১০.১০.২২ইং
জ্ঞানতাপস
—-হারুন-অর-রশিদ মজুমদার
নবম অধ্যায়
এক.
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া যেমন,আহমদ ছফা’র লেখার নিবিষ্ট ভক্ত পাঠক ছিলেন। অন্যদিকে আহমদ ছফা নিজেও জাসদ রাজনীতির সাথে জড়িয়ে,বিএনপির রাজনীতি ও বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। আহমদ ছফা বেগম খালেদা জিয়ার আহ্বানে সাড়া দিয়ে,তাঁর সেনানিবাসের বাসায় বহু বার দেখা করেছেন। সেই সুবাদে তখন সেখানে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমানের সাথে,তাঁর সৌজন্য মূলক দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে। তবে যেহেতু তখন তারেক রহমান বয়সে তরুণ ছিলেন,কাজেই তেমন কোনো কথাবার্তা কখনও হয়নি।
সেই সূত্রে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান,অভিলাষ ব্যক্ত করলে আহমদ ছফা সম্মতি সাপেক্ষে,অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক এর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান এর, সাক্ষাৎ করার দিনক্ষণ নির্ধারণ করেন। এখানে উল্লেখ্য যে,আহমদ ছফা’র নিজ জন্মভূমি চট্টগ্রামের অধিবাসী,এককালীন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবুল ফজল যখন,রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা ছিলেন সেই সময় আবুল ফজল এর সাথে,আহমদ ছফা বেশ কয়েকবার বঙ্গভবনে যান এবং প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানেরও সান্নিধ্য লাভ করেন। কাজেই জিয়া পরিবারের সাথে,আহমদ ছফা’র ঘনিষ্ঠতা দীর্ঘদিনের।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক এর পক্ষ থেকে সকালের নাস্তা করার আমন্ত্রণ সমেত,আহমদ ছফা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান সহযোগে,এক সকালে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক এর বাস ভবনে এলে,তাঁকে অভ্যর্থনা জানান সরদার ফজলুল করিম,শিল্পী এস এম সুলতান,প্রফেসর আনিসুজ্জামান,ডঃ কামাল হোসেন,হুমায়ুন আজাদ ও সলিমুল্লাহ খান। প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান রুমে এসে দাঁড়িয়েই,স্বভাব সুলভ বিনয়ী ভঙ্গিতে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে সালাম দিলে,তিনি খুব খুশি হয়ে বললেন, “আপনের সালামের একটা বিশেষত্ব আছে। এইডা কি আপনে বুঝেন”?
প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান বললেন, “স্যার,আমরা অতি সাধারণ মানুষ। আমাদের জ্ঞান অতি সীমিত। আমরা অত সচেতন ভাবে কোনো কাজ,আপনার মতো করে করার ক্ষমতা ও যোগ্যতা কোনোটাই রাখি না। আমরা চলি আবেগে। আর,আপনি স্যার চলেন বিবেকের ও যুক্তির উপর ভর করে। এটা আমার বা আমাদের রাজনীতিবিদদের সীমাবদ্ধতা। বলতে পারেন আমরা চাঁদের মতো। আপনাদের মতো জ্ঞানী গুণীজনদের সূর্যের আলোয় আমরা আলোকিত। আপনাদের সাহচর্যে এসে অথবা আপনাদের মতো জ্ঞানীদের বই পড়ে,আমরা জীবন চলার জন্য যতটুকু,নিজেকে বা অন্যকে চেনা যায়,ঠিক ততটুকুই চিনি জানি”।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বললেন, “আপনের বিনয় আমারে মুগ্ধ করছে। হুনেন ওই আপনেগো শহীদ সোহরাওয়ার্দী সা’ব আছে না? উনারও বিনয়বোধ আছিল দেইখা রাজনীতিবিদ অইবার পারছিল। বিনয় অইলো একজন রাজনীতিবিদের লাইগা এক্কেরে ফরজ কাম। হেইডা অইলো রাজনীতিবিদের ভূষণ। অন্তরে যেডাই থাক,একজন রাজনীতিবিদের অন্তর এক,বাইরের দিকডা আরেক অইবার পারে। আপনে বাইরেরডা বালাই রপ্ত করছেন। অন্তরডা কেমুন হেইডা আমার কওয়ার এখতিয়ার নাই। কিন্তুক আপনেগো সোহরাওয়ার্দীরে যে আপনেরা,সোহরাওয়ার্দী কন এইডা আমি কিন্তুক কই না। কারণ ওনারা প্রকৃতপক্ষে সোহরাওয়ার্দী উপাধি ধারী না”।
শিল্পী এস এম সুলতান বললেন, “স্যার,ওনার সোহরাওয়ার্দী উপাধি,তাহলে কি ওনার নিজে নিজে বানানো”?
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বললেন, “না। হেইডাও না। এইডা ক্যামনে অইলো আমার বুজে আহে না। তয় এইডার ইতিহাসডা অইলো এই কারবার করছেন, জাস্টিস হোসেন জাহেদ সোহরাওয়ার্দী,আপনেগো হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সা’বের মান্যবর পিতা। তিনি তো বিলাত গেছিলেন ব্যারিষ্টারী পড়বার লাইগা,ওই ঢাকার নওয়াবগো আর্থিক সাহায্য সহযোগিতা নিয়া। কারণ জাহেদ সোহরাওয়ার্দীর আব্বা মৌলবি ওয়ালিউল্লাহ আছিলেন,নওয়াবগো প্রতিষ্ঠা করা “ঢাকা মাদ্রাসার” হেড মৌলবি। এই ঢাকা মাদ্রাসার হেড মৌলবি ওয়ালিউল্লাহ নওয়াব আবদুল গণির,বাপের আমল থেইক্কা নওয়াবকো,তাবেদারি কইরা নিজ ছেলের উচ্চতর পড়ালেখার লাইগা,অর্থ সাহায্য নিয়া নিজ ফায়দা হাসিল করছেন”।
শিল্পী এস এম সুলতান বললেন, “স্যার,এই মৌলবী ওয়ালিউল্লাহর আদি নিবাস কোথায়”?
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বললেন, “এই মৌলবী ওয়ালিউল্লাহ আইছিলেন কাশ্মীর থেইক্কা। যেহেতু ঢাকার নওয়াবগো আদি নিবাসও আছিলো কাশ্মীর। সিলেট ওলেট ঘুইরা ঢাকায় আইয়া থিতু অইছে। হের লাইগাই বেঙ্গলে আইয়া,কাশ্মীর কাশ্মীর খাপে খাপ মিল্যা গেছে”।
শিল্পী এস এম সুলতান বললেন, “স্যার,আপনি একবার বলেছিলেন ঢাকার আদি বাসিন্দারা, নওয়াবদের সাথে আত্মীয়তা করতো না। কেনো”?
