২৯. ০৪. ২৩ইং
কৈফিয়ত
—–হারুন-অর-রশিদ মজুমদার
এক.
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে নিয়ে লেখা,আমার “পিতা ও পুত্রী” প্রবন্ধের কমেন্ট বক্সে,অধিকাংশই ইতিবাচক কমেন্ট হলেও দু’একটা,নেতিবাচক কমেন্ট দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। ভদ্রতার খাতিরে কিছু বলতেও পারছিলাম না। ফেসবুকের এই এক অলিখিত নিয়ম যে,আমার দেয়া পোস্টে যিনিই মন্তব্য করুন না কেনো,তিনি আমার ফেসবুক পেইজে সম্মানিত মেহমান। কাজেই মেহমানকে কোন প্রকার আঘাত দেওয়াটা শালীনতার সাথে যায় না। তাই এখন এই স্বতন্ত্র লেখায়,সেই সংখ্যা লঘু কমেন্ট দাতাদের বক্তব্যের,জবাবটা দিতে চাইঃ
মিস্টার জিন্নাহ যদি সমগ্র ভারতবর্ষের মুসলমানদের স্বার্থে ঝাপিয়ে না পড়তেন। কাছিমের মতো কামড়ে পড়ে না থাকতেন। তবে লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান কায়েম হতো না। পাকিস্তান না হলে,বাংলাদেশ হতো না। বোম্বের বিশাল জনসভায় মিস্টার জিন্নাহ,দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা দিয়েছিলেন,”আমি ভারতবর্ষের মুসলমানদেরকে,ভারতবর্ষের হিন্দুদের কাছে ক্রীতদাস হতে দিতে পারি না”।
এমন দুঃসাহসিক উচ্চারণ করে তিনি,তৎকালীন উগ্র হিন্দুত্ববাদের তোপের মুখে পড়তেও দ্বিধা করেননি, ভারতবর্ষের পিছিয়ে পড়া মুসলিম জনগোষ্ঠীর স্বার্থে। আমরা যারা ভারতবর্ষের মুসলিম অধিবাসী। আমাদের পক্ষে স্বাধীন সার্বভৌম পাকিস্তান কিংবা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে বসবাস করে,মিস্টার জিন্নাহকে সমালোচনা করাটা আত্মহননের সামিল।
মিস্টার জিন্নাহ জীবিতকালে হিন্দুূেদের এতো গালাগাল শুনেছেন যে,কবরে তাঁকে একটু শান্তিতে ঘুমোতে দিই। অন্তরের অন্তঃস্তল থেকে কিঞ্চিত সম্মান করি। কেন? জানতে হলে সেকালের ইতিহাসটা পড়তে হবে।
নতুবা সময় ও আর্থিক সঙ্গতি থাকলে একালের অবরুদ্ধ মুসলমানদের আবাসভূমি,এক কালের ভূস্বর্গ কাশ্মীর ঘুরে আসুন। এখন সেটা কি স্বর্গ নাকি নরক-চর্ম চোখে দেখে আসুন। এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে চাই না।
অবরুদ্ধ কাশ্মীর দেখে আন্দাজ করুন। যদি ভারতবর্ষকে মিস্টার জিন্নাহ’র অনমনীয়তা সত্বেও,ইংরেজগণ না ভাগ করে দিয়ে যেতেন। তবে এই ভারতবর্ষ হতো পৃথিবীর জাহান্নাম। হিন্দু আর মুসলমানদের মারা-মারি কাটা-কাটি দাঙ্গা-হাঙ্গামা চলতো,দশকের পর দশক শতাব্দীর পর শতাব্দী। এই হিংসা প্রতিহিংসার কোনো সীমা পরিসীমা থাকতো না।
কতো কোটি কোটি নীরিহ মুসলমান পরিবার যে,পৃথিবীর বিভিন্ন পথে-প্রান্তরে রিফিউজি হয়ে ঘুরে বেড়াতো,তা ভাবতেও গায়ে কাঁটা দেয়। পাকিস্তান,বাংলাদেশ যেভাবে হিন্দু শূন্য হয়েছে। পুরো ভারতবর্ষ তেমনি নির্যাতনের গ্যাড়াকলে মুসলিম শূন্য হয়ে যেতো।
ইরাক,ইরান,সিরিয়া,তুরষ্ক এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কুর্দী জাতি। অদূরভবিষ্যতে তাদের আর মাতৃভূমি বা নিজ দেশ নামক ভূখন্ড প্রাপ্তির সম্ভাবনা সুদূরপরাহত। ভারতবর্ষের সংখ্যা লঘিষ্ঠ মুসলমানদের অবস্থা হতো,এই ভবঘুরে কুর্দীদের মতো এক নিগৃহীত জাতির।
পাকিস্তান অথবা বাংলাদেশের মুসলিম হয়েও,যারা বলে বেড়ান সংখ্যা লঘিষ্ঠ মুসলমানদের,আলাদা জাতি করে ধর্ম ভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্র বানানো সঠিক ছিল না। তারাই আজ ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর মানুষ হয়েও,একমাত্র মুসলমান জাতি পরিচয়ে,ভবঘুরে হয়ে সারা পৃথিবীময় পিকনিক করে বেড়াতেন।
ঠেডা কেউ কেউ প্রশ্ন তুলবেন,ভারতের বর্তমান মুসলিম অধিবাসী গণ রিফিউজি হচ্ছেন না কেনো? কোটি টাকা দামের প্রশ্ন। ভারতে বসবাসকারী মুসলমানদের সাহসও পাকিস্তান,বাংলাদেশের মুসলিম গণ। এটা হিন্দু মৌলবাদীরাও জানে বলেই,ইচ্ছে থাকা সত্বেও অনেক কিছু করতে তারা পারছে না। বাংলাদেশ ও পাকিস্তান হচ্ছে ভারতে বসবাসরত মুসলমানদের কাছে ভারসাম্য।
