চৈতী হাওয়া
পর্ব-২০
ফাল্গুন মাসের শেষার্ধ। প্রকৃতি এরই মধ্যেই অনেকটা রুক্ষ আকার ধারণ করেছে।
জয়গুনদের বাড়ির উঠানে দাঁড়ালে বাঁধাহীন দৃষ্টি মাঠের অনেক দূর পর্যন্ত চলে যায়। মাঠের তপ্ত লু হাওয়ায় চষে রাখা জমির ধুলো উড়িয়ে ছোট ছোট ঘুর্ণি তৈরি করে। কখনও সে ঘুর্ণিবায়ু উড়ে উড়ে চলে আসে গায়ের বাড়িঘর পর্যন্ত। দুপুরের দিকে মাঠঘাট প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ে। তখনো দু’একজন কৃষককে বিলের দিকের জমিতে চাষ দিতে দেখা যায়। ফসলশুন্য মাঠ ধুধু করে তপ্ত রোদের উষ্ণ হাওয়ায়। শুধু দু’একটা গমের ক্ষেতে পাকা গমের সোনালি শীষ বাতাসে দোল খায়। প্রকৃতি এখন রুদ্ররূপে সাজার অপেক্ষায়।
জয়গুনদের বাড়ির অধিকাংশ আমগাছের আমের গুটি বেশ বড়সড় হয়ে উঠেছে। যেসব গাছে মুকুল আসেনি সেসব গাছ নতুন কচি পাতা ছেড়ে বর্ণিল সাঁজে সেঁজেছে। জয়গুনের মনে পড়ে-এখন সাতৈর গ্রামে তাদের বাড়ির পাশের আম বাগানের সব গাছে নানান সাইজের গুটি আম ঝুলছে। জয়গুনের বিয়ের আগের কথা মনে পড়ে। তারা ভাইবোনেরা সকাল বেলায় সেই গুটি আম কুড়িয়ে এনে লবন মরিচ মাখিয়ে খেতো। ছেলেরা ঝিনুক পাটায় ঘঁষে ঘঁষে আম ছোলার চমৎকার একটা যন্ত্র তৈরি করে ফেলতো। মেলা থেকে তারা চাকু কিনতো আর সাতৈর বাজারের মাধব ও ভীম কর্মকারের দোকান থেকে “পাগাল” দেয়া ছুরি বানাতো। এ সব আয়োজনই ছিলো কাঁচা আম কেটে খাবার জন্য। জয়গুনের ভাইয়েরা গাছতলার আমের গুটি কুড়ানো ছাড়াও ঢিল ছুড়ে কিছু আম পেড়েও আনতো। গুটিআম কাঁচা খাওয়া ছাড়াও ডাইলের মধ্যে দেয়া হতো টক ডা’ল রান্নার জন্য।
জয়গুনের আরও মনে পড়ে- মানিক সেকের বাড়ির দক্ষিণ পাশের বড়ো মান্দার গাছটার কথা। কী বিশাল বড়ো গাছটা! এ সময় গাছটা নিশ্চয়ই ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে। দূর থেকেও দেখা যায়, লাল টকটকে ফুলে ছেয়ে আছে গোটা গাছটা। দূর থেকে মনে হয় গাছটায় বুঝি আগুন ধরে গেছে। শালিক জাতীয় পাখিরা সারাদিন কিচিরমিচির করে ফুলের মধু খায়। তাদের পায়ের চাপে চোঙার মতো লাল লাল মান্দার ফুল দুপদাপ করে নিচে পড়তে থাকে। জয়গুন,তার বোন আর পাড়ার ছেলেমেয়েরা সে ফুল কুড়িয়ে আনতো। এক সময় তা আবার ফেলেও দিতে হতো। কারণ,ও ফুলে যে ঘ্রান নেই, তাই মালাও গাঁথা হয় না।
