জাপানের যাপিত জীবন – ১
ছোটবেলার কথা। একদিন মাথার উপর দিয়ে একটা প্লেন উড়ে যায়। মা আমায় জিজ্ঞেস করে – বাবা তুমি বড় হয়ে কী হবে? আমি এদিক তাকাই ওদিক তাকাই, বড় হলে কি হবো- খুঁজে পাইনা। মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম। আশেপাশে সব জীবন সংগ্রামে পর্যুদস্ত মানুষের ভিড়। অবশেষে কিছু না বুঝেই বলে ফেলি -মা, বড় হলে পাইলট হবো ।
এর পর বহু প্লেন মাথার উপর দিয়ে উড়ে যায়। একদিন আমি দৈর্ঘ্যে বড় হই। যাত্রী হয়ে প্লেনে চড়ার সুযোগ আসে। আমি জানালার পাশে বসে আকাশ দেখি, মেঘ দেখি, ক্রম ক্ষুদ্র হয়ে আসা জনপদ, আঁকাবাঁকা রেখার মতো নদনদী, সবুজাভ অনাবিল প্রকৃতির শোভা দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। এ যেন আমার মধ্যবিত্ত জীবনের স্বপ্ন। মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছিলেম । হঠাৎ করে মনে হলো কে যেন ডাকছে। স্বপ্ন ও বাস্তবতার মাঝে নিজকে বুঝে নিতে একটু সময় লাগে। সামনে দেখি খাবার হাতে এয়ার হোস্টেস। মধ্যবিত্ত হবার গুনে আমার আত্মসম্মান জ্ঞান টনটনে। আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি কে কেমন করে খাচ্ছে। অনুকরণ ও অনুসরণ করতে যেয়ে কি খাচ্ছি তা বুঝতে পারিনে । সব পথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে এক ভুল করে ফেলি। সবুজ রঙের চা কে অত্যন্ত নিজের ভেবে দুধ চিনি দিয়ে রীতিমতো কালচে করে মুখে তুলতে যেয়ে সহযাত্রীদের কৌতূহলী চোখ ও মুখের বিচিত্র অভিব্যক্তি দেখে গুটিয়ে যাই নিজের মধ্যে । মনে পড়ে যায় চাংপাই এ প্রথম চাইনিজ খাবার কথা। সেদিনও এমনি করে কিছু মানুষ মুখ চেপে হেসেছিল। আমি কি করে জানবো জলের গ্লাসের উপর সাজিয়ে রাখা লেবুর টুকরোটা খাবার জন্যে নয়।
আমি আমার অজ্ঞানতার গ্লানিতে নিজের দিকে তাকাতে পারি না। নিকষ কালো অন্ধকার চিরে প্লেন উড়ে চলছে। জনপদের ক্ষীণ আভাটাও গেছে মুছে। মনটা নৈরাশ্যে ভরে যায়। একে একে মনে পড়ে প্রিয়জনের মুখ। শূন্যতার এ বিশালত্বের মাঝে আমি আশ্রয় খুঁজি। হঠাৎ করে মেঘের ফাকে অনন্ত গভীরে একটা পাহাড়ের চূড়া আমার মনটা ভালো করে দেয়। আমি আবারও ফিরে আসি প্রকৃতির মাঝে । অন্তহীন দেখার খেলায় মেতে উঠি। আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়ে উঠে নীলাভ জলরাশি, তার মাঝে মাথা উঁচিয়ে দাড়িয়ে থাকা উঁচু নিচু পাহাড় আমায় স্বাগত জানায় সূর্যোদয়ের দেশে।
মুহূর্তের মধ্যে Immigration শেষ হয়ে যায়। বাইরে বেড়িয়ে আসি। একটা অস্বস্তি কাজ করে। কোথায় যাবো, কিভাবে যাবো? বেশ কিছু জাপানিজ হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে পড়ে বাংলায় আমার নাম লেখা এক প্ল্যাকার্ড। একজন বৃদ্ধ আমার নাম ধরে ডাকছে ‘ ইরাশাই মাছে , সুশীরও সান ‘ । আমি কাছে গিয়ে দাঁড়াই । বৃদ্ধ মাথা অবনত করে বারংবার বলে চলছে ‘ ইয়কোছ নিহন এ ( অভিবাদন জাপানের মাটিতে )। মুগ্ধ হই বৃদ্ধের ব্যবহারে। বৃদ্ধ আমাকে একটা ট্যাক্সিতে চড়িয়ে দিয়ে হাতে এক লেফাফা গুজে দেয়। ট্যাক্সিতে আমার সহযাত্রীও বাঙ্গালী, আমাদের গন্তব্য, ওসাকা গাইককু দাইগাকু (Osaka University of Foreign Studies) । ট্যাক্সি আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে ছুটে চলেছে। প্রকৃতি অকৃপণ হাতে ছড়িয়ে রেখেছে তাঁর সৌন্দর্যের বৈভব। যেদিকে চোখ যায় অফুরন্ত রঙের ছড়াছড়ি। প্রকৃতির এ নিরাভরণ রূপ বেশিক্ষণ সহ্য করা যায় না। কিছু কিছু সৌন্দর্য আছে যা হৃদয় মনকে শান্ত সমাহিত করে। কিছু সৌন্দর্য অনুভূতিকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে যায় যেখানে থাকে শুধু অনন্ত শূন্যতা, একটা বেদনা দায়ক একাকীত্ব বোধ। এ অফুরন্ত সৌন্দর্যের মাঝে নিজকে বড় বেশী অপাণন্তেয় মনে হয়। হঠাৎ করে চোখ যায় ট্যাক্সির মিটারে। এক মুহূর্তে বাস্তবতায় ফিরে আসি। মধ্যবিত্তের চির-সঙ্গী দুশ্চিন্তা এসে ভর করে। লেফাফাতে যা আছে তাঁর চেয়ে অনেক বেশী ইয়েন মিটারে দেখাচ্ছে। এখনো কত পথ বাকী জানিনে।
অবশেষে সর্পিল পাহাড়ি পথ বেয়ে আমরা পৌঁছে যাই Dorm এ। ট্যাক্সি ড্রাইভার সযত্নে দরজা খুলে দেয়। মুহূর্তে কে বা কারা আমাদের ব্যাগগুলো নিয়ে যায়। পরে জানতে পারি ওদের মধ্যে আমাদের Dorm এর Director Dr. তানাকাও ছিলেন। ট্যাক্সি ড্রাইভার তাঁর শুভ্র দস্তানা পড়া হাতটা বাড়িয়ে দেয়। গভীর শঙ্কায় হাত মিলাই। কতো যে বিল এসেছে সেই দুশ্চিন্তায় মনটা ভরে আছে। তাই ওর সায়নারার উত্তর দিতে একটু দেরী হয়। ততক্ষণে ট্যাক্সি ঢালু পথে বেয়ে অনেকটা চলে গেছে। বুঝতে পারিনি লেফাফার ইয়েন আমাদের পকেট মানি। মনটা একটা অস্বস্তিতে ভরে যায়- ড্রাইভারটাকে হাসি মুখে বিদায় দিতে পারিনি বলে।
Leave a Reply