তাল এবং লয়: সমাজ সংগঠনের পথের অনুসন্ধান!
নভেম্বর ১৬, ২০২২
নিউইয়র্ক
তাল ও লয় বিষয়টা সংগীতের একটা বিষয়। সংগীত বলতে গতানুগতিক অর্থে আমরা যা বুঝি, তার বাইরেও জীবনে অনেক সংগীত থাকে; সেটাকে বলতে পারি, শৃঙ্খলা এবং সমাজ জীবনের লয় অথবা সুশৃংখল গতি। সেই অর্থে তাল এবং লয়কে কেবলই সংগীতের ভেতর খুঁজি না, কমবেশি জীবনের অন্যান্য পর্যায়েও এই তাল এবং লয়ের গুরুত্ব খুঁজি।
সমাজ সংগঠনের পথে এর গুরুত্ব আলোচনা করার আগে তাল এবং লয় ব্যাপারে সংগীতের ব্যাখ্যাটা কি, একটু জেনে নিয়ে এর সাথে সমাজ সংগঠনের গুরুত্বকে মেলালেই বিষয়টা সহজ হতে পারে। লেখার মূল বিষয় যদিও সমাজ সংগঠনের পথের সন্ধান। সংগীতের তাল লয় বিষয়টা এখানে একটা উপমা সরুপ।
সংগীত বিশেষজ্ঞরা বলেন, গীতের আদ্যপান্তে কাল পরিবারের নিয়ম সমান রাখাকে বলে। সেই লয়কে, অর্থাৎ কাল পরিমানের তুল্যতাকে রক্ষা এবং শাসন করাই তাদের উদ্দেশ্য। সহজ কথায় গান ক্রিয়ার লয় প্রদর্শন করাকে তাল বলা হয়। সঙ্গীত বিশ্লেষকদের মতে, তালের কয়েকটা ভাগ আছে। যেমন, ক)লঘু, গুরু এবং পুলতো মানের সাহায্যে নির্ধারিত ক্রীড়া দ্বারা পরিমিত কাল। খ) কাল এক প্রকার ছন্দ। প্রচলিত সংগীতে লয় এবং মাত্রা বিশিষ্ট একটা ছন্দ রচনাকেও তাল বলে। এই রচনা বিশেষ বাণী বা বোলের মাধ্যমে রচিত হয়। বিভিন্নলয় এবং মাত্রা সমষ্টিতে নানা রকম ছন্দবৈচিত্র্যে প্রসনের তারতম্যে অসংখ্য তালের উৎপত্তি হয়। অন্যদিকে এই প্রসনের স্থানগুলিকেও তাল বলে। যেমন, সংগীত, বাদ্য এবং নৃত্য কোন না কোন তালে নিবন্ধন থাকে। তাই সংগীতে তাল একটা অপরিহার্য অঙ্গ, যার মানে তাল হচ্ছে সংগীতের প্রাণ।
সংগীত পন্ডিত অনেকের মতে, তালের কয়েকটা দিক আছে, যেমন:
১. কাল, সংগীতের নির্দিষ্ট সময় সীমাকেও বলে। কাল সাধারণত দুই ধরনের
সূক্ষ্ম এবং স্থূল।
২.মারগ: এর দ্বারা তালের মাত্রা সংখ্যা, পদ সংখ্যা, গতিভঙ্গি, তালি, খালি এবং সেগুলির অবস্থান প্রবৃত্তি সম্বন্ধে অবহিত হওয়া যায়। মারগ চার ধরনের। ধ্রুব, চিত্র বাচিক ও দক্ষিণ। এইগুলি তালের পথ পরিবর্তনের জন্য ব্যবহৃত হয়।
৩. ক্রিয়া। তাল প্রদর্শক কর্মকে ক্রিয়া বলে। এটাও আবার দুই ধরনের। সশব্দ ও নিঃশব্দ।
৪. অঙ্গ। তাল বিভাগকে অঙ্গ বলে।
৫. গ্রহ। তালের যে বিশেষ মাত্রা থেকে সংগীত আরম্ভ হয় সেই স্থানটিকে গ্রহ বলে। এটাও দুই ভাগে বিভক্ত। সম এবং বিষম।
৬. জাতি। তালের একাধিক জাতি। সংগীত রত্নাকর গ্রন্থে এর পাঁচটির কথা উল্লেখ আছে।
৭. কলা। তালের নিঃশর্ত ক্রিয়াকে কলা পাত বা পাত কলা বলে। অনেকে মনে করেন এই কলা এবং তাল সমার্থক।
৮. প্রস্তাব। তালের বিস্তারকে প্রস্তাব বলে।