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বললেন, “ঠিক কইছেন।এই ঢাকার নওয়াবগো লগে ঢাকার আদি অভিজাত, বাসিন্দারা আবার আত্মীয়তা করবার চাইতো না। হেগো আভিজাত্য নাই দেইখা। নওয়াব সলিমুল্লাহ বিয়া করছিলেন প্রভাব খাডাইয়া,ঢাকার এক আদি অভিজাত পরিবারে। হের লাইগা নওয়াব সলিমুল্লাহ সা’বরে,বেগম সাহেবার অনুমতি নিয়া,তাঁর খাস কামরায় প্রবেশ করবার লাগতো”।
শিল্পী এস এম সুলতান বললেন, “স্যার,আমরা সবাই জানি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায়,ঢাকার নওয়াবদের অনেক অবদান। কিন্তু আপনি একবার ভিন্ন কথা বলেছিলেন”।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বললেন, “নওয়াব পরিবারের জৌলুশ ম্লান অইয়া,পরবর্তী কালে সোহরাওয়ার্দী পরিবার প্রভাবশালী অইলে,পূর্ব কৃতজ্ঞতা থেইক্কা নওয়াবগো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায়,কোনো অবদান না থাকনের পরও,ক্ষমতা পাইয়া সোহরাওয়ার্দী পরিবার ইংরেজগো উফরের প্রভাব খাডাইয়া,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম হল প্রতিষ্ঠা অইলে,হেইডার নামকরণ করাইছেন নওয়াব সলিমুল্লাহ মুসলিম হল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ক্রাঞ্চি জমিও নওয়াবরা দেয় নাইক্কা।
অহনে আপনেরা কইবার লাগছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নওয়াবগো অবদান। কইলে হেইডা আমি আর কি কমু? হেরগো অবদানডা মৌলবী ফজলুল হকে’র হমান। ওই নওয়াব নওয়াব আলীগো লগে মিল্যা হেইডার প্রস্তাবডা করছিলেন। যাউক এই জাস্টিস হোসেন জাহেদ সোহরাওয়ার্দী নিজের নামের লগে, প্রথ্বম সোহরাওয়ার্দী উপাধি লাগাইয়াছেন। হের আগে আছিল না। তয় তিনি ইংরেজিগো থেইক্কা,স্যার উপাধি কিন্তুক ঠিকই পাইছিলেন। এই জাস্টিস স্যার হোসেন জাহেদ সোহরাওয়ার্দী,কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি আছিলেন। তাঁর এক ছেলে,হোসেন শাহেদ সোহরাওয়ার্দী,আরেক ছেলে আপনেগো নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী”।
প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান বললেন, “স্যার,বংশ কি খুব গুরুত্বপূর্ণ? আমরা জানি “জন্ম হোক যথাতথা কর্ম হোক ভালো”।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বললেন, “না। গুরুত্বপূর্ণ না। তয় কতা অইলো ফেইক জিনিসডাও আবার বালা না। আপনের সালাম দেওনের ভঙ্গিটা,আপনের এক্কেরে সিগনেচার টোন। আপনের আব্বা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের,বিশেষত্ব অইলো দেইখা বক্তৃতা দেওন। এইডা তাঁর মৌলিক কাম। তিনি কি না দেইখা বক্তৃতা দিবার পারতেন না? পারতেন। তয় আমার মনে লয়,তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের এককালীন সভাপতি ও স্বাধীনতা পরবর্তী কালে ভারতের প্রথ্বম প্রেসিডেন্ট,মাওলানা আবুল কালাম আজাদ সা’ব-রে আদর্শ মানছেন। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ কাজ চালানোর মতন,বাতচিত করবার মতন ইংরেজিডা অবশ্যই জানতেন।
কিন্তুক কখনোই ইংরেজগো লগে ডায়ালগে গেলে,দোভাষী ছাড়া যাইতেন না। এমনকি লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন যহন দীর্ঘ দেন দরবার করবার লাগছেন গান্ধী, জিন্নাহ,নেহেরু,মাওলানা আবুল কালাম আজাদ সহ নেতৃস্থানীয় ভারতীয় রাজনীতিবিদগো লগে। পার্টিসন না কইরা এক ভারতবর্ষ টিক্যা রাখনের লাইগা। তহনও মাওলানা আবুল কালাম আজাদ দোভাষী লইয়াই,লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের লগে ডায়ালগে গেছিলেন। আপনের আম্মা সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার,বিশেষত্ব অইলো তিনি গণতন্ত্রের পক্ষে,নীতির প্রশ্নে এক্কেরে নাছোড়বান্দা আপোষহীন। হের লাইগা ওনারে অনেক মাশুল দিতে অইছে। তয় বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে না,এই একডা ত্যাগের কারণে আপনের আম্মা,বেগম খালেদা জিয়া চির স্মরণীয় অইয়া গেলেন”।
অনেকক্ষণ কথা বলার পর অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক খেয়াল করলেন যে,প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই তাঁর কথা শুনছেন। এবার অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক শশব্যাস্ত হয়ে বললেন, “এই দেহেন আপনেগোর মতন রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ মেহমানগো, বইবার দিবার মতো কোনো যোগ্য আসনপাতি,আমার ঘরে নাইক্কা। কি যে করি”?
প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান বললেন, “স্যার,আপনি ব্যাস্ত হবেন না। আমি আমার পিতা মাতাকে আদর্শ মেনে রাজনীতি করি। আমার আব্বা সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান রাস্তা ঘাটে,মাঠে ময়দানে যেখানেই গিয়েছেন জনসাধারণের সাথে,মাটিতে বসে খালকাটা কর্মসূচী করেছেন,জনসাধারণকে সাথে নিয়ে জানার জন্য হাঁটা কর্মসূচি করেছেন। আমার আম্মা সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে,রাজপথে বসে পড়েছেন,পুলিশের হাতে মার খেয়েছেন। আমি সেই পিতা মাতার সন্তান। সেই তুলনায় অতি সহজ কাজ হলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে,আপনার মতো জ্ঞানী লোকের সান্নিধ্যে আসা ও কথা শোনা। প্রয়োজনে আপনার রুমের মেঝেতে বসে হলেও আমি,আপনার মুখ নিঃসৃত অমীয়বাণী শুনতে,মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে এসেছি”।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বক্তব্য শুনে,প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমানের চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললেন, “হের লাইগাই কয় আম গাছে আম ধরে। শ্যাওড়া গাছে না। তবু এই চৌকিটায় এট্রু আরাম কইরা বয়েন। আপনে রূঢ় অতীতটা মনে রাখছেন। এই কামডা বালা করছেন। পিছনের দিকে না তাকাইলে সামনে আউগান যায় না। একশ মিটার লাফ দিতে অইলে পনেরো বিশ মিটার,পিছাইয়া আইয়া যুত মতো লাফটা দিতে অয়। তাইলেই আপনে কাঙ্খিত লক্ষ্যডা অর্জন করবার পারবেন। আপনে হেইডা বালাই রপ্ত করছেন দেইখা দিলখোশ অইছে। আমি আপনের সাফল্য কামনা করি। আইচ্ছা একডা কতা আপনেরে জিগাইবার চাই,আপনে যদি কিছু মনে না করেন।
দুই.
প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান বললেন, “স্যার,আপনি যে কোনো প্রশ্ন আমাকে করতে পারেন। আমি সচেতনে কোনো সত্য গোপন করবো না,যথাসাধ্য সদুত্তর দিবো ইনশাল্লাহ”।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বললেন, “আপনের বাপের দিকে বলেন,মায়ের দিকে বলেন হগল আত্মীয় স্বজনরা,উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত আছিলেন। বলা যায় প্রত্যেকে উচ্চশিক্ষাডা অর্জন করছিলেন। কেউ ডাক্তার,কেউ ইন্জিনিয়ার,কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অইবার লাগছে বা অইছে। আপনের দাদাও হেইকালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেইকা পাশ কইরা,ভারতবর্ষের একজন সেরা কেমিস্ট এবং কালি বিশেষজ্ঞ আছিলেন। আপনের নানাও হেইকালের গ্রাজুয়েট অইছিলেন,অথচ আপনের শিক্ষা জীবনডা অতোডা উজ্জ্বল অইলো না ক্যান? আপনে এই প্রশ্নের উত্তর দিবার পারেন,আবার ইচ্ছা করলে না দিবারও পারেন। আমি কিছু মনে করুম না”।
