একটা জড় বস্তুর আত্মকথা (২)
কমলকলি
এরপরে বছর পাঁচেক আগে শীতের মৌসুমে মিসেস রুমানা একাই বাংলাদেশে গিয়েছিলেন। আমাকে উনি অনেক যত্নের সাথে সুটকেসে অন্যান্য কাপড়ের মধ্যে নিয়েছিলেন।তাকে বলতে শুনেছি,” কার্ডিগানটা লম্বা জার্নিতে পরবো না। ময়লা হতে পারে। দেশে খুব শীত পরলে তবেই গায়ে দেব। ভারি সুন্দর জিনিসটা। “
বলেই তার স্বভাব সুলভ মধুর হাসিতে মুখখানি ভরে তুলেছিলেন। আর তার স্বামী বলেছিলেন, ” ধন্য তোমার মেড ইন বাংলাদেশের কার্ডিগান। এই আমেরিকাতে এতো বছরের পুরনো কাপড় ইত্যাদি কেউ রাখে না। পরেও না। বড় জোর দু’ বছর টানে। তারপর ফেলে দেয় । কিংবা ডোনেট করে। “
” এতো পুরনো কথা। মানুষ নাই পরলো পুরনো কাপড় “, মিসেস রুমানা তার অবয়বে যথেষ্ট গাম্ভীর্য এনে বলেছিলেন, ” আমি পরি। সবচেয়ে বড় কথা, আমার দেশের গার্মেন্টসের তৈরি কার্ডিগানটা।”
আবুল বাশার হা হা করে হেসে বলেছিলেন, ” আশ্চর্য তোমার স্বদেশ প্রীতি। “
” কেন নয়? রেগে গিয়ে ভ্রুভঙ্গি করেছেন মিসেস রুমানা।
” তুমিও কি বাংলাদেশের মানুষ নও? তোমার মধ্যে কি স্বদেশ প্রেম নেই? ” তারপরেই আবৃত্তি করেছেন “
” আমার সে দেশ, রক্ত কমল হয়ে ফুটে থাকে বুকের গভীরের নীল হ্রদে
অপরাহ্নের শাল-পিয়ালের বনবীথিকার নীড়ে ফিরে আসা পাখিদের কলগুঞ্জনে শিহরিত যেন
আমার প্রিয় দেশ ! “
এবার আবুল বাশার সত্যিই গম্ভীর হয়ে বলেছেন, ” রুমানা, মাই ডার্লিং, সত্যিই, তোমার জবাব নেই! “
বাংলাদেশে গিয়ে আত্মীয় স্বজনের বাসায় নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে শাড়ির ‘ পরে আমাকে ধারণ করে প্রায়ই মিসেস রুমানা গিয়েছেন। তার খুব ঘনিষ্ট আত্মীয় দু’ একজন, যেমন তাঁর ভাবী অথবা বড় বোনের বাড়িতে গেলেই কাছে এসে হাত দিয়ে আমার অস্তিত্ব অনুভব করেছে। প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছে। বাংলাদেশের গার্মেন্টসের তৈরি সুদূর আমেরিকার একটা স্টোর থেকে কেনা উলের কার্ডিগানটা দেখে তারা অভিভুত হয়ে গিয়েছেে।
আমি অবশ্য প্রথমে বুঝতে পারিনি তাদের অভিভূত হবার কারণ, পরে অনুধাবন করেছিলাম আসলে অনেক সময় নিজের দেশের তৈরি জিনিসের কদর দেশের মানুষ দেয় না, যেহেতু বিদেশে, তাও আবার আমেরিকার নাম করা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে কেনা, হয়তো এটাই তাদের উচ্ছ্বসিত হবার অন্যতম প্রধান কারণ। আমার ধারণা হয়তো ঠিক, হয়তো নয়। যাই হোক ।
দীর্ঘ দিন আমি এই পরিবারে থেকে বুঝেছি, মিসেস রুমানা খুব ঘরোয়া স্বভাবের মহিলা। এদেশে আসার পরে অল্প কিছুদিন বাইরে কাজ করেছেন সখের বশবর্তী হয়ে। আবুল বাশার পেশায় ইঞ্জিনিয়র। কোনো এক অয়েল কোম্পানিতে
কাজ করেন।
একটি মাত্র মেয়ে সোহানা। বর্তমানে সেও ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে ভাল কাজ করছে।
কিন্তু মাঝে মাঝেই শুনেছি সোহানাকে নিয়ে এই দম্পতির দুশ্চিন্তালাপ,হা-হুতাশ। সোহানা বলছে, আলাদা বাসা নিয়ে চলে যাবে। সময়ের চাইতে বেশিদিন নাকি সে বাস করছে বাবা-মায়ের সাথে।
( আগামীতে শেষ হবে। প্রকাশিত – সাপ্তাহিক ঠিকানা। নিউইয়র্ক।)
Leave a Reply