চৈত্র মাসের শেষ দিকে আর বৈশাখের প্রথম দিকে মান্দার গাছের ফুল থেকে ফল হয়। তারপর সে ফল পেঁকে ফাটা শুরু করে। মানিক সেক এর মান্দার গাছের ফল ফেটে চারপাশে তুলো ছড়িয়ে পড়ে। গাছের নিচের ঝোপঝাড় আর চষা জমিতে পুরু হয়ে তুলো জমতে থাকে। কিছু তুলো উড়ে গিয়ে আশপাশের গাছপালা,বাড়িঘরে গিয়ে পড়ে। কিছু তুলো উড়ে গিয়ে পাশের পুকুরের পানিতেও পড়ে। কারও তুলোর দরকার হলে বাঁশের লম্বা কোটা (আকষি) বানিয়ে অ-ফাটা তুলোর ফল পেড়ে নিয়ে রোদে শুকায়। মাছ ধরা জালের নিচে ফলগুলো রেখে দিতে হয়। তাতে ফাটা ফল থেকে তুলো উড়ে যেতে পারে না।
গেরস্ত বাড়ির উঠান এ সময়ে খেঁসারি, মসুর, ছোলা, মটর, তিসিতে ঠাঁসা। বাড়ির বউঝিরা ভীষণ ব্যস্ত এ সব চৈতালি ফসল ‘নিতে’। রাই, সরিষা জাতীয় তৈল বীজ এর মধ্যেই ঘরে উঠে গেছে। উঠানে সে-সব তৈল বীজের শুকনা গাছ “পালা” দেয়া আছে। এগুলো পরে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হবে।
জয়গুনদের বিশাল বড়ো উঠানে সারি দিয়ে নানা জাতের চৈতালী ফসল ‘পালা’ দিয়ে রাখা আছে। জয়গুন বিষন্ন বদনে তাদের উঠানের চৈতালি ফসল ‘নিতে’ ব্যস্ত। উঠানের মাঝামাঝি জায়গায় মসুরির বড়ো একটা গাঁদায় সে মোটা একটা লম্বা লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে। পাশে রয়েছে মটর,খেঁসারির গাঁদা। সেসব গাঁদায় পরে হাত দেয়া হবে। মসুরডাল আগে ঝাড়াপোঁছা করে ওঠানো হবে। মসুর সবচেয়ে দামী ডাল।
মসুরি গাছের পরিমাণ যা তাতে সেগুলো দিয়ে সহজেই ‘মলন’ দেয়া যেতো। কিন্তু গরু জোগাড় করা এবং গরুর পিছনে পিছনে ঘোরার ঝামেলা এড়াতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মলন এড়িয়ে মহিলাদের দিয়েই এসব চৈতালি ফসল নেয়ার কাজ করা হয়ে থাকে। মহিলারা তাই অনেকটাই গরুর বিকল্প।
দুপুরের তীব্র রোদ আর ভ্যাবসা গরমে জয়গুন হাসফাঁস করতে থাকে। অসহ্য গরমে তার সারা শরীর ঘেমে নেয়ে ওঠে। পুরো ‘বতর’ জয়গুনকে একাই নিতে হচ্ছে। তার শাশুড়ী কিম্বা সতীন এ দিকে উঁকি দিয়েও দেখে না। সে জানে এটা করা হচ্ছে ইচ্ছে করে, তার উপর মানসিক চাপ তৈরির জন্য। এটা ওদের এক ধরনের খেলা। এ খেলায় তারা পক্ষ দুটি, খেলোয়াড় তিনজন। শাশুড়ী আর পাখি একদিকে, আর অন্যদিকে সে একা। লুৎফরকে সে তার দলে আশা করে না। তবে সে অন্তত রেফারির দায়িত্ব পালন করতে পারতো। কিন্তু সবদিক বিবেচনা করে লুৎফর এ সব ‘খেলা’ এড়িয়ে চলে। সময়মতো লুৎফররা সবাই বুদ্ধিমান হয়ে যায়।
জয়গুন বৌ হয়ে আসার পর থেকেই লুৎফরদের সংসারে এ জাতীয় কঠিন কাজগুলো একাই করে এসেছে। কাজ করে সে অভ্যস্ত। আগে এ কাজে তার ক্লান্তি আসতো না। এখন আসে। কারণ, যে কাজে কোন প্রাপ্তির আশা থাকে না সে কাজ খুব ভারী হয়ে ওঠে। আগে কাজগুলো নিজের মনে হতো, এখন মনে হয়না।
জয়গুন ক্লান্ত শরীরে ধপাস করে মসুরের গাঁদার উপর বসে পড়ে। একটা ডেফল গাছের হালকা ছায়া মসুরের গাদার উপর এসে পড়েছে। জয়গুন সেই ছায়া দেখে বসেছে। সে আঁচল দিয়ে তার শরীরের সামনে, পিছনে, সারা শরীরের ঘাম মুছতে থাকে। উদ্ভিন্নযৌবনা জয়গুনের ব্লাউজবিহীন উদোম শরীর বেয়ে ঘাম নিচের দিকে গড়িয়ে যায়। বিয়ের পর তিন বছরের বেশি সময় পার হলেও সন্তান না হওয়ায় জয়গুনের শরীরের বাঁধন অটুট রয়েছে। কিছুদিন ভালো খাওয়াদাওয়া আর মনের সুখ জয়গুনের শরীরে এক ধরনের ‘জেল্লা’ এনে দিয়েছে। নারী পুরুষ সবাইকে তার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে জয়গুন বুঝতে পারে তার শরীরের জৌলুসের বিষয়টি। এমনকি যে খালেক আগে তাকে খুব একটা পাত্তা দিতো না, বাড়িতে গেলে সে-ও কৌশল করে তাকে দেখতে আসে। নিজের অবচেতন মনে চিন্তাটা জয়গুনের মনের দরজায় উঁকি দিয়ে যায়। নিজের সাথে জয়গুন মশকরা করে-
” শরীলির এই ছুরোত নিয়ে এতো ‘ভাব’ কেন তোমার, জয়গুন। কি লাভ ওলো এই সুন্দর শরীল নিয়ে। দুইজন পুরুষ মানুষ আ’লো তুমার জীবনে। একজনরে ধরতিই পারলে না, আরাকজনরে ধরেও রাকতি পারলে না। সুন্দরী ওয়ে তুমার লাবডা কি ওলো? মায়ে মানুষির খালি সুন্দরী ওলিই অয়না, সাতে আরও কিচু নাগে। সেই আর-ও কিচু তোমার নাই,জয়গুন।”
জয়গুন এ-সব ভাবে আর মুচকি মুচকি হাসে।
ডেফল গাছের ছায়াটা জয়গুনকে রেখে আস্তে আস্তে পূর্ব দিকে সরে যেতে থাকে। গায়ে রোদ এসে পড়ায় জয়গুন বসা থেকে উঠে দাঁড়াতে যায়। এমন সময় পিছনে থেকে শাশুড়ীর গর্জন ভেসে আসে-
” মিয়া বাড়ির নবাবজাদী রে। বসে বসে হাওয়া খাচ্চেন। এদিক যে বেলা পড়ে যাতেচে তারদিক খিয়াল নাই। কোন সুমায় মুসুরি নিয়া ওবেনে, আর কোন সুমায় নান্দাবাড়া ওবেনে। আমার ছাওয়ালডার আসার সুমায় ওয়ে গেলো। সে আসে খাবেনে কি?”