প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান বললেন, “স্যার,আপনের যতটা অপ্রিয় প্রশ্নই হোক,আমি তার যথাযথ উত্তর দিবো। আপনি স্যার জানেন যে,যখন আমি স্কুলে পড়ি ঠিক সেই সময়ে,আমার শ্রদ্ধেয় আব্বা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নির্মম ভাবে নিহত হন। মৃত্যুকালে আমার আব্বা প্রেসিডেন্ট ছিলেন,এই পরিচিতিটুকুই ছিল একমাত্র সম্বল। আর কিছু না। আমাদের এক মাসের বাজার খরচ করার মতো,অর্থকড়িও ঘরে ছিল না। আমার আম্মার হাতে গোনা কয়েকটি শাড়ি ছিল। আহামরি কোন গয়নাও ছিল না। আমদের দুই ভাইয়ের স্কুল ড্রেসের বাইরে আব্বার,পুরনো প্যান্ট ও সার্ট ছোট করে বানানো,দুই সেট করে পোশাক ছিল। আপনার কথা শোনে বুঝতে অসুবিধা হয় না য়ে,আপনি আমাদের আত্মীয় স্বজনদের সম্পর্কেও যথেষ্ট ওয়াকিবহাল।
বাবার দিকের বলেন আর মায়ের দিকের বলেন,আমাদের আত্মীয় স্বজনরা উচ্চশিক্ষিত সত্য। কেউ উচ্চধনী ছিলেন না যে আমাদেরকে,নুন্যতম আর্থিক সহযোগিতা সেই দুঃসময়ে করতে সক্ষম। তার উপরে আমার আম্মা সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া যদি,রাজনীতিতে না জড়িত হতেন তবে হয়তো আজকে,আপনি একজন উচ্চশিক্ষিত তারেক রহমানকে পেতেন। আম্মা রাজনীতিতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লে আমার তখন,নিজেদের সংসারের হাল ধরাটা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। যদিও আমাদের ছিল একেবারেই ছোট্ট পরিবার। ছোট হোক বড় হোক যে কোনো পরিবারের,চলার জন্য মাসিক একটা খরচ আছে। সেই খরচ নির্বাহ করেন পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যাক্তিটি।
আমার আব্বা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান মারা যাওয়ায়,আমাদের সেই উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে গেলো। আমাদের পরিবার তখন অথৈ সাগরে ভাসছে। এদিকে আম্মা হাল ধরলেন আব্বার রাজনৈতিক দল বিএনপির। আপনি স্যার ভালো করেই জানেন, রাজনীতি কোনো পেশা না। রাজনীতি করতেও অঢেল পয়সা পাতি খরচ হয়। আব্বার আর্মির পেনশন এবং প্রেসিডেন্ট থাকার সুবাদে পরবর্তী কালে রাষ্ট্র প্রদত্ত, বাড়ি ভাড়া দিয়ে সংসার চালানোর অর্থও আম্মাকে,তার রাজনৈতিক দলের পেছনে ব্যায় করতে হতো। তাতেও না পোষালে প্রায়শ ধারদেনা করতে হতো। সব মিলিয়ে সেই সময়টাতে আমাদের পরিবারের দশা বেহাল।
আমি বিএএফ শাহীন কলেজ থেকে ১৯৮১ইং সালে এসএসসি ও নটরডেম কলেজ থেকে ১৯৮৩ইং সালে এইচএসসি পাশ করে,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হয়েছি। তবে লেখা পড়ায় মনোযোগ দিতে পারছিলাম না। আমার আম্মার একদিকে রাজনীতি,আরেকদিকে পরিবার সামলানোর মতো কষ্ট দেখে। আর্থিক টানা-ফোঁড়েন তো ছিলোই। কাজেই আমাকে অতি অল্প বয়সে,উপার্জনের পথ বেছে নিতে হলো। আমার আম্মার সম্মতি নিয়েই আমি,আমার মামা মেজর(অবঃ) সাঈদ ইস্কান্দারকে সাথে নিয়ে,ব্যাংক লোনে ১৯৮৬ইং সালে ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করালাম “ডান্ডি ডাইং”। আপনি স্যার জানেন আমাদের গোষ্ঠীতে,ব্যাবসায়ী কেউ ছিল না যে,ব্যাবসায়িক পরামর্শ পেতে পারি।
এদিকে মামা সাইদ ইস্কান্দার আমার সঙ্গে আছেন, মূলত অভিভাবক হিসেবে। আর কিছু না। তিনি তো রিটায়ার্ড আর্মি পারসন,তিনি বরং চলেন আর্মি মেজাজে। যা ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক। তবু মামাকে ছায়া বৃক্ষের মতো আমাকে রাখতে হয়েছে,যেহেতু তখন আমি নিচক একজন তরুণ। ব্যাবসার ডিল করতে হয় ঝানু সব ব্যাবসায়ীদের সাথে। ব্যাবসায়িক সব মিটিংয়ে মামাকে সামনে রাখতাম,নিজের ঢাল হিসেবে যাতে আমাকে বাচ্চা ছেলে ভেবে,আমার মাথায় কেউ কাঁঠাল ভাঙতে না পারে। যদিও তখন আমি বয়সে নবীন বটে তবে,মনের দিক থেকে আমি একবরে পূর্ণ বয়স্ক,মানুষের মতো শক্ত সামর্থ্যবান হয়ে গিয়েছি। বিরূপ পরিস্থিতি মানুষকে সামর্থ্যবান করে তোলে। কাজেই পিতার মৃত্যু আমাকে বাস্তববাদী করেছে। বিপদ আমার আম্মাকে যেমন ভেঙে দিতে পারেনি। আমাকেও মচকাতে পারেনি।
আমার ছোট ভাই তো তখন নিতান্ত শিশুই বলা চলে। আব্বার মৃত্যুর পর আম্মা ও আমি আল্লাহর রহমতকে ভরসা করে,বিপদকে জয় করতে যুদ্ধে অবর্তীর্ণ হয়েছি। এই জীবন যুদ্ধে আমাদের মা-ছেলেকে জয়ী হতেই হবে। তখন এই ছিল আমাদের প্রত্যয়। এই ছিল আমাদের প্রতিজ্ঞা। কতটুকু সফল হয়েছি জানি না। ওই বয়সে আমি আমার মায়ের রাজনীতির অর্থ যোগান দিয়েছি। আমার ছোট ভাইয়ের লেখাপড়া চালিয়ে নিয়েছি,ওকে চাচার কাছে লন্ডনে পাঠিয়ে “ও লেবেল”,আমেরিকায় “এ লেবেল” অতঃপর অস্ট্রেলিয়ায় “সিভিল এভিয়েশন ইন্জিনিয়ারিং” পড়িয়েছি,নিজ উপার্জন দিয়ে ওই অতটুকুন বয়সে। আমার সামনে তখন অর্থ উপার্জন ভিন্ন,অন্য কোনো বিকল্প ছিল না স্যার”।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বললেন, “আসলে আমরা শাদা চোউকে যা দেহি হেইডাই সব না। আপনের বক্তব্য আমারে এক্কেরে আপ্লূত করছে। আপনের প্রতি আমার সম্মানবোধটা বাইড়া গেলো। আপনেরে এই প্রশ্নটা কইরা আমি বিব্রত করতে চাইছিলাম,আপনের উত্তরডা কেমুন অয়? কিন্তুক অহনে দেহি আপনে আমারে উল্টা বিব্রত কইরা ফালাইছেন। যা হুনাইলেন তাতে কইরা আপনের মা আর আপনের,জীবনযুদ্ধ আমারে এক্কেরে আউলাইয়া দিছে। যাউক জীবন বড়ো জটিল। অহনে আপনে আমারে কনতো, গিয়াসউদ্দিন আল মামুন সা’ব-রে নিয়া,আপনের নাম জড়াইয়া এত্তো বিতর্ক ক্যান”?
প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান বললেন, “স্যার,আমি আর মামুন আমরা দু’জন দুজনের স্কুল জীবনের বন্ধু। কেউ কারও আত্মীয় স্বজন না। মামুন এর বড় ভাই হাফিজ ইব্রাহিম সাহেব আর্মিতে ছিলেন। সেই সুবাদে মামুন তার ভাইয়ের বাসায় থেকে পড়াশোনা করতো। এক সময় ছিল আমার আব্বা প্রেসিডেন্ট,কাজেই আমি তাকে করুণা করে আমার বন্ধু করেছি। কিন্তু আব্বা মারা যাবার পর ও আমাদের পরিবারের,দুঃসময়ে পাশে দাঁড়িয়ে আমাকে করুণা করেছে। সেই থেকে দু’জনের বন্ধুত্বটা আরও গাড় হয়েছে।
বিপদে বন্ধুর পরিচয় আমি যেমন দিয়েছি সেও দিয়েছে বলেই,আমাদের সেই সমান্তরালে পথচলা আজও অটুট। বিশেষ করে যখন আমি ডান্ডি ডাইং এ ভালো ব্যাবসা করে,ব্যাংক লোন পরিশোধ করে,অর্জিত মুনাফা ভিন্ন খাতেও বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিলাম,তখন মামুন আমাক যাত্রী পরিহন লঞ্চ খাতে, বিনিয়োগ করতে উদ্ভুদ্ব করে। যেহেতু মামুনের বাড়ি ভোলা-য় তার ভরসাতে,আমি এই ব্যাবসায় বিনিয়োগ করলাম এবং ভালো ব্যাবসা করলাম। লঞ্চের নাম দিলাম আমার ছোট ভাইয়ের নাম কোকোর নাম অনুসারে। প্রথমে “কোকো-১” পরবর্তীতে “কোকো-২” যাতে আমার ছোট ভাই খুশি হয়। আমার আব্বা বেঁচে থাকলে যা যা করতেন,আমি আব্বার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে তার প্রতি,সকল দায়িত্ব সর্বশক্তি দিয়ে পালন করেছি।
আমার আব্বা মারা যাওয়ার কষ্ট,আমি ওকে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে দিইনি। এমনকি আমি যে ওই বয়সে উদয়াস্ত পরিশ্রম করছি,সেটাও ওকে বুঝতে দিইনি,কেননা তাতে ওর লেখা পড়ার মনোযোগে বিঘ্ন ঘটতে পারে। এমনকি আমার কঠিন শ্রমে আয় করা অর্থে গড়া কোম্পানিতে,আমার বন্ধু মামুন ও ছোট ভাই কোকোকে শেয়ারও দিলাম। ওই অতটুকুন বয়সে। যা ভাবলে আমি নিজেও আজ শিহরিত হয়ে যাই যে,ওই অতটুকুন বয়সে কোত্থেকে আমি অতোটা,একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় দিলাম”!