আর তালের গতির নাম লয়। লয়ের গ্রহ চারটা, সম, অতীত, অনাগত এবং বিষম।
এইভাবে তাল এবং লয়ের একটা নিবিড় সম্পর্ক সম্পর্কে আমরা জ্ঞাত হতে পারি সঙ্গীত চর্চা এবং সংগীতের নানান রকম উপস্থাপনার মাধ্যমে। একইভাবে মানুষের সমাজ সংগঠনের বিষয়টা বা এই পথের সন্ধানের গুরুত্ব সংগীতের তাল ও লয় আবিষ্কারের মতই বলে মনে হয়, নিজের কাছে।
আমাদের সমাজ পরিবর্তিত হয়ে চলছে। পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। সংগীতের তাল এবং লয়, পরিবর্তন হচ্ছে এবং হয় তার চাহিদা এবং পরিবেশন উপরেও। পরিবর্তনের ভালো মন্দ যা কিছু ফল মানুষকেই ভোগ করতে হবে। যেমন সংগীত পরিবেশনায় তাল লয়ের সমন্বয় না হলে সংগীত পরিবেশন যিনি করবেন দায়-দায়িত্ব তাঁর উপর এসে পড়বেই।
এই চিন্তা থেকেই সমাজ সংগঠনের পথের অনুসন্ধানের বিষয়টা মাথায় আসলো। কিভাবে কোন পথে পরিবর্তন ঘটলে তার পরিণাম শুভ হয়, কেনই বা বিপত্তি আসে, এইসব প্রশ্ন আমাদের অনেকেরই মনে মাঝে, মাঝে ছায়া ফেলে। এরকম বড় প্রশ্নের কোন শেষ উত্তর হয়তো আশা করাটাই ভুল। কিন্তু ভবিষ্যতে এর তাল লয় নিয়ে মানুষ চিন্তা করবে এটাইত তার মনুষ্যত্বের পরিচয়। এই ভাবনাটাকেও তো হালকা করে দেখতে পারি না। এই বিষয়টা নিয়েই কিছু কথা।
মানুষের সমাজ সংগঠন সংগীতের তাল লয়ের মতোই একটা আবশ্যক বিষয়। সংগীতের তালকে যেমন আমরা সংগীতের প্রাণ মনে করি, একইভাবে সমাজ সংগঠনের সঠিক পথের অনুসন্ধান সমাজের প্রাণ খুঁজে পাওয়ার মতোই। পরিবর্তিত সমাজে পরিবর্তিত তাল লয়, ও কালের প্রস্তাব ঠিকভাবে না থাকলে, সমাজ সংগঠনের পথের অনুসন্ধানের গুরুত্ব বুঝতে পারব না।
এই কথাও সত্য যে, সামাজিক পরিবর্তনের গতিপ্রকৃতি নিয়ে কথা বলার আগে সমাজ সংগঠনের কাঠামো অথবা বিন্যাস নিয়ে কিছু চিন্তা আসে। বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠী মানুষকে নিয়ে যেসব গোষ্ঠী এবং সংগঠন গড়ে উঠেছে এর দুইটা মৌলিক রূপের কথা প্রথমেই উল্লেখ করা যায়। একটাকে বলি আত্মীয় গোষ্ঠী, অন্যটা ব্যবসায়িক সংগঠন। আত্মীয় গোষ্ঠীতে আমরা অল্পবেশি নিজেকে অন্যের ভেতর এবং অন্যকে নিজের ভেতর স্থাপন করে দেখি; অন্যের সুখে সুখ, দুঃখে দুঃখ অনুভব করি; অন্যের গর্বে নিজে গর্বিত, অন্যের অসম্মানে নিজে অসম্মানিত বোধ করি। ব্যবসায়িক সংগঠনে প্রত্যেকের পৃথক স্বার্থ, লাভ ক্ষতির পৃথক হিসাব। সেখানে সাময়িক স্বার্থে, সীমাবদ্ধ প্রয়োজনে, বিভিন্ন মানুষ পারস্পরিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়, আবার সেই কারণেই কখনো,কখনো সম্পর্ক ছিন্ন হয়। বলা বাহুল্য, এই দুইটা মৌল রূপের আশেপাশে কিছু মিশ্ররুপ দেখা যায়। যেমন ব্যবসায়িক বা বৃত্তিমূলক কারণে কিছু মানুষ একত্র হয়, তারপর বৈবাহিক বা অন্যান্য সূত্রে আবদ্ধ হয়ে আত্মীয় গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। এটাও ঠিক যে,
