পৃষ্টপোষক/পেট্রন অর্থনীতি:
“আসসালামু আলাইকুম, আক্তারুজ্জামান মামা বলছেন?”
সালাম দিয়ে নাম-সম্পর্ক উল্লেখ করে ফোন, অর্থাৎ পরিচিত লোকের ফোন। “মামা” ডাকটি যে এক্কেবারে রক্তের মামা, তা কিন্তু সঠিক নয়। আমরা অনেকসময় “মামা” ডাকি কাউকে আদর/আবদার করে। তবে রিক্সাওয়ালাকে বা হলের ডাইনিং এর পাশের পান-সিগারেট বা মুদির দোকানীকেও “মামা” বলে ডাকে অনেকে। এতেও আদর/আবদার/জড়িত।
রিক্সাওয়ালাদের ডিমান্ড প্রচুর, বেশি ভাড়া হাকায়, কাংখিত গন্তব্যে যেতে চায়না, কথা শুনতে চায়না। তাই, আবদার করে মামা ডেকে রিক্সাওয়ালাকে নিয়ন্ত্রনে আনার চেষ্টা করে অনেকে বিশেষ করে বুদ্ধিমান ও বুদ্ধিমতিরা। সেই ভাবেই হলের “মামা’ বলা। বাকি খেতে হয়, প্রায়ই।
ব্যচমেটদের মধ্যে “মামা” ডাক প্রচলিত আছে। অতিরিক্ত ডিআইজি @ Mozid Ali কে মামা বলি চাকরির শুরু থেকেই। ২০১৩ সালে আমি পিরোজপুরের এসপি আর আ: মজিদ মামা ঝালকাঠির এসপি। পিরোজপুর থেকে বরিশাল আসার পথে মামার অফিস বাসা, ফোন করে রওয়ানা এবং মামার বাসায় নাস্তা, লাঞ্চ করে বরিশালের কাজ। দুই জেলার সকল শ্রেনীর লোকজন জানত আমরা আপন মামা-ভাগিনা। মামা পিরোজপুর যেতনা বেশি, বাট আমি ঘন-ঘন যাতায়ত করতাম ঝালকাঠি। ঝালকাঠির টোল্পপাজা থেকে চানাচুর বিক্রেতা সবাই আমাকে মজিদ মামার ভাগ্নে হিসেবে দুই-চার টাকা ছাড় দিত ভাগ্নে হিসেবে। যাক, মামা এখন অনেক দূরে। তাই মামার জন্য গান,
“মামা, তুমি আজ কত দূরে, আখির আড়ালে চলে গেছো তবু, রয়েছো হ্রদয় জুড়ে”।
যাক, ফোনে ফিরে আসি।
“হ্যা, বলছি, ওয়া আলাইকুম সালাম, বলেন কি খবর”
“মামা, আমি আপনাদের পাশের ইউনিয়নের আপনার বন্ধু অমুকের ভাইগ্না। আপনার ফোন নং কষ্ট করে জোগার করছি অমুক মামার কাছ থেকে” অনেক তরতিব করে বলে যাচ্ছিল।
“ঠিক আছে, সবাই ভাল আছেন তো। আর কি জন্য ফোন করেছেন, বলেন দ্রুত”। অফিসের কাজে ব্যস্ত ছিলাম, তাই কাজের দিকেই টানছিলাম উনাকে।
“মামা, পুলিশ সদর দপ্তরের একটি পদে এপ্লাই করেছিলাম। তোলারাম থেকে বিএসসি অনার্স শেষ করেছি গত বছর। মামা, আমার চাকরিটা খুব দরকার। আপনি বলে দিলে হয়ে যেতে পারে। একটু বলে দিবেন কি?”।
“ঠিক আছে। শুনেন পুলিশের চাকরি এখন মেধা এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে হয়। এখানে সুপারিশে কাজ হয়না। মেধা আর যোগ্যতায় হয়। যোগ্যতা থাকলে কিছু লাগবেনা” বলেই ফোন রেখে দিতে চাইলাম।
“মামা প্লিজ, একটু চেষ্টা করেন। যাদের মামা আছে, তদবির আছে, তাদের চাকরিতো হচ্ছে।” যুক্তি দেখাচ্ছিল।
কি বলব তাকে, কিভাবে তাকে শান্তনা দিব,
“দেখেন, আমি আমার ২৪ বছরের কর্মকালে আমার কোন ভাই-বোন, ভাইগ্না-ভাগ্নি কে সরকারি চাকরি দিতে পারি নাই। আমি পারি নাই। আমি সরি। দোয়া রইলো আপনার জন্য” বলেই দ্রুত কেটে দিলাম ফোন।
আসলেই কি মামার জোড়ে বা সুপারিশে চাকরি হয়? আমি অদৃশ্যের খবর জানিনা, তবে তদবির বা সুপারিশ আছে, কাজও হচ্ছে। তবে, আমার তদবিরে কাজ হয় নাই।
তবে প্রায়ই চোখে পরে, কোন বংশের একজন কোন সরকারি চাকরি পেলে, বিদেশ গেলে, লাভজনক পদ/পদবি পেলে, ব্যবসা শিখলে ঐ বংশের বা পরিবারের অনেকেই তাদের লাইনে শাইন করতে থাকে। পুলিশের এক ভাই/বোন কং পদেও চাকরি পেলে তার দুই/চার ভাই-বোনকে কিভাবে জানি সরকারি চাকরিতে নিয়ে আসে। ভাগ্যের মালিক তাদের বাড়ি চিনে যায়। জানিনা কিভাবে এই সম্পর্ক হয়ে যায়। এক বংশে বা পরিবারে ২০/৫০ জন সরকারি চাকরি করে এমন উদাহরন আছে।
আর উন্নতি হতেই থাকে বংশের। এহাই পৃষ্টপোষক বা পেট্রন অর্থনীতি। এতে সবার উন্নতি হয়না, হয় কিছু লোকের। পেট্রন মনে করে, সে যাকে চাকরি দিয়েছে, সে তার আনুগত্য করবে। দিন শেষে তা অনেক ক্ষেত্রেই হয়না। উপকারির অপকার করা আমাদের দেশে খুব রেয়ার নয়। প্রায়ই দেখা যায়।
পেট্রন যে খারাপ তা নয়, তারা চাকরি পেতে বা উন্নতি করতে যে যোগ্যতা দরকার তা বিকাশেও সাহায্য করে, পথ দেখায়। পেট্রনের দরকার আছে, বৈধ পৃষ্টপোষক খুব দরকার। দুর্বল গাছে সার-পানি দিলে ফলন বাড়ে, কিন্তু টেকসই হয়না। অন্যদিকে, শক্তিশালি গাছ অবহেলায় ফলন দিতে পারেনা। পৃষ্টপোষক অন্যের উন্নয়নের বিনিময়ে নিজের ক্লায়েন্টের উন্নয়ন করলে তা সুশাসনে বড় বাধা হয়ে দাড়ায়।
আমাদের দেশে পেট্রন অর্থনীতি ছিল, আছে এবং থাকবে। তাই, অনেকেই আমাদেরকে মেসেজ দেন, চিঠি দেন যাতে লিখা থাকে,
“আমি আপনার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকব”।
আসলে চিরকৃতজ্ঞ কেউ কারোও প্রতি থাকেনা, খুব রেয়ার। যদি থাকতো তাহলে শ্রষ্টা এবং মাতা-পিতার প্রতিই থাকত।
Leave a Reply