প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান এর বক্তব্য শুনে,অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক কিছুক্ষণ হতবিহ্বল ভাবে,প্রধানমন্ত্রী জনাব তারেক রহমান এর দিকে তাকিয়ে থাকলেন এবং চোখের কোন মুছলেন। প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান একেবারে নিরাবেগ বসে থাকলেন। তিনি অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক এর পায়ের উপর,হাত রেখে সালাম করার ভঙ্গিতে বললেন, “স্যার,আপনি আমার জন্য দোয়া করবেন। এটুকুই যথেষ্ট। আপনার কাছে আমার এটুকুই চাওয়া”।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বললেন, “আমি অত্যন্ত দুঃখিত। আপনার বেদনাদায়ক অতীতে আপনেরে ফিরাইয়া নিছি বইল্যা। অহনে চলেন আপনে আমার লগে বইয়া একডা মজার খাওন খাইবেন। আমাগো কেরানীগন্জ এলাকার পপুলার খাওন। পান্তা ভাতের লগে মুড়ি মাইখা গরুর গোস্তো বা ভাজা ইলিশ দিয়াও খাইবার পারেন। আবার আপনে গুড়,নারকেল দিয়া কচলাইয়া- রসালো কইরাও খাইবার পারেন,আবার হালকা ভেজা ভেজা শুকনাও খাইবার পারেন- মন যেমুন চায়। হেরপর কতা কমুনি। অহনে আপনের কতা হুইন্যা আমার মনডা উতলা অইয়া গ্যাছে। প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান ডাইনিং টেবিলে এসে অবাক হলেন। যেখানে তাঁর নিজের বাসায় এখনও, বাবার সময়ের মতোই এক তরকারি,ভাজি,ডাল বা সব্জি নিত্যদিনের আহার।
সেখানে গরুর কালো ভুনা,ঝোল ঝোল গরুর মাংস,খাসির রেজালা,খাসির কোর্মা,মুরগির রোস্ট,আলু দিয়ে রান্না করা মুরগির মাংস,সরিষা ইলিশ,কড়া করে ভাজা ইলিশ,কড়া ভাজা পরোটা,আটার রুটি,চাউলের রুটি,পান্তা ভাত,গরম ভাত,কোরানো শাদা দবদবে নারকেল,খেজুরের কালচে মরচে পড়া গুড়,আখের লালচে চাকা গুড়। সব পরিবেশন করা হয়েছে।
সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো,যে আইটেম গুলো গরম হয়,তার প্রতিটা খাবারের উপর থেকে ধোঁয়া উড়ছে। আপ্যায়ন ও অভ্যর্থনায় যুক্ত সকলে খেতে বসলে,প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান স্যারের প্রিয় কেরানীগন্জের,পান্তা ভাতের উপর মুড়ি পাতে নিয়ে বললেন, “স্যার,যদি অনুমতি দেন তবে,আমার ড্রাইভার ও সিকিউরিটি গার্ডকেও ডাকি। আমি অফিসে বলেন বাসায় বলেন ওরা উপস্থিত থাকলে, আমি ওদের সহযোগে এক সাথে বসে খাই,পরিবারের সদস্যদের মতো করে। যদি কারও আপত্তি না থাকে”।
তিন.
ডঃ কামাল হোসেন বললেন, “না না আপত্তি থাকবে কেনো? কোন অসুবিধা নেই”।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক ডাইনিং টেবিলে বসে, প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমানের দিকে,ভাবালু মুখাবয়বে তাকিয়ে থাকলেন। অস্ফুট স্বরে আবারও বললেন, “আমরা শাদা চোউকে যা-ই দেখি। তা-ই সব না”।
সলিমুল্লাহ খান যেয়ে ড্রাইভার ও সিকিউরিটি গার্ডদের,ডেকে নিয়ে এলে তারা সহ অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক,সরদার ফজলুল করিম,শিল্পী এস এম সুলতান,প্রফেসর আনিসুজ্জামান,ডঃ কামাল হোসেন,আহমদ ছফা,হুমায়ুন আজাদ,সলিমুল্লাহ খান সকলে এক টেবিলে বসে খাওয়া দাওয়া করছেন। খেতে খেতে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমানকে লক্ষ্য করে বললেন, “এতো কম খাইতাছেন ক্যান? সব পদ থেইক্কা,এট্টু এট্টু কইরা অন্তত চাইখা লন। আপনে স্বাস্থ্য সচেতন বুঝলাম। দুই একবেলা বেশি খাইলে মোডা অইবেন না। হেইডা পরের বেলায় কম খাইয়া রেশনিং কইরা লইবেন। আমি ডঃ কামাল হোসেন সা’বরে খাওয়াইয়া আনন্দ পাই। উনি মাশাল্লাহ রুচি নিয়া খান। হুনেন দুন্যায় প্রভাব প্রতিপত্তি,ধন সম্পদ সব রাইখা যাইবেন। এই যে খাইতাছেন এই গুলাই শুধু কব্বরে লইয়া যাইবেন”।
বলে নিজে স্মিত হাসলেন অন্য সকলেও হাসলো। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক নিজে খুব কম খান। কোন কোন পদ নিজে রান্না করেন। আয়োজন বড়ো করে করেন। কারণ তিনি তার পছন্দের লোকজন নিয়ে খেতে পছন্দ করেন। তার জীবনে এই একটাই একমাত্র বিলাসিতা। সেজন্য আয়োজন বড়ো করে করতে হয়। প্রায় নিত্যদিন। সব পদের কাঁচামাল তিনি নিজে যোগান না। যারা মেহমান হয়ে আসেন তাদের মধ্যে থেকে অতি ঘনিষ্ঠ,অনেকে অনেক পদের কাঁচামালের যোগান দেন। যাহোক খাওয়া পর্ব শেষ। আবার রুমে এসে আলাপচারিতা শুরু হলো। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বললেন, “আচ্ছা আপনে আমারে কন তো আপনের নামের লগে,খাম্বা শব্দডারে যুক্ত কইরা ক্যান রাজনীতিবিদরা নানান রহম কতা কয়”?
প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান বললেন, “আ্ম্মা তখন দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী। দেশের বিদ্যুৎ খাতের তখন বেহাল দশা। আম্মা বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নিলেন। নতুন পাওয়ার প্লান্ট স্হাপনের পরিকল্পনা নেয়া হলো। আমি আমার ব্যাবসায়িক বুদ্ধিতে বুঝতে পারলাম। আমলারা ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দিচ্ছেন। পাওয়ার প্লান্ট হলেই তো হবে না। বিদ্যুৎ প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছাতে হলে সঞ্চালন লাইন লাগবে। বৈদেশিক মুদ্রার সংকুলান হলে রাতারাতি পাওয়ার প্লান্ট করা যায়। কিন্তু সঞ্চালন লাইন অতো সহজ নয়। শত শত কিলো সঞ্চালন লাইন,টাকা হলেই রাতারাতি করে ফেলা সম্ভব নয়। এটি একটি ধীর প্রক্রিয়া।
কাজেই এই উদ্যোগের বিষয়ে তাদের ঢিলেঢালা পরিকল্পনা দেখে,আমি আম্মাকে সহ সংশ্লিষ্ট সকলকে এর গুরুত্ব বোঝাতে সক্ষম হলাম। তারা দ্রুত টেন্ডার আহ্বান করলো। আমিও টেন্ডার ড্রপ করলাম এবং সর্বনিম্ন দরপত্র বিবেচনায়,আমার মালিকনাধীন প্রতিষ্ঠান “খাম্বা লিমিটেড” এই কাজ পেলে,আমি আর আমার বন্ধু প্লাস ব্যাবসায়িক পার্টনার মামুন মিলে,বিদেশি বিশেষজ্ঞ এনে দিনরাত পরিশ্রম করে,খাম্বা তৈরি করতে লাগলাম। অতি দ্রুত সেই খাম্বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাঠাতেও লাগলাম,যাতে করে তীব্র বিদ্যুৎ সমস্যার দ্রুত লাগব হয়। এটাই স্যার আমার নামের সাথে খাম্বা নাম যুক্ত হওয়ার কারণ।
এটা ইতিবাচক না নেতিবাচক সেই বিচার,আমি জনগণের হাতে সোপর্দ করলাম। এই বিষয়ে আমি কারও সম্পর্কে তিক্ত কোন মন্তব্য করতে রাজি না। কে বা কারা এই প্রসঙ্গে,আমার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছে? কি উদ্দেশ্য? যদিও আমি তা জানি তবে এখন না। সময় হলে সব বলবো”।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বললেন, “আমি আপনেরে কই,আপনে কি হুনছেন? শেখ কামাল বাংলাদেশ ব্যাংক ডাকাতি করবার যাইয়া গুলিবিদ্ধ অইছে”?
