এসএসসি পরীক্ষা চলছে। এইচএসসি পরীক্ষা সমাগত। পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের জন্যে এ লেখা।
এক.
১৯৮২ সালের পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষা ছিল এক কথায় অদৃষ্টপূর্ব। এখনকার পিএসসি’র আদলে সে বছর যে পরীক্ষা নেয়া হয় তার নাম ছিল সেন্টার পরীক্ষা। তখনকার মতো ওটাই ছিল শেষ সেন্টার পরীক্ষা। পরে আরো নিয়ে থাকতে পারে তবে আমার জানা নেই।
উত্তর কালিকাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র আমি। পটুয়াখালী শহরের পুরাতন বাসস্ট্যান্ডের পাশেই আমাদের স্কুল। এখনো আছে। শৈশব থেকেই বিদ্যালয়ে অনিয়মিত যাতায়াত আমার মজ্জাগত। বাবা বেতাগী থাকতেন, সপ্তাহান্তে শহরে আসতেন। অতএব আমায় মারে কে? এদিকে আমার সরল মা ধরে নিতেন ছেলেটা নিশ্চয়ই স্কুলে যায়। আমার ছোট বোন সোমা ‘পলায়ন কান্ডে’ আমার সঙ্গী হওয়ায় মায়ের গোচরে আনার মতো আর কেউ ছিল না। স্কুলের একটু আগেই জেলা স্টেডিয়াম। স্টেডিয়ামের নীচে তখন বেশ কিছু ফাঁকা দোকান ঘর ভাড়ার অপেক্ষায় ছিল। তার একটার মেঝেতে আমরা চুপচাপ বসে থাকতাম। স্কুল ছুটি হলে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ড্যাং ড্যাং করে বাসায় ফিরে যেতাম। এভাবে কিছু দিনের ধারাবাহিক ‘বিরতির’ মাঝে কোনো এক দুপুরবেলা নুরুজ্জামান আমাদের বাসায় এসে হাজির। সে আমার পরের ক্লাসে পড়তো। তুখোড় ফুটবলার। শহরের গোরস্থান রোডে ওদের বাসা। নুরু বললো,
–হেড স্যার আপনারে যাইতে বলছে। ফুটবল ম্যাচ আছে।
আমি দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে স্কুলে গেলাম। পেছন পেছন আমার বোন। হেডমাস্টার মুশফিক স্যারের রুমে ঢুকেই দেখি পরিবেশ থমথমে। দরজাটা লেগে যেতেই জোড়া বেত দিয়ে উত্তম ও অধমার্ধে ব্যাপক ধোলাই দিতে দিতে স্যার সেদিন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। আমার অনুপস্থিতি সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার পর ফুটবলের টোপ দিয়ে তিনি আমায় স্কুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। ফুটবল নিয়ে আমার দূর্বলতার কথা তাঁর জানা ছিল। সে বছর (১৯৮২) পটুয়াখালী মহকুমা আন্তঃ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টে আমাদের স্কুল চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল এবং আমি সে টিমের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলাম।
তবে ওটাই শেষ। মার খেয়ে একদম সোজা হয়ে গিয়েছিলাম। এরপর কোনদিন স্কুল পালাইনি। নিজে থেকেই পড়াশোনায় মন দেই এবং কিছুদিন পর সেন্টার পরীক্ষার চক্করে পড়ি। সে পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেল আমি দ্বিতীয় হয়েছি। কাজল নামে আমাদেরই এক সহপাঠী সেবার প্রথম হয়েছিল।
কেমন শিক্ষক ছিলেন মুশফিক স্যার? তিনি কি শুধু মারতেন? মোটেই না। ছাত্রছাত্রীদের বরং সন্তানাধিক ভালোবাসতেন। ডিসেম্বরের এক রাতের কথা বলি। সেন্টার পরীক্ষার প্রস্তুতি চলছে। রাতের বেলা হঠাৎ জানালায় টোকা।
–এই রুহুল আমিন, কী করো? (উনি শিপার ডাকতেন না)
–পড়ছি স্যার?
আমি জানালা-দরোজা খোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লে স্যার বললেন,
–আচ্ছা পড়ো। আমি বসবো না।
কল্পনায় দেখতে পাই সে রাতে আরও অনেকের দরজায় কড়া নেড়েছেন তিনি। অতঃপর মাঝরাতে ফটিকের খেয়াঘাট থেকে লাউকাঠি নদী পাড়ি দিয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। কেমন স্নেহময়, নিঃস্বার্থ, নির্মোহ শিক্ষা গুরু! প্রায়ই ভাবতাম স্যার বোধহয় বেঁচে নেই। সম্প্রতি শুনলাম তিনি বেঁচে আছেন এবং বাড়িতে অবসর যাপন করছেন। তাঁর সাথে দেখা করে জোড়া হাতে কদমবুসি করার অপেক্ষায় আছি।
তখন সিজিপিএ ছিল না। তাই আমি কত কী পেয়েছিলাম জানিনা। ষষ্ঠ শ্রেণীতে যথারীতি সরকারী জুবিলী হাইস্কুলে ভর্তি হই। ১৯৮৩ সালের মার্চ বা এপ্রিলের এক দুপুরে ক্লাসে ছিলাম। পশ্চিম দিকের সেই ক্লাস রুম গ্যালারি সিস্টেমের। হঠাৎ ক্লাস ক্যাপ্টেন কিরণের মাধ্যমে আমাকে ডেকে নেয়া হল। সেসময় মহিলা কলেজের বিপরীত দিকে একটা অডিটোরিয়াম ছিল। গিয়ে দেখি সেখানে আরও অনেকে উপস্থিত হয়েছে। একটা সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আমাদের সনদপত্র ও একটি করে কাঁচের জগ ধরিয়ে দেয়া হয়। স্বচ্ছ কাচের জগ। পঞ্চম শ্রেণীতে ভালো ফলাফলের ‘ফল’ স্বরূপ এই জগ প্রাপ্তি। সেদিন জগের রঙ সোনালী হলে জোর গলায় বলতে পারতাম যে ক্লাস ফাইভে আমি ‘গোল্ডেন’ পেয়েছি!