জয়গুন আগে শাশুড়ী বা সতীনের আক্রমণের সময় চুপ করে থাকতো, মুখ বুঁজে সব শুনে যেতো। কিন্তু সে দেখেছে এতে কোন লাভ হয়না। সে ভাবতো চুপচাপ থাকলে ওরা কিছুক্ষণ বকবক করে আপনা আপনি থেমে যাবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেলো উল্টোটা। সে জবাব না দিলে তার সতীন তার হয়ে প্রক্সি দেয়। উল্টাপাল্টা কথা বলে শাশুড়ীকে উত্তেজিত করে তোলে। উত্তেজনার তুঙ্গে ওঠা শাশুড়ী তার উপর তান্ডব চালাতো। শাশুড়ী হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে জয়গুনের বাপ মা চৌদ্দ গুষ্টি তুলে গালাগালি করতো। জয়গুন তাই বুঝে গেছে এদের সাথে ভদ্রতা করে লাভ নেই। সে শাশুড়ী ও সতীনের কথায় জবাব দেয়া শুরু করেছে। সে জানে তাকে টিকে থাকতে হলে যুদ্ধ করে টিকতে হবে। যুদ্ধটা যদিও অসম এবং তার জেতার সম্ভাবনা কম,তবুও কখনও কখনও যুদ্ধ মানুষকে শক্তি দেয়, সাহস দেয়। কখনও কখনও স্বস্তিও দেয়। এ-ই যেমন আজ,এখন।
আজ-ও শাশুড়ীর কথায় জয়গুন মেজাজ হারায়। এমনিতেই প্রচন্ড গরমে তার মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে আছে। তার উপর শাশুড়ীর কথায় আগুনে ঘি পড়ার মতো অবস্থা হয়। সে ও শাশুড়ীর মতো দপ করে জ্বলে ওঠে –
” না আম্মা, আমি মিয়াবাড়ির নবাবজাদি না,আমি মোল্লা বাড়ির পাশের বাড়ির এক গরীবজাদি। আমি আর আপনাগের এই চোতেলি নিবার পারবোনা। আপনার আরাক বিটার বউ আচে, জমিদার বাড়ির কন্যে,তারে কন চোতেলি নিবার জন্যি। তারপর আপনার ছাওয়ালের জন্যি নান্দাবাড়া করতি। আমারে দিয়ে নান্দাও অবিনে, চোতেলি নিয়াও অবিনে। এই আমি বসলাম।”
জয়গুন সত্যি সত্যি কাজ ছেড়ে পাশে মটর কলাইর গাদার উপর বসে পড়ে।
শাশুড়ী দপ করে নিভে যায়। হঠাৎ করে রণে ভঙ্গ দিয়ে তার সুর পাল্টে ফেলেন,
” আচ্ছা,ঠিক আচে বউ, তুমার এহন আর চোতেলি নিতি অবেন না। তুমি নায়ে ধুয়ে আসে দুডে নান্দা চড়ায় দেওগে। চোতেলি কালকে নিও।”
জয়গুন লক্ষ্য করেছে পাখি এ বাড়ির বউ হয়ে আসার আগে শাশুড়ী তাকে ‘বউমা’ বলে সম্বোধন করতো। এখন প্রায় সময় নাম ধরেই ডাকেন। খুব বেশি হলে ‘বউ’।
জয়গুন যুদ্ধ জয়ের আনন্দ নিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে এ যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করে তার কোন লাভ নেই। জয়লাভ করলেও প্রাপ্তির খাতা শুন্য। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে-আর নয়। এবার তাকে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সে তার যুদ্ধক্ষেত্রের স্থান পরিবর্তন করবে। আসন্ন সাতৈর এর মেলার সময় সে মায়ের বাড়িতে বেড়াতে যাবে। সেখানে বসে সে তার পরবর্তী যুদ্ধক্ষেত্রের রূপরেখা চুড়ান্ত করবে।
সাতৈর মেলারও আর বেশি দেরি নেই। চৈত্রের ১-১০ তারিখ পর্যন্ত সাতৈর এর বিখ্যাত মেলা।
(চলমান)
Leave a Reply