প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান বললেন, “জ্বি স্যার শুনেছি। বহুবার বহু জায়গায়”।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বললেন, “আসল ঘটনাডা জানেন”?
প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান বললেন, “না স্যার,কিন্তু কৌতুহল ছিলো। আপনি কি স্যার আসল ঘটনা জানেন”?
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বললেন, “জানি কিছুডা। আপনেরও জাননের কাম আছে। এই বিষয়ডা জানলে আপনে সতর্ক অইবার পারতেন। ভবিষ্যৎ রাজনীতিবিদরা সতর্ক অইবার পারবো। আপনে হেই সময় সতর্ক অইলে আইজ আপনের মুহে,ঘটনা যা হুনলাম পাবলিকে আপনেরে,ভুলেও খাম্বা তারেক কইবার পারতো না। হুনেন নেরেটিভ ক্যামনে খাড়ায়! শেখ কামাল বন্ধু বান্ধব লইয়া ফুর্তি করবার বারাইছিল সন্ধ্যার পর। এদিকে শেখ সা’ব সর্বহারার প্রতাপে অতিষ্ঠ অইয়া,সন্ধ্যার পরে চলাচল সীমিত কইরা দিছিল। এই অবস্থায় কামডা দেহেন শেখ কামাল বন্ধু বান্ধব লইয়া,ফুর্তি করতে করতে যাইয়া মাত্র,মতিঝিল বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে শাফলা চত্বরের কাছে পৌঁছাইছে আর,অমনি পুলিশ ভাবলো সর্বহারাগো গাড়ি। আর যায় কই? সরাসরি গাড়ি লক্ষ্য কইরা পুলিশের গুলি।
আরোহী হগলে আহত। অপারেশন শেষে পুলিশ আউগাইয়া আইয়া দেহে,গুলিবিদ্ধ অইয়া শেখ কামাল ও হের বন্ধু বান্ধবরা গোঙ্গাইতাছে। খবর চল্যা গেল আইজি বরাবর। আইজি মাহবুব শেখ সা’বরে ঘটনা কইলে শেখ সা’ব কইলো “কামালরে কাইট্যা বুড়ি গঙ্গায় ভাসাইয়া দে। আমি হের মুখ দেখবার চাই না”। ঘটনা কি ঘটলো? আর পাবলিক কি রটাইলো? অহনো পাবলিকের মুখে হুনবার পাইবেন,শেখ কামাল বাংলাদেশ ব্যাংক ডাকাতি করবার যাইয়া গুলিবিদ্ধ অইছে। ঘটনাডা কইলাম ক্যান? কিছুই ধোঁয়াসা রাখন বালা না। ধোঁয়াসায় ঘটনা ও কতা ডালপালা ছড়ায়। তার আগেই যদি ঘটনাডা আপনে বিবৃতি আকারে অউক,আর সংবাদ প্রকাশের মধ্য দিয়াই অউক,প্রচার মাধ্যমে খোলাসা করবার পারতেন তাইলে,আজ এই খাম্বা তারেক কেউ কইবার পারতো না”।
প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান বললেন, “আবার স্যার,সমাজে কিছু লোক আছে রিউমারস ছড়িয়ে আনন্দ পায়। একটা সময়ে এই রিউমারস প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়”।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বললেন, “হাছা কইছেন। আপনে রাজনীতিবিদ কাজেই জানবার পারেন যে,ইন্দিরা গান্ধী তার ছুডো পোলা সঞ্জয় গান্ধীরে, উড়াজাহাজ দুর্ঘটনার নাটক কইরা হত্যা করছে। অথচ হগল প্রচার মাধ্যমে এইডা পরিষ্কার কইরা কইছে যে,স্বেচ্ছায় নিজ উদ্যোগে বিমান চালানোডা আছিলো সঞ্জয় গান্ধীর হবি। তেমনি একদিন বেন বেলা সেই হবির অংশ থেইক্কা,বিমান চালাইতে যাইয়া যান্ত্রিকত্রুটি বা ভুল বশত কারণেই,প্রশিক্ষক সমেত ঘটে হের মর্মান্তিক দুর্ঘটনা জনিত মৃত্যু। তাইলে কি অইলো? এইডার থেইক্কা বুঝতে অসুবিদা অয় না যে,অনেক সময় পাবলিক আপনেগো রাজনীতিবিদগো,আসল ঘটনাডারেও বিশ্বাস করবার চায় না।
ওই যে বেনজির ভুট্টো একই কায়দায় ধরাশয়ী। তার ভাই মর্তুজা ভুট্টো-রে গুলি কইরা,মারলো কোনো উগ্রবাদী কিংবা সন্ত্রাসী চক্র। অথচ দেহেন পাবলিকের মুহে মুহে হুনবেন যে,বোন বেনজির ভুট্টো তার ক্ষমতা আরোহনের পথ,নিষ্কণ্টক রাখনের লাইগা ভাই মর্তুজা ভুট্টো-রে,হত্যা করাইছে সন্ত্রাসী চক্র ভাড়া কইরা। এর লাইগাই কয়,পাবলিকের মুখ বাইন্ধা রাখন যায় না। কিভাবে যে কোন খবর ছড়াইয়া পড়বো,কেউ অনুমান করবার পারে না। এই প্রসঙ্গে আপনেরে জিগাই মতিলাল নেহেরুর নাতিন,আর জওহরলাল নেহেরুর মাইয়া ইন্দিরা, গান্ধী উপাধি ধারী অইলো কেমনে হেইডা জানেন”?
প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান বললেন, “না স্যার। তবে আমার ধারণা ওনার স্বামী ফিরোজ গান্ধীর পদবি, নামের শেষে যোগ করে তিনি গান্ধী পদবি ধারী হয়েছেন”।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বললেন, “আরে নাহ। ফিরোজ তো ফার্সি ধর্মাবলম্বী,হেয় গান্ধী উপাধি পাইবো কই? মূল ঘটনা অইলো ইন্দিরা,ফিরোজের লগে সম্পর্কে জড়াইয়া গেলে,নেহেরু মহাত্মা গান্ধীর শরণাপন্ন অইলেন ইন্দিরারে বুঝাইবার লাইগা। ইন্দিরারে বুঝাইবার গেলে ইন্দিরা বরং তাঁর বুদ্ধির বলে,গান্ধীরেই পটাইয়া ফালাইলো। ইন্দিরার পরিকল্পনায় গান্ধী ফিরোজরে,দত্তক পুত্র হিসাবে আইনীভাবে সিদ্ধ কইরা লইলো। এতে কইরা ফিরোজ ফার্সি মহাত্মা গান্ধীর,পালিত পুত্র অইয়া ফিরোজ গান্ধী বইন্যা গেলো। হেরপর মহাত্মা গান্ধীর পালিত পুত্র ফিরোজ গান্ধীর লগে,জওহরলাল নেহেরুর মাইয়া ইন্দিরার বিয়া অইলো। এমনি কইরা ইন্দিরা নেহেরু অইলো ইন্দিরা গান্ধী”।
প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান বললেন, “স্যার,ভেরি ইন্টারেস্টিং এন্ড সিনেমাটিক লাইফ হার”।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বললেন, “আপনের আম্মারে আমি বয়সে ছোট বইল্যা স্নেহ করি। আবার বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাঁর,চার দশকের লাগাতার অবদানের লাইগা,তাঁরে আমি সম্মানও করি। অহনে আপনের আম্মার শইল্যের কি হাল”?
প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান বললেন, “স্যার,আমার আম্মা শুধু আমার আম্মা না। আমার আম্মাও আবার আব্বাও। আমার আম্মা কখনো আমাদের দুই ভাইকে, আব্বার অভাব অনুভূব করতে দেননি। এটা আমার আম্মার অসাধারণ কৃতিত্ব। আমার এমন শক্ত মনের আম্মা আজ বহু বছর,বিছানায় শুয়েবসে দিন কাটাচ্ছেন। খুব পীড়াদায়ক। যা আমাকে প্রতিনিয়ত তাড়িত করে বেড়ায়।
আমার যে আম্মা একটা সময়ে এই বাংলাদেশের রাজপথ কাঁপিয়ে দিয়েছেন,সেই আম্মা এখন নিশ্চল। তাঁর হাত বেঁকে গেছে। আর্থাটিক্সে পা-ও অনেকটা নিশ্চল। জড়তা নিয়ে কথা বলেন। কাঁপা কাঁপা স্বরে আমার মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করেন। এটুকুই শান্তনা যে,আম্মা বেঁচে তো আছেন। কতগুলো বছর জেলের একাকীত্বে কাটিয়েছেন। আমার আম্মার জীবনটা খুব কষ্টের জীবন। আপনি স্যার দোয়া করবেন। আমার আম্মা যেন বেঁচে থাকে। আমার মৃত্যুর পর যেন আমার আম্মার মৃত্যু হয়”।
প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমানের বক্তব্য শুনে মন কিছুটা আদ্র হয়ে গেলো। তবু আবেগ সংবরণ করে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বললেন, “আচ্ছা আমার মনে একডা কিউরিসিটি যে,লোকে বলে আপনে নিজ উদ্যোগে, অপেক্ষাকৃত নিচ থেইক্কা কয়েকজন,জেনারেলরে ডিঙ্গাইয়া মঈন ইউ আহমেদরে,আপনের আম্মা কতৃক সেনা প্রধান করাতে,অন্তরালে ভূমিকা রাখছেন। কতাডা কি হাছাই”?
প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান বললেন, “স্যার,এই বিষয়ে উত্তর দেয়ার আগে,আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করি? সিনিয়রদের ডিঙিয়ে সেনা প্রধান করা,সেটা কি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে সেবারই প্রথম”?
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বললেন, “নাহ। তা অইবো ক্যান? আপনের আব্বা সিনিয়র অইবার পরেও তো, শেখ সা’ব আপনের আব্বার থেইক্কা,একাডেমিক পরীক্ষার রেজাল্টে জুনিয়র,শফিউল্লাহকে সেনা প্রধান করছে”।
প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান বললেন, “তাহলে আমার ভুলটা কোথায়? সেনা প্রধান একটি রাজনৈতিক বিবেচনা। ক্ষমতাসীন সরকার যাকে তাদের,বিশ্বাস ভাজন মনে করবে তাকে সেনা প্রধান করবে”।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বললেন, “বুঝলাম মঈন ইউ আহমেদ আপনের,নানার বাড়ির অঞ্চলের লোক বইলা,বিশ্বাস ভাজন অইছে দেইখা,ওনারে সেনা প্রধান করছেন। কিন্তুক তিনি কি আপনেগো,বিশ্বাস রক্ষা করবার পারছেন”?
প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান বললেন, “হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সাহেবকে আমার আব্বা,বিশ্বাস ভাজন মনে করে সেনা প্রধান করেছেন। তিনিও কি বিশ্বাস রক্ষা করছেন স্যার”?
চার.
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বললেন, “আপনের প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব আমারে মুগ্ধ করছে। আপনে বাবা মায়ের যোগ্য সন্তান অইছেন দেইখা দিলখোশ অইছে। তয় আপনে আমারে কন তো,এই যে আপনের নামের লগে,হাওয়া ভবনেরও একডা তকমা লাগছে। এইডা ক্যান অইলো এট্টু কইবেন”?
প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান বললেন, “স্যার,আমি আগেও বলেছি অন্তরালে থেকে,আম্মাকে অর্থনৈতিক ও পরিবারের হাল ধরে সাপোর্ট করেছি বলে,আম্মার তৎকালীন রাজনীতিতে শীর্ষ স্হানে আসতে অনেকটা সহায়ক হয়েছে। তদ্রূপ আম্মা যখন দ্বিতীয় মেয়াদে,প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন তখন আমি,যথেষ্ট বড় হয়েছি। যদিও আমি তখন সেই বয়সেই একজন,ঝানু ব্যাবসায়ী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছি। কিন্তু এও বুঝতে পারি আমাকে অচিরেই আব্বার সৃষ্টি করা ও আম্মার এতদিন ধরে গড়ে তোলা,রাজনৈতিক দল বিএনপির হাল ধরতে হবে।
তারই অংশ হিসেবে ব্যাবসাকে রাজনীতি থেকে আলাদা রাখতে,যখন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য আলাদা কার্যালয় খোঁজ করছিলাম। তখন বিএনপি থেকে নির্বাচিত এমপি আলী আজগর লবি সাহেব, তাঁর মায়ের নামে নামকরণ করা বনানীর “হাওয়া ভবন” নামক বাড়িটি,আমার রাজনৈতিক কার্যালয়ের জন্য ভাড়া দিতে সম্মত হলেন। আমি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার নিমিত্তে বাড়িটি ভাড়া করি। যে হাওয়া ভবনের কথা,আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,এটাই সেই হাওয়া ভবন। সেখানে কি রাজনৈতিক কর্মযজ্ঞ হতো তার,একটু বর্ণনা আপনার জ্ঞাতার্থে স্যার আমি দিতে চাই।
সেই কার্যালয়ে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের ছাত্রত্ব শেষ হওয়া,কতিপয় বিশ্বস্ত ও মেধাবী ছাত্র নেতাদের নিয়ে,একটি গবেষণা সেল করি। আব্বার আদর্শকে সামনে রেখে। আমার আব্বা আগে গবেষণা করতেন,তারপর রাজনীতিটা করতেন। তিনিই সর্বপ্রথম বাংলাদেশে নিজ রাজনৈতিক দলের রাজনীতিবিদদের,রাজনীতি শেখার জন্য ক্লাস করানো শুরু করান। আমিও তদ্রূপ আব্বার থিমকে সামান্য,এদিক সেদিক করে গবেষণা সেল করলাম। ছাত্রদলের মেধাবী নেতাদের এসাইনমেন্ট লিডার পদবি দিয়ে,তাঁদেরকে আমার সামর্থ্য অনুযায়ী মাসিক সম্মানি ধার্য করে,একেবারে প্রফেশনাল রাজনীতির সূচনা করলাম।
দেশের প্রতিটি বিভাগ,প্রতিটি জেলা,প্রতিটি জেলাশহর,প্রতিটি উপজেলা,প্রতিটি পৌরসভা,প্রতিটি ইউনিয়ন,প্রতিটি ওয়ার্ড,প্রতিটি গ্রামে কারা বিএনপি করে? কারা অন্য দল করে? তার একটি পরিসংখ্যান দাঁড় করালাম,এই হাওয়া ভবনের মাধ্যমে কাজ করে। এমনকি বিএনপি যারা করে গ্রাম থেকে জেলা ও জেলাশহর পর্যন্ত। প্রত্যেকের নাম মোবাইল নাম্বার সমেত ডাটাবেইজ সংরক্ষণ করলাম। অতঃপর আমি ব্যাক্তিগত ভাবে প্রায় প্রত্যেকের সাথে,কয়েক মাস ধরে পর্যায়ক্রমে ফোনে কথা বললাম। এই কাজের কল্যানেই পরবর্তী কালে,লন্ডনের নির্বাসিত জীবনেও পূর্ণ উদ্যোমে আমার,সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে বেগ পেতে হয়নি।
এতে করে সহজে নেতা কর্মীদের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করতে পেরেছিলাম। হাওয়া ভবনের মাধ্যমে এই একটি,জটিল প্রক্রিয়া সুসম্পন্ন করে সেই সময়ে,বিএনপির ইউনিয়ন প্রতিনিধি সম্মেলনের আয়োজন করলাম। সেই সম্মেলনে আম্মা ছিলেন প্রধান অতিথি। অসাধারণ সাফল্য অর্জন করলাম। ব্যাবসায়িক সাফল্য অর্জনের পর,এই একটি সাফল্য আমাকে প্রচন্ড রকম তৃপ্তি দিলো। সবচেয়ে বড়ো কথা হলো,এরপর আম্মা আমার রাজনৈতিক দক্ষতার উপর আস্থা রাখলেন। আমার বিশ্বাস এই আস্হার নিরিখেই আম্মা আমাকে,আব্দুল মান্নান ভুঁইয়া মহাসচিব থাকা কালে ২০০২ইং সালে,বিএনপির স্হায়ী কমিটির অনুমোদন সাপেক্ষে,১ম যুগ্ম মহাসচিব এর দায়িত্ব অর্পণ করলেন।
আমি মনে করি এই হাওয়া ভবনের মাধ্যমে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে,সম্পৃক্ত হয়ে সফলতা অর্জন করতে না পারলে,কঠিন প্রিন্সিপালের মানুষ আম্মা আমাকে,এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল করতেন না। আমিও আজ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারতাম না। প্রধানমন্ত্রী না হলে আপনার সাথে দেখা হতো না। এই সব কিছুর মূলে হাওয়া ভবনের অবদান। কেউ এটাকে নেতিবাচক ভাবে দেখলো না ইতিবাচক ভাবে দেখলো,এটার আমার কাছে একেবারেই গৌন বিষয়। এই হাওয়া ভবন আমার রাজনৈতিক জীবনের টার্নিং পয়েন্ট স্যার”।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বললেন, “আমি আপনেরে শেখ কামালের জীবন থেইক্কা,আরেকডা উদাহরণ দিই। নেরেটিভ কেমনে খাড়ায়! আপনে হুনছেন নিশ্চয়ই শেখ কামাল,মেজর ডালিমের বউরে ভাগাইয়া নিছে বা হাইজ্যাক করছে বইল্যা,মেজর ডালিম শেখ সা’বরে হত্যা করছে। হাছা কিনা কন”?
প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান বললেন, “জ্বি স্যার,ছোট সময়ে স্কুলে বন্ধু বান্ধবের কাছে ফিসফিস করে শুনেছি। আর্মি পরিচালিত স্কুলে পড়েছি। তাই এই বিষয়ে ভয়েও কথা বলিনি। অত ছোট বয়সে বড়দের বিষয়ে নাক গলিয়ে,ইঁচড়েপাকা হতে চাইনি বলে,শুনেও কানে তুলিনি। কৌতূহল এখনও আছে আপনি বললে,আসল ঘটনা জানতে পারি”।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বললেন, “তাইলে হুনেন,ঘটনা ঘটছিলো এক্কেরে উল্টা। অর্থাৎ রেড ক্রিসেন্টের হেই সময়ডায়,চেয়ারম্যান আছিল গাজী গোলাম মোস্তফা। হেয় আছিল শেখ সা’বের খাস লোক। তাই গাজী-রে রেডক্রিসেন্টের চ্যায়ারম্যান করছিল। যেহেতু হেই সময় সদ্য স্বাধীন যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ বইল্যা,ব্যাপক বিদেশি রিলিফ আইতাছিল। তার লাইগা নির্ভরযোগ্য বিচারে,শেখ সা’ব অতি বিশ্বস্ত গোলাম মোস্তফারে,রেডক্রিসেন্টের চেয়ারম্যান বানাইলো। হেয় করছে শেখ সা’বের আমানতের খেয়ানত। হেশে শেখ সা’ব দুঃখ কইরা কইলো, “সবাই পায় সোনার খনি। আমি পাইছি চোরের খনি”। আবার কইলো, “সাড়ে সাত কোটি মানুষের,সাড়ে সাত কোটি কম্বল আইছে। আমারটা কই”?
এক্কেরে দুঃখের কথা। তয় এইডা ছিল তহনকার বাস্তবচিত্র। এই রেড ক্রিসেন্টের ট্যাকা লুটপাট কইরা, গাজী গোলাম মোস্তফার আঙ্গুল ফুইল্যা কলাগাছ। তহনকার জাঁকজমকপূর্ণ অফিসার্স ক্লাবে,হের ছেলের রাজসিক বিয়ার আয়োজন করে। হেই বিয়াতে বরপক্ষে অউক আর কনেপক্ষে অউক,গেছিল সস্ত্রীক মেজর ডালিম। হেইহানে মেজর ডালিমের বউরে লক্ষ্য কইরা,কারা যেন টিজ করছিল। এইডা হুইন্যা মেজর ডালিম গেলো খেইপ্যা। এইডা লইয়া হেশে গাজী গোলাম মোস্তফার ছেলেপেলে ও তারগো সাঙ্গো পাঙ্গোগো লগে অইলো,মেজর ডালিমের কতা কাডাকাডি। এমনকি হালকা ঠেলা ধাক্কা-ধাক্কিও অয়। মেজর ডালিম আর শেখ কামাল অইলো বন্ধু।
মেজর ডালিম মাতা গরম কইরা হেয়ানতে সরাসরি, বত্রিশ নম্বরে যাইয়া শেখ কামালরে লগে লইয়া,গাজী গোলাম মোস্তফার ছেলেপেলে ও তারগো লোকজনের বিরুদ্ধে শেখ সা’ব এর কাছে নালিশ করলে,শেখ সা’ব এইডারে তেমন গুরুত্ব দেয় নাইক্কা। আসলে দেওনের মতন কিছুও না। আমার কতা অইলো হেই ঘটনা কেমনে কইরা,ঘটনা পুরা উল্টাইয়া গিয়া পাবলিক নেরেটিভ খাড়া অইছে দেহেন! আপনে নিজে যেই বর্ণনা দিলেন আর,পাবলিক হাওয়া ভবন লইয়া যা কয়,এক্কেরে আকাশ পাতাল তফাত।
তহন তাৎক্ষনিক প্রচার মাধ্যমে খোলাসা করবার পারলে,লর্ড ক্লাইডের নামের লগে কাসিম বাজার কুঠির নাম,যেমনে লেপ্টে গেছে। হাওয়া ভবনের নাম,আপনের নামের লগে,তেমনি লেপ্টাবার পারতো না। হের লাইগা আমি কই,ট্রান্সপারেন্ট থাকনডা বালা। ঘটনা ডালপালা ছড়ায় না। অহনে ইনফরমেশন টেকনোলজির যুগ। আপনে হাছা মিছা কতা কইয়া, পার পাইবার পারবেন না। পাবলিক ঠিকই খুঁইজ্যা সত্যডা বাইর করবো। হেইকালে টেকনোলজি অতোডা ডেভেলাপ আছিলো না। অহনে আপনে হাছাডা কন ট্রান্সপারেন্ট অইলে পাবলিক মাইন্যা নিব। হেরা “হাওয়া ভবন” কি “খাম্বা” কুনোডা লইয়াই প্রশ্ন উডাইবো না।
তয় আবার আপনেরা যারা পাবলিক ফিগার,তাগোরে লইয়া নানান কল্প কাহিনি জুটাইয়া,পাবলিকে মজা লয় আনন্দও পায়। হেইকাল এইকাল হগল কালে। আরবার আপনে বিষয়ডা পাবলিকরে যতই,ট্রান্সপারেন্ট কইরা বুঝান,হেয় উল্টটা বুইঝ্যা লয়। আপনে বহু বছর লন্ডনে নির্বাসনে আছিলেন। আপনে হুনবার পারেন ইংলিশ চ্যানেলের টানেলে,সজোরে ধাক্কা খাইয়া পাপারাজ্জিদের ফলো থেইক্যা বাঁচতে,বেসামাল দ্রুত গতির গাড়ি ধুমড়াইয়া মুচড়াইয়া,প্রিন্স চার্লসের ডিভোর্সী বউ প্রিন্সেস ডায়না রোড এক্সিডেন্টে,তার বয়ফ্রেন্ড দোদি আল ফাহাদ সহ স্পট ডেড অইছে। হাছা কিনা কন”?
