ইব্রাহিম-৫
প্রাচীন মেসোপটেমিয়ানরা বহুশ্বেরবাদে বিশ্বাