অত্যাচারী প্রানীর গল্প !
(১)
ছোটবেলা থেকে বাগান করা আমার একটি প্রধান শখ। কানাডা সহ উত্তর আমেরিকার সর্বত্র আমার মত হাজার হাজার সৌখিন বাগানি (Gardener) ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। গ্রীষ্মকাল আসলেই আমার মতন সকল বাগানিদের তৎপরতা শুরু হয়ে যায়। যারা এপার্টমেন্টে থাকেন তারা বারান্দার টবে গাছ লাগান, যারা হাউসে থাকেন তারা ব্যাক ইয়ার্ড ও ফ্রন্ট ইয়ার্ডে গাছ লাগান; আবার কেউ কেউ সিটি থেকে লীজ নিয়ে সরকারের বরাদ্দকৃত জায়গায় অনেক বিশাল বাগান করে ফেলেন।
কানাডা ও আমেরিকায় গ্রীষ্মকালে যারা বাগান করেন তারা সবাই দুই অত্যাচারী প্রানী রেকুন (Racoon) ও কাঠ বিড়ালী (Squirrel) এর সাথে কমবেশি পরিচিত। রেকুন একটি ভয়ংকর ও ক্ষতিকর প্রানী। সব বাগানিরা এদের ভয় পায়। সেই অর্থে কাঠ বিড়ালী এতটা ভয়ংকর নয়। এরা বাগানে গিয়ে কিছু ফলমূল খেয়ে ফেলে বা বাগানের ছোটখাট ক্ষতি করে থাকে।
গত বছর আমার ব্যাক ইয়ার্ডে বেশ কিছু লাউ গাছ রোপণ করেছিলাম। এক একটি গাছে অন্ততঃ ১০/১২ টি ছোট লাউ ধরেছিল।
আমি মনের খুশিতে বাকবাকুম করতে লাগলাম।
সকাল বিকাল পানি দিতাম আর ভাবতাম, আমার সাধ পূরণ হয়ে গেছে।
বাগানে আসলেই গাইতাম-“সাধের লাউ, বানাইলি মোরে বৈরাগী”।
কিন্তু রেকুন আমার অতি সাধের কয়েকটি ফলন্ত লাউ গাছের গোড়া (Root) কেটে দিয়েছিল।
সেই রেকুন আমার লাউ গাছ কেটে ক্ষান্ত হয়নি। ৬ জনের পুরা পরিবার নিয়ে রেকুন মা বাবা আমার লাউ গাছের মাচানের উপর ঊটে নাচানাচি করত আর সেখানে বসে দল বেঁধে নিয়মিত আড্ডা দিত।
আমার বাচ্চারা লাঠি নিয়ে তাড়া করতে গেলে রেকুনরা জায়গা ছেড়ে যাওয়া ত দুরের কথা, এতে এরা আরও ভীষণ চটে যেত; আর ভেংচি দিয়ে উল্টা বাচচাদের কাছে দাঁত খিঁচিয়ে তেড়ে আসত ও অদ্ভুত শব্দ করে ভয় দেখাত।
আবার কিছু কিছু গাছ , যেমন টমেটো, মরিচ ইত্যাদি টেনে মাটি থেকে উপরে ফেলত। তাছাড়া, আমার গ্যারেজের (Garage) উপরের ছাদের সব গোলাপ ফুলের টবগুলো এরা ফেলে দিয়েছিল।
অর্থাৎ এক কথায়, এই রেকুনগুলো আমার জীবনকে অতিষ্ট করে তুলেছিল। এদের যন্ত্রণায় আমার এত কষ্টের বিনিময় অর্জিত শখের বাগান ধ্বংস হতে চলছিলো।
তাই আমার বাগান থেকে রেকুন সাম্রাজ্যর পতন ঘটানোর নানা উপায় খুঁজতে লাগলাম।
এরপর গুগল (Google) আর ইউটিউব (YouTube) ঘেঁটে বেশ কিছু পরামর্শ পেলাম আর এগুলো প্রয়োগ করতে লাগলাম। কিন্তু কোন পরামর্শই পুরাপুরি কাজে আসলো না । ভিনিগার মেশান পানি লাউ গাছের মাচানের আশে পাশে ছিটালাম। এছাড়াও রসুন মিক্স করে পানি ছিটিয়ে মাচানের আশে পাশে ছিটালাম। ভরসা, যদি গন্ধে এরা যায়।
তবে রসুন মিক্স পানি ছিটিয়ে কিছুটা উপকার পেয়েছিলাম। এতে অত্যাচারের মাত্রা কমলেও আমার ব্যাক ইয়ার্ড – এর ১০০ বছর পুরানো সিল্ভার মাপল (Silver Maple) গাছের বড় বড় ডালের উপর এরা দলবেঁধে বসে থাকতো। কিছুতেই এরা বাগান ছাড়তে রাজি নয়। এটা তাদের সাম্রাজ্য। আমি কে?
কি ভয়ংকর অভিজ্ঞতা, বাপরে বাপ!
(২)
এরপরে আসি কাঠ বিড়ালী প্রসঙ্গে। কাঠ বিড়ালী দেখলেই আমার ছোটবেলার প্রিয় কবি নজরুলের লেখা একটা ছড়ার কথা মনে পড়ত।
“কাঠ বিড়ালী , কাঠ বিড়ালী পেয়ারা তুমি খাও? গুড়মুড়ি খাও?……………”
আমি এমনিতেই বিড়াল ভক্ত মানুষ । তাই বাগানে এদের আগমন আমার ভাল লাগত। কাঠ বিড়ালীগুলো ফ্রন্ট ইয়ার্ড ও ব্যাক ইয়ার্ড -এর সর্বত্র ছোটাছুটি করত। তাই এদের এসব কর্মকাণ্ড আমার খুব ভাল লাগত।
কিন্তু একদিন হঠাৎ দেখলাম, এরা আমার গাছের অনেকগুলো টম্যাটো অর্ধেক অর্ধেক করে খেয়ে, রেখে গেছে। মানে বাকি অর্ধেক আমার জন্য রেখে গেছে। তাছাড়া, আমার অনেকগুলো মরিচ গাছ ভেঙ্গে ফেলেছে। অর্থাৎ আদর করে পেয়ারা আর গুড়মুড়ি দেবার আর দরকার হয়নি আমার।
আমি ওদের মাফ করে দিলাম। আর মনকে সান্তনা দিয়ে বললাম, ওদেরও ত খাবার দরকার আছে। তাই ওদের ব্যাপারে তেমন কষ্ট পেলাম না। কারন এই ক্ষতির পরিমান ছিল রেকুনের ভয়াবহতার চেয়ে যৎসামান্য।
(৩)
কিন্তু সেই ভয়ংকর রেকুন নিয়ে আমি খুবই দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। কতোবার গুগল আর ইউটিউব ঘাঁটাঘাঁটি করলাম। কোন কিছুই কাজ করছিল না। কত জ্ঞানীগুনী বন্ধুদের দ্বারোস্ত হলাম কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না।
পরিশেষে, আমার কোন এক বন্ধু বলল-“ প্রতিটি গাছের গোঁড়ায় কাঁটা চামচ উল্টা করে পুঁতে দাও আর নেট দিয়ে বেড়া দিয়ে দাও। কাজ হবে। আর লাউ গাছের মাচানে ডলার স্টোর থেকে কাঁটাওয়ালা প্রতিরোধক কিনে লাগিয়ে দাও। “
আর কারন হিসাবে বলল-“ যখনই রেকুন ও কাঠ বিড়ালী গাছের কাছে আসবে বা লাফালাফি করার চেষ্টা করবে, তখন ওদের পা আর পশ্চাৎ দেশে কাঁটা চামচের ঘা লেগে পিছু হটবে।“
আমি সাথে সাথেই ডলার স্টোর -এ গিয়ে ডিসপোসাবল কাঁটা চামচ ও কাঁটাওয়ালা প্রতিরোধক কিনে নিয়ে আনলাম। আর এই পদ্ধতি প্রয়োগ করলাম। এতে ভাল ফলও পেলাম।
এরপর থেকে দেখি কাঠ বিড়ালী গাছের ধারে কাছেও আসেনা। তবে রেকুন লাউ গাছের আশেপাশে ঘরাঘুরি করত কিন্তু নতুন করে তেমন কোন ক্ষতি করতে দেখিনি।
যারা বিশেষজ্ঞ কৃষিবিদ আছেন, তারা যদি রেকুন তাড়ানোর এর চেয়ে আরও কোন ভাল পরামর্শ দিতেন তাহলে আমার মত হাজারো সৌখিন বাগানির আনেক উপকার হত। আশা করি এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ কৃষিবিদগণ তাদের মূল্যবান পরামর্শ দিয়ে এই সমসার চিরস্থায়ী সমাধান দিবেন। এবারও গ্রীষ্মকাল এসে যাচ্ছে, তাই অত্যাচারী প্রানী রেকুন নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তায় আছি।
দারুন!!!
ধন্যবাদ