প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান বললেন, “জ্বি স্যার,এটাতো বহুল আলোচিত দিবালোকের মতো স্বচ্ছ ঘটনা। ঘটেছেও পাপারাজ্জিদের অনুসরণ থেকে বাঁচতে,তাদের তাক করা ক্যামেরার সম্মুখে”।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বললেন, “এইবার কন! আপনে দুইন্যার হগল দেশে যাইয়া,তৎকালীন পাবলিকরে জিগান। কইবো রাজ পরিবারের সম্মান অক্ষুণ্ন রাখনের লাইগা,প্রিন্সেস ডায়নারে চক্রান্ত কইরা রাণী এলিজাবেথ,সুক্ষ্ম পরিকল্পনায় রোড এক্সিডেন্ট কইরা মারাইছে। কইলাম এই কারণে যে,আপনেরা পাবলিক ফিগারগো,হগল কামে সতর্ক থাইকাও,রেহাই নাও অইবার পারে। আপনে সমালোচনারে ছাইড়া দিলেও,সমালোচনা আপনেরে নাও ছাইড়া যাইবার পারে”।
প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান বললেন, “স্যার,আমরা রাজনীতি করে তাহলে কি অপরাধ করলাম”?
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বললেন, “আরে না ভাইঙ্গা পইড়েন না। এইডারে কয় খ্যাতির বিড়ম্বনা। এই বিড়ম্বনা আপনের একার না। এডাই বুঝাইবার লাগছি”।
প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান বললেন, “স্যার,এই বিড়ম্বনা যে কতোটা বিব্রতকর তা,ভাষায় প্রকাশ করার মতো না”।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললেন, “আচ্ছা,কেউ কেউ কন আপনের,আব্বা ও আম্মা তারা পরস্পর নাকি পূর্ব থেইক্কা আত্মীয়? কতাডা কি হাছাই”?
প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান বললেন, “কথা সম্পূর্ণ সত্য স্যার। আমার দাদী ও নানী পরস্পর খালাতো বোন। সেই হিসেবে আমার আব্বা ও আমার আম্মা, নিজেরাও পরস্পর খালাতো ভাই-বোন”।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বললেন, “আচ্ছা,আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লগে,আপনের বিরোধটা অইলো ক্যামনে? আপনের প্রতি তাঁর এতো আক্রোশ ক্যান? আপনি তার লগে বিবাদডা মিট্যা ফেলবার উদ্যোগ নিছিলেন? না নেন নাই”?
প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান বললেন, “স্যার,সাবেক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে,আমার বিরোধ পূর্ণ সম্পর্ক কেন হবে? উনি আমার আম্মার সমবয়সী কাজেই আমি উনাকে,আমার আম্মার সমানই সম্মান করি। একটুও কম না”।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বললেন, “তাইলে বিরোধডা কোত্থেইকা জন্মাইলো? আপনের কি অনুমান”?
প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান বললেন, “স্যার,বিষয়টি আমাকেও ভীষণ ভাবায়। তবে আমার ধারণা ২১শে আগষ্টের গ্রেনেড হামলা থেকে,এই বিরোধটার জন্ম। যদিও স্যার আমি দৃঢ় ভাবে বলছি,এই গ্রেনেড হামলার সাথে আমি,কোনো ভাবেই জড়িত নই। আরেকটি কারণও থাকতে পারে”।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক আগ্রহী হয়ে বললেন, “কি সেই কারণ”?
প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান বললেন, “সাবেক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা,আমার আম্মাকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করতেন। আমি আমার আম্মার সন্তান হিসেবে ব্যাবসায় বলেন,রাজনীতিতে বলেন যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছি। অন্যদিকে তাঁর ছেলে জয় অতোটা জীবনে সফল হতে পারেনি। এখানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমার আম্মার কাছে,হেরে গিয়েছেন ভেবে আমার বিরুদ্ধে,বিষোদগার করে আমাকে ও আম্মাকে হেয় করে,রাজনৈতিক ভাবে কোনঠাসা করতে চেয়েছিলেন। তবে আমি এর জন্য বিন্দুমাত্র বিচলিত নই বরং গর্ববোধ করি। ওনার প্রতি আমার অন্তরের অন্তস্তল থেকে সম্মান অব্যাহত ছিলো। ওনি আমাকে বকাঝকা না করলে আমি হয়তো,আজকের অবস্থানে আসতে পারতাম না। ওনারা অভিভাবক। ওনারা আমাকে বকাঝকা করার অধিকার রাখতেন”।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বললেন, “অপনের সব থেইক্কা আনন্দের দিন কোনডা”?
প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান সময় ক্ষেপণ না করে মুহূর্তেই বললেন, “যেদিন আমার আম্মা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। সেদিন। তিনি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন,সেজন্য না। তিনি রাজনীতিতে সফলতা অর্জন করেছিলেন সেজন্য। রাজনীতিতে তার অহর্নিশ অমানুষিক আত্মত্যাগের,উত্তম প্রতিদান পেয়েছেন বলে। তিনি তৃপ্ত হয়েছেন বলে। আব্বার অসময়ে মৃত্যুর পর তিনি কেবল,জীবনে কষ্টই পেয়েছেন তো”।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বললেন, “আপনের সব থেইক্কা কষ্টের দিন কোনডা”?
প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান ভাবলেশহীন ভাবে বললেন, “যেদিন আমার ছোট ভাই কোকো মৃত্যু বরণ করে সেদিন। আমি ছোটো ভাই না,আমার সন্তানের মতো করে,তাকে বড় করেছি। যদিও ওর আর আমার বয়সের ব্যাবধান মাত্র পাঁচ বছর। তখন আমি লন্ডনে নির্বাসিত জীবন যাপন করছি। লন্ডনে তখন গভীর রাত,যখন ওর মৃত্যুর সংবাদ শুনলাম। মালয়েশিয়ার হাসপাতালে সে মারা গিয়েছে। তারপর এক সপ্তাহ আমি ঘুমাইনি”।
প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান এর এই সকরুণ উচ্চারণে,উপস্থিত সকলের চোখ অশ্রু সজল হলো। একজন রাজনীতিবিদকে হতে হয় দৃঢ় চিত্ত। তাঁকে থাকতে হয় ভাবলেশহীন। তাঁর দুর্বলচিত্তের বহিঃপ্রকাশ,জনসম্মুখে উন্মোচন করা যাবে না। তাঁকে হতে হয় মানবিক,দুঃখ বেদনার উর্ধ্বে উঠে অনুভূতিহীন পাথর। প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান রাষ্ট্র বিজ্ঞানের এই সূত্র মেনে,থাকলেন রক্ত মাংসের মানুষের ভাবাবেগ মুক্ত। একেবারে নিরুদ্বেগ শুষ্ক চোখে নির্বিকার। (চলবে)
বি.দ্র. ইহা উপন্যাস। আদৌ কোন সাক্ষাৎকার গ্রন্হ নয়। ইতিহাস গ্রন্হও নয়। জ্ঞানতাপস অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক সম্রাট আকবরের অর্থানুকুল্যে ও উজিরে আজম বৈরাম খান এর ঐকান্তিক ইচ্ছায়,পবিত্র মক্কায় হজ্বে গমন করবেন। সেই উপলক্ষ্যে তাঁর সাথে নানান শ্রেণি পেশার মানুষ,যারা তৎকালীন রীতি অনুযায়ী,অনেকটা শেষ সাক্ষাৎ করতে ও আশীর্বাদ নিতে এসেছেন। সাক্ষাৎপ্রাথীদের সাথে তাঁর ইহা কাল্পনিক কথোপকথন মাত্র। বর্তমান ও ঐতিহাসিক বাস্তব ব্যাক্তি ও স্হানের কিছু নাম ভিন্ন বাস্তবতার সাথে,এই উপন্যাসের কোনো চরিত্রের লেশমাত্রও সম্পর্ক নেই। এই উপন্যাসে অতীত বর্তমান ভবিষ্যত একাকার। আশা করি সম্মানিত পাঠক কালোত্তীর্ণ হয়ে,নিজ বিবেচনায় সারমর্ম হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হবেন।
পুনশ্চঃ হুমায়ুন আহমেদ তার “দেয়াল” উপন্যাসের ভূমিকায় লিখেছেন,এই উপন্যাস পড়ে কোন পক্ষই খুশি হবেন না। আমি বলছি,আমার এই অধ্যায় পড়ে, কোনো পক্ষই অখুশি হবেন না।
Leave a Reply