মতভেদ ও ভেদাভেদ
‘মতভেদ ও ভেদাভেদ’ শব্দ দু’টির সাথে আমরা সবাই কম বেশী পরিচিত। এই শব্দ দু’টির একটির সাথে অন্যটি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। যেখানে মতভেদ যত বেশী সেখানে ভেদাভেদ বিভেদ ও বিশৃঙ্খলা তত বেশী।
সকল ধর্মমতের মানুষের হয়তো একই বিশ্বাস যে মানব জাতির আদি পিতা মাতা হলো আদম ও হাওয়া। উনারা দুইজন যখন স্বর্গ থেকে মর্ত্যে অবতরণ করে বসবাস শুরু করেণ তখন তাঁদের মাঝে মতভেদ ভেদাভেদ ও বিভেদ বলতে কিছুই ছিলনা, থাকলেও হয়তো খুবই সামান্য ছিল। যুগ যুগ ধরে তাঁদের বংশধর বাড়তে বাড়তে সারা পৃথিবী ছেয়ে গেছে। এখন কোন কোন গ্রাম বা শহরে এত বেশী মানুষ যে সেখানে অনেকের মাথা গুঁজার ঠাঁই নাই, পথে ঘাটে এখানে সেখানে মানবেতর জীবন যাপন করে। কাজেই দেখা যায়, সময়ের সাথে তাল দিয়ে মানুষের সংখ্যা যতই বৃদ্ধি পাচ্ছে ততই মানুষের মধ্যে মতভেদ ভেদাভেদ ও বিভেদ ক্রমশই বেড়ে চলেছে।
মানুষে মানুষে ভেদাভেদ বিভেদ কিন্তু এক দিনে সৃষ্টি হয় নাই। মানুষের বুদ্ধিমত্তা বিকাশের সাথে সাথে নানান বিষয়ে চিন্তা ভাবনার বিকাশও ঘটতে থাকে। একটা প্রবাদ আছে- নানা মুনির নানা মন। বিভিন্ন মানুষের ভিন্ন রকমের চিন্তা চেতনা ও কথাবার্তার ধরণ থেকেই হয়তো এই চিরন্তন সত্য প্রবাদটির জন্ম নিয়েছে। এক এক জনের মতামতকে কেন্দ্র করে এক একটি সামাজ, গোষ্টি, দল বা এক একটি আলাদা জাতির জন্ম নিয়েছে। অনুরূপভাবে কারো কারো মতাদর্শের উপর ভিত্তি করে এক একটি রাজনৈতিক দল বা ধর্মীয় গোষ্টী বা সমাজ তৈরী হয়েছে। এই রাজনৈতিক ও সামাজিক দল এবং ধর্মীয় গোষ্টীগুলোর বিভিন্ন মতভেদের কারণে সৃষ্টি হয়েছে নানা মুখী সংগঠন যাদের পরস্পর বিরুধী সংঘাত প্রায়ই মারামারি কাটাকাটি ও হানাহানিতে রূপ নেয়।
কিছু কিছু ভেদাভেদ কিছু কিছু মানুষের ভিন্ন রকমের চিন্তা চেতনার ফসল, এখানে প্রকৃতির তেমন কোন প্রভাব নাই, এই ভেদাভেদগুলোকে জিয়ে রাখার জন্য কিছু কিছু রীতিনীতিকেও ব্যবহার করা হয় যেমন মুসলিম পুরুষগন মাথায় টুপি এবং মহিলাগন মাথায় হিজাব পড়ে তাদের পরিচয় ধরে রাখেন, হিন্দু সম্প্রদায়ের পুরুষগন ধূতী ও ব্রাম্মনগন পৈতা পড়ে এবং মহিলারা কপালে তিলক দিয়ে তাদের পরিচয় তুলে ধরেন, ইহুদী পুরুষগন মাথার তালুতে পিন দিয়ে আটকে ছোট্ট একটি গোল টুপি পড়ে তাদের পরিচয় বহন করে। গায়ের রং এক হলেও আফ্রিকার কোন কোন দেশে জাতিগত পরিচয় ধরে রাখতে দুই গালে দু’টি করে কাটার দাগ বসিয়ে দেয়, মহিলাদের নীচের ঠোঁট লম্বালম্বিভাবে কেটে চির করে দেয়। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ রাজনৈতিক কারণে হলেও এর পিছনে মূল কারণ হলো জাতিগত ও ভাষাগত বৈষম্য বা ভেদাভেদ। ইযরায়েল- প্যালেষ্টাইন যুদ্ধের মূল কারণ হলো জাতিগত ভাষাগত ও ধর্মীয় ভেদাভেদ। এই যুদ্ধে কতগুলো প্রাণ অকালে ঝরে গেল, আরো যাবে, কত মানুষ গৃহহীন হয়ে খোলা আকাশের নীচে মানবেতর জীবন যাপন করছে, খাবার নেই, পানি নেই, ক্ষুধার জ্বালায় খাবারের সন্ধানে নিরীহ মানুষগুলো এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে, তাদের কান্না আহাজারীতে গগন বিদীর্ণ হচ্ছে। সভ্য পৃথিবীতে মানুষের একি দুর্ভোগ।
কোন কোন ভেদাভেদ তৈরী হয় একেবারেই নিছক জেনেটিক(Genetic) ও প্রাকৃতিক(Natural) কারণে যার উপর মানুষের ভিন্ন চিন্তা ভাবনার কোন প্রতিফলন নাই যেমন কোঁকড়ানো চুলওয়ালা কালো রংয়ের মানুষ এবং সোজা চুলওয়ালা সাদা বা ফর্সা রংয়ের মানুষ। এই ফর্সা কালো ভেদাভেদ বাংলাদেশ পাক-ভারত উপমহাদেশে ছেলেমেয়েদের বিয়ে সাদীকে সাংঘাতিকভাবে প্রভাবিত করে, গরীব পিতামাতাগন কালো রংয়ের মেয়েকে নিয়ে অনেক দুর্ভোগে পড়েন, অনেক ক্ষেত্রেই বিয়ে সাদী বিলম্বিত হয়। আমার গায়ের রং কালো হওয়াতে আমিও প্রত্যাখ্যাত (Rejected) হয়েছি এবং আমাকেও নানান পরিস্হিতির শিকার হতে হয়েছে।
আমরা সবাই একই আল্লাহ খোদা ভগবান ঈশ্বর সৃষ্টিকর্তার তৈরী সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদই কাম্য নহে। ইহা হিংসা বিদ্বেষ ছড়ায় এবং মানুষের দু:খ দুর্দশা বাড়ায়, পৃথিবীকে অশান্ত করে তুলে। তাই আসুন, আমরা সবাই সব রকমের ভেদাভেদ ও বৈষম্যকে গুরুত্ব না দিয়ে সকল ধর্মের সকল বর্নের সকল রাজনৈতিক দলের মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সহনশীল হয়ে সুন্দর সুখী ও শান্তিময় জীবন যাপন করার প্রতি মনোনিবেশ করি।
Leave a Reply