সম্প্রসারিত আত্মীয় ভাব যেখানে স্পষ্ট, রক্তের সম্পর্কটা তেমন প্রত্যক্ষ নয়। তবুও সুখে দুখে, উল্লাসে, বিষাদে, অনুষ্ঠানে সেখানে ব্যবসায়িক স্বার্থের অধিকারটা আত্মীয়তার বন্ধন অনুভব করা যায়। সমাজ চিন্তাবিদ অম্লান দত্ত, লিখেছেন, “সংস্কৃতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সমাজের সেই ঐক্যবদ্ধ রূপকে আত্মীয়ধর্মী বলা যায়”।
সামাজিক ইতিহাস এবং বিবর্তন সম্বন্ধে মোটা দাগে অথবা মোটা তুলিতে আঁকা দুইটা ছবি এখানে পাশাপাশি রাখা যেতে পারে। প্রথমটাতে মুল কথা এই যে, মানুষের ছোট ছোট বৃত্ত অথবা গোষ্ঠীকে নানাভাবে বৃহত্তর বৃত্তে যুক্ত করে উত্থান পতনের ভেতর দিয়ে সমাজ এগিয়ে যাচ্ছে। কয়েকটা পরিবার মিলে একটা উপজাতি, বিভিন্ন উপজাতি একত্রিত হয়ে জাতি, জাতিতে জাতিতে দ্বন্দ্ব মিলনের বন্ধুর পথ ধরে এক মহাজাতি অভিমুখে চলা আমাদের। এই বৃহত্তর মানবসঙহতি গঠনের ধারায় ভাষা ও ধর্ম তাদের ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে চলছে।
এই চলার পথে একটা তাল এবং লয় আছে যা এর অনুসারীদের উৎসাহিত করে।
সংগীত পরিবেশনার সময় প্রত্যেকেই আমরা একই কাজ করি না। কেউ সুর দেই, কেউ বাদ্য বাজায়, কেউ কন্ঠ দিই। এর মধ্য দিয়েই একটা তাল ও লয়ের সমন্বয় ঘটিয়ে সংগীতকে হৃদয়গ্রাহী করে তুলি। একইভাবে আমাদের সমাজ সংগঠনের পথের সন্ধানে আমরা সবাই সব কাজ একটাই করব এমন নয়। কিন্তু সমাজের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে সবাই এসে যুক্ত হব। আমরা যে যেখানে আছি সেখানেই নিজ নিজ সীমাবদ্ধ ভূমিকা রচনা করে নিতে পারি।
তবু মননের ধর্ম এই যে, সমগ্রের সঙ্গে যুক্ত করে খন্ড খন্ড প্রয়াসের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কেবল রাজনীতি দিয়ে একটা সমাজ বা দেশকে হঠাৎ করে উদ্ধার করা যায় না। এমন হলে সেটা হবে একরকম জাদুতে বিশ্বাস, সেখানে মননের কোন শক্তি নাই। ইতিবাচক সংস্কৃতিক এবং গঠন মূলক কাজে থেকে বিচ্ছিন্ন করে কোন বৈজ্ঞানিক অথবা নৈতিক রাজনীতি করা সম্ভব না। সমাজ সংগঠনের কার্যক্রম পদে পদে বদলায়, কোন পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা আগে থেকে রচনা করা যায় না। একটা প্রচন্ড দেশাত্মবোধ এবং সামঞ্জস্য সচেতনা সব সময়ই প্রয়োজন।
যেমন সংগীত বললে আমরা বুঝি কেবল গীতিকার নয়, সুরকার নয়, কিছু বাদ্যযন্ত্র বাজানোও নয়। প্রতিটা সংগীতের পেছনে তার তাল এবং লয়ের একটা সমন্বয় থাকতে হবে। তা না হলে সংগীতকে আমরা “নয়েজ” বলবো, তাল ও লয়ের সু মিশ্রণে গীত বলবো না।