তীক্ষ্ণ ক্ষুরধার বুদ্ধির ইহুদিদিগের,প্রায় তিন হাজার বছর সময় লেগেছিলো,আহলে কিতাব হিসেবে ধর্মীয় ভাই-বেরাদর মুসলমানদের সাথে,একটি “ইসরায়েল” রাষ্ট্র পেতে। তাও কতো ফ্যাকড়া।
সেখানে পিছিয়ে পড়া মুসলিম জনগোষ্ঠীর পক্ষে ভারতবর্ষের এক কোণে,একটু আবাসস্হল পাওয়া হতো,সোনার হরিণ পাবার মতোই অসম্ভব বিষয়। সংখ্যালঘুর তকমা এঁটে কাটাতে হতো,ভারতবর্ষের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের,নিগৃহীতের জড় জীবন। যে জীবন কাটাচ্ছে বাংলাদেশে,কথিত বিহারি জনগোষ্ঠী। যে জীবন কাটাচ্ছে পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালি জনগোষ্ঠী।
সংবেদনশীল পশ্চিম,বিশেষত ইউরোপ আহ্ উহ্ করতো। এছাড়া তাদের আর কিইবা করার থাকতো? ভারতবর্ষের মুসলিম ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ই তো চরমপন্থী।
এখন উভয় পক্ষই কী সুন্দর ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে, অসাম্প্রদায়িকতার বুলি আওড়ায়। এই জন্যই দার্শনিক গণ বলে থাকেন,দূরত্ব সম্পর্ক মধুরতম ও গভীর করে।
“পিতা ও পুত্রী”- প্রবন্ধের কমেন্ট বক্সে তো বটেই,জীবিতকালেও মিস্টার জিন্নাহ বহুবার শুনেছেন যে,”জিন্নাহ,ইসলাম বা ভারতবর্ষের মুসলমানদের জন্য কান্নাকাটি করার কে”?
মিস্টার জিন্নাহ জীবদ্দশায় কোনোই ভনিতা না করে,দুষ্ট লোকদের মুখের উপর বলতেন,”মনে করুন আমি একজন বিধর্মী হিসেবেই,ভারতবর্ষের পিছিয়ে পড়া কোটি কোটি মুসলিম জনগোষ্ঠীর,নিশ্চিত ভবিষ্যতের স্বার্থে লড়াই করছি”। লা জওয়াব।
দুই.
আমার আরেকটা প্রবন্ধ ছিল “স্যার হিরো আলম” নামে। সেখানেও কমেন্টবক্সে আমাকে,বেশ কিছু নেতিবাচক কমেন্ট ও নসিহত শুনতে হয়েছে। ইতিউতি করে নেতিবাচকদের মূল বক্তব্যটা হলো,উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের তারা স্যার বলতে অনীহ। যেনো ব্যাপারটা এমন যে,স্যার বললে আমি ছোট হয়ে গেলাম।যাকে বলছি তিনি বড়ো হয়ে গেলেন। আসলে ব্যাপারটা এমন না। এটা জাস্ট একটা সম্বোধন। উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্ভ্রম করে স্যার বলার মতো,অসংখ্য তাদের অধঃস্তন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন।
এটা আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে,শুধু চা-সিগ্রেট বিক্রেতা টোকাইদের মুখ থেকে,স্যার ডাক শোনার মতো না। প্রসঙ্গক্রমে বলি আমরা যখন ঢা.বি -এ ভর্তি হই,তখন ঢা.বি ক্যাম্পাসে দু’রকমের চা-সিগ্রেট বিক্রেতা টোকাই ঘুরে বেড়াতো। যে চা-সিগ্রেট বিক্রেতা টোকাই গণ স্যার সম্বোধন করতো,ছাত্র-ছাত্রীরা সাধারণত তাদের কাছ থেকেই সদাই-পাতি কিনতো। কাজেই যারা মামু ডাকতো তাদের বিক্রি-বাট্টায় ভাটা পড়লো। শেষ মেশ সকলেই স্যার ডাকা শুরু করলো।
উচ্চশিক্ষা সেরে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে,রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী হওয়া মেধাবীদের,আর যে অভাবই থাক অন্তত “স্যার” ডাকার লোকের অভাব নেই। সারাদিন অধস্তনদের স্যার ডাক শুনে,তারা বরং রীতিমতো “স্যার” শব্দের উপর ভীতশ্রদ্ধ।
তাহলে তারা স্যার ডাক শুনতে চান কেন?
সরকারি অফিসে ভাই-বেরাদর সম্বোধন শোভনীয় হয় না বলে। আর কিছু না।
মসজিদে বিসমিল্লাহ,মন্দিরে হরে রাম হরে কৃষ্ণ,বলে প্রবেশ করতে হয়। সিনেমা হলে,খেলার মাঠে হৈ হুল্লোড় হবে। রাজনৈতিক দল আর পত্রিকা অফিস মানেই,অমুক ভাই তমুক ভাইয়ের ছড়াছড়ি। শ্বশুর বাড়ি গেলে আপনি দুলা ভাই। মামা বাড়িতে গেলে ভাগ্নে। স্হানভেদে আচার ও বুলির রেসালা মাত্র। স্হান-কাল-পাত্র বলে একটি কথা আছে। যৎ স্হানে যদাচার। শুভেচ্ছা নিরন্তর।
Leave a Reply