ওই লাঠিপেটা খেয়ে সে যাত্রা অনেক উপকার হয়েছিল। এখন মনে হয়, হুঁশ না ফেরা পর্যন্ত ‘সামান্য’ মারধোর খারাপ না বরং মহৌষধ। সভ্য দেশ; তাই এদেশে ওসব এখন চলে না। স্কুল আর ‘অন্য একটা সরকারি জায়গায়’ মাারপিট বন্ধ হওয়ায় চারিদিনের দিকে নানাবিধ ‘মারন কান্ডের’ সুচনা হয়েছে। এই দুই প্রতিষ্ঠান বাদে বাকি সবাই এখন ‘মারে’ আর জাতির বৃহদাংশ ‘তা’ আরাম করে খায়।
দুই.
ক’দিন আগের এসএসসি’র রেজাল্টের পর কী দেখলাম? নরসিংদিতে একটা মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। ষোল বছরের অপত্য স্নেহ, ভালোবাসা একটা দু’শো টাকার ওড়নার কাছে কিছুই না। শুধু ঝুলে পড়লেই হলো। সিজিপিএ’র ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ একটা ‘আস্ত’ জীবন কেড়ে নেবার জন্যে যথেষ্ট। আহ্ হা!
বেশি দিন আগে নয়। এই নরসিংদিরই একটা ছেলে মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিল। সম্ভবত এইচএসসিতে তার সিজিপিএ ৪.৭ বা এর কাছাকাছি ছিল। অথচ সেই ছেলে ওর আইডল হতে পারেনি। মরে যাওয়া মেয়েটাও সমান ৪.৭ পেয়েছিলো। কিন্তু তার বেঁচে থাকার জন্যে ৪.৭ যথেষ্ট নয়। দশমিক তিন না পেলে ‘এই জীবন’ রেখে কী লাভ? কী অদ্ভুত মনস্তত্ত্ব! গোল্ডেন গোল্ডেন করে বাচ্চাদের কেন আমরা এমন প্রতিযোগী বানিয়ে দেই? অথচ এসএসসি/এইচএসসিতে ‘গোল্ডেন’ বলতে কিন্তু কিছু নেই। আছে শুধু ‘এ’। তারপরও কে শোনে কার কথা? বহু ‘শিক্ষিত মানুষ’ গোল্ডেন নিয়ে গোলক ধাঁধায় পরে ব্যাপক অস্থির।
আমার বাচ্চাদের রোল নম্বর নিয়ে আমি কোনোদিন মাথা ঘামাই না। এমনকি জিগ্যেস পর্যন্ত করি না। ও একটা হলেই হয়। ওদের মা মাঝেমধ্যে এটা সেটা বলার চেষ্টা করে। আমার কথা একটাই-পাবলিক পরীক্ষায় ফেল কোরো না।
এই ছাইপাশ জিপিএ দিয়ে কী হয়? আমি একজনকে চিনি যিনি ম্যাট্রিকুলেশন, উচ্চমাধ্যমিক, সম্মান ও মাস্টার্স পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন। পরে ভাবলেন সিভিল সার্ভিস পরীক্ষাটা বাকি রাখার কী দরকার? শেষ পর্যন্ত ওটা দিয়ে নিখিল পাকিস্তানে প্রথম স্হান অধিকার করে কূটনীতিক বনে যান। পরে স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রীও ছিলেন।
কিন্তু তারপর?
এরপরের ইতিহাস গোটা জাতির জন্যেই করুণ। হবিগঞ্জের এক গ্রাম্য বাজারে গ্রেনেড দিয়ে তাঁকে উড়িয়ে দেয়ার মূহুর্তে দূর্বৃত্তরা জানতো না যে, জাতির কত বড় মেধাবী সন্তান সেদিন সবাইকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।
‘মানুষ কী চায়’ এটা নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। যার হাজার কোটি টাকা আছে সে তো ব্যবসা বন্ধ করে না। কারণ কী? কারণ হলো, অতো টাকাও তাকে তৃপ্তি এনে দিতে পারেনি। হ্যাঁ, মানুষ আসলে তৃপ্তি চায়। স্যাটিসফেকশন। আমাদের যা ‘হুলো’ স্বভাব তাতে মনের মাঝে কখনোই তৃপ্তি আসে না। জগৎ-সংসারের আসল সমস্যাই কিন্তু ওটা।
এসএসসি চলছে। এইচএসসি সামনে। যেকোনো পাবলিক পরীক্ষার আগে চলুন ছেলেমেয়েদের দড়ি ও ওড়নার সদ্ব্যবহার শেখাই। সিজিপিএ নিয়ে ওদেরকে বলি, ৫ শুধুই একটি সংখ্যা মাত্র; এর বেশি কিছু নয়। এই জীবনে কিছু অপ্রাপ্তি থাকুক। জীবন-কলসি অল্প একটু খালি থেকে যাক।
দুনিয়ায় সেরা বলতে কিছু নেই।
আসলেই কিছু নেই।
(সমাপ্ত)
Leave a Reply