মানব সমাজ সংগঠনের পথের সন্ধানের বিষয় আরো অনেক ব্যাপক। যাদের সাথে আমাদের প্রত্যক্ষ সংযোগ তাদের ভিতর দিয়ে উপরন্ত বিশ্বের উদ্দেশ্যেও আমরা কিছু কাজ করতে পারি। সহযোগের প্রত্যেকটা বৃত্তই কোন বৃহত্তর বৃত্তের সাথে যোগাযোগের সেতুবিশেষ। সমাজ গঠনের এটাই স্বাভাবিক নীতি। অসংখ্য পল্লী নিয়ে ক্রম সম্প্রসারিত বৃত্তে গঠিত এক মন যুক্তরাজ্য মানুষের এক বৃহত্তর সমাজ। অন্তত সমাজের একটা আদর্শ রূপের সন্ধান পাই আমরা সেখানে। অর্থনীতি হোক, রাজনীতি বা সাংস্কৃতিক হোক। আদর্শ সমাজ সংগঠনের এই মূলনীতি আমাদের অনুপ্রাণিত করে।
ভারতে গান্ধী তার কাম্য মানব সমাজের পরিচয় দিতে গিয়ে oceanic circle ‘র কথা বলেছিলেন। “মহামানবের সাগর তীরে” কথাটা রবীন্দ্রনাথের। পল্লীর নীড় থেকে মহামানবের সাগর তীর পর্যন্ত সমাজ গঠনের একটা ছবি মনে মনে রচনা করে নেয়া যায়। গান্ধীর ভাষায় চিত্রটা এইরকম। ” In this structure composed of innumerable villages, there will be ever- widening, never ascending circles… It will be an oceanic circle whose center will be the individual” ( প্রবন্ধ সংগ্রহ, অম্লান দত্ত, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৯৩). এখানে “never ascending” কথাটার ব্যবহার লক্ষ্যণীয়।
মানুষের সমাজকে যখন আমরা মূলত শ্রেণীবিভক্ত রূপে দেখি তখন বলা যায় যে শত্রু শ্রেণীর ধ্বংসই আমাদের কাম্য। কিন্তু সমাজকে যখন আমরা অসংখ্য আত্মীয় গোষ্ঠীর যুক্তরাজ্য বলে অনুভব করি তখন বৈরী গোষ্ঠীর উৎখাতের চিন্তাকে প্রাধান্য দেয়া শুভ বুদ্ধির পরিচয় বলে মেনে নেয়া যায় না। অথচ সমাজে অন্যায় আছে, অবিচার আছে, এর প্রতিরোধের প্রয়োজন আছে। গান্ধী মনে হয় প্রতিরোধের সেই পদ্ধতি খুঁজেছেন যাতে মানুষের মৌল আত্মীয়তা বোধকে অক্ষুন্ন রেখেই অন্যায়ের অটল বিরোধিতা করা যায় এবং সাম্যের দিকে অগ্রসর হওয়া যায়। সময় এবং পরিস্থিতির পরিবর্তনের সাথে সাথে এই পদ্ধতির পরিবর্তন অবশ্য কর্তব্য।
একটা সুশৃংখল সুর, তাল, লয় মিলিয়ে “ইনক্লুসিভ”; সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে আমাদের মধ্যে অমিলের সংগীত না গেয়ে সংগীত বা গীতের ব্যাকরণ সম্মত কাল, অঙ্গ, জাত এবং ছন্দ সঠিকভাবে সন্ধান করে নিতে পারি, তাহলে সমাজ একটা শান্তিপূর্ণ সহবাসের পল্লী হতে পারে। ক্ষনিকের শ্রেণী স্বার্থের রাজনীতির
পরিবর্তন করতে হলে সমাজে আমাদের বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে একটা আত্মিক এবং আদর্শিক ঐক্য গড়ে তোলা সত্যিকার অর্থে সমাজ সংগঠনের সন্ধানের পথে ইতিবাচক পদক্ষেপ হবে।
Email. mahmud315@yahoo.com
Leave a Reply