাত্রা বেঁচে গিয়েছিল। যদিও জ্বরে ভুগে মারা গেছে ২০০৭ এ। সেটা আমার সুদান মিশনে থাকাকালে।
এতো দূর্ভিক্ষ তবু চোরের বড়ই অভাব এদেশে। কী সাংঘাতিক! খার্তুমে দেখেছি রেঞ্জ রোভার, মার্সিডিজ বাসার সামনে অবলীলায় পড়ে থাকে। কেউ ফিরেও তাকায় না। অথচ দক্ষিণ এশিয়ায় একটি ছোট্ট দেশ আছে, মুখে নাম নাই বা নিলাম। অসাধারণ এক তস্কর রাজ্য। সেই দেশে এমনটা হলে গাড়ির সবকিছু খুলে নাটবল্টু সুদ্ধু গায়েব করে দিত। আর ভাল চোর হলে বড়জোর শেষ রাতে মালিককে ধন্যবাদ জানিয়ে একখানা প্ল্যাকার্ড টানিয়ে দিয়ে যেত। গৃহযুদ্ধ সুদানীদের গরীবি দিয়েছে, বুভুক্ষু করেছে, তিন বেলাকে দুই বেলায় নামিয়ে দিয়েছে কিন্তু চোর বানাতে পারেনি। আসলে চোর না হওয়ার জন্য যে অহম থাকতে হয় তা তাদের আছে।
আজ আমার রান্নার কী হবে? নিজেকেই বললাম, স্টোভ ছাড়া কোন উপায় নাই গোলাম হোসেন। মুষল ধরে বৃষ্টি চলছে। রবি ঠাকুরের ভাষায় ঘনঘোর বরষা। অতএব কেরোসিন আনতে বাজারে যেতে হবে। কিন্তু কোন জেরিকেন নেই। যাহোক হাতের কাছে প্লাস্টিকের খালি বোতল পেলাম। সেটা নিয়ে অগত্যা বাজারে গেলাম। এক খানা বিশাল নিশান প্যাট্রোল ছিল আমার। লেফট্ হ্যান্ড ড্রাইভ। লাল-সাদা রঙের এই গাড়িকে আমরা আদর করে কোকাকোলা ডাকতাম। বোতল ভর্তি তেল নিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসার পর বুঝলাম আজ ধরা খেয়েছি। এই বোতলের ছিপি কই? কোথায় গেলো সেটা?
বাইরে কলসি উপুড় করা বৃষ্টি। আর সেই রকম কাদা। ছিপি নেই, তো কী আর করা। দুই হাটুর মাঝখানে তেলের বোতল নিলাম। এবার গাড়ি চালাতে হবে। ম্যানুয়াল গিয়ারের গাড়ি চালানো একটু কঠিন। বিশেষ করে নিশানের মতো এত ভারী, হায়ার সিসির গাড়ি তো বটেই। ক্লাচ, এক্সিলেটর, ব্রেক, গিয়ার চেঞ্জিং অন্য সময় ডালভাত। কিন্তু আজ খেয়াল রাখতে হচ্ছে। যদি তেলের বোতল পড়ে যায় তো মহা সব্বোনাশ। আগুন টাগুন ধরে গেলে খবর আছে। পরে এ ঘটনা শুনে আমাদের এক শান্তিরক্ষী সার্জেন্ট ফয়সাল (বর্তমানে ইন্সপেক্টর) কারো জন্য অপেক্ষা না করেই আমাকে সুদান মিশনে বাংলার সেরা ড্রাইভার আখ্যা দিয়েছিল।
সুদানে মিশন শুরু হয়েছে কোন ধরনের ডিসআর্মামেন্ট বা অস্ত্রবিরতি ছাড়াই। বিদ্রোহী দল গুলো ইচ্ছেমতো একে-৪৭ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। একদিন বিকেলে হঠাৎ ব্রাশ ফায়ারের শব্দ। ঠা ঠা ঠা। ৭.৬২ ক্যালিবারের একখানা গুলী “মাটির পিঞ্জিরায়” ঢুকলেই ইন্না-লিল্লাহ হয়ে যাবো। সুতরাং ফ্লোরে শুয়ে পড়লাম সবাই। একটু পরে অবশ্য থামল। শুনলাম বোনের সাথে কার কী নিয়ে ঝামেলা হয়েছে, মদ্যপ ভাই এসে এলোপাতাড়ি ইত্যাদি। নানান স্ট্রেস নিয়ে এভাবেই চলছে জীবন। এর মধ্যে ওয়ান ফাইন মর্নিং দেখি সিগারেট এক প্যাকেটে এসে ঠেকেছে। তবে মালাকাল বাজারে আমি বেনসন দেখেছি। অতএব কুচ পরোয়া নেই। নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম। পরে সেই বেনসন ট্রাই করতে গিয়ে বেদনায় নীল হয়ে গেলাম। ছোটবেলার তারা বিড়ির কথা মনে পড়ল খুব। সেই বিড়ি এর চেয়ে অনেক ভাল ছিল। এটি বেনসন নামের কলঙ্ক। এই সিগারেটের ফ্যাক্টরি কোথায় জানতে পারলে গিয়ে সিলগালা করে দিয়ে আসতাম। তো এখন কী হবে? এতগুলো মাস আমার চলবে কী করে?
লোকাল সিগারেট খাওয়া সম্ভব নয় এটা বুঝতে পেরে মুষড়ে পড়েছিলাম। ভাবলাম এরকম হলে ধূমপান ছেড়ে দেবো। দেশে থাকতে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও ফেইল করেছি। তাই তেমন আশা ছিলনা আমার। কারণ সিগারেটসেবীরা এমন তামাশা প্রায়ই করে। এরকম অবস্হায় অনেকটা ক্যাজুয়ালি ধূমপান ছেড়ে দিলাম। তারিখটা মনে রেখেছি শুধু।
৪ জুন, ২০০৭।
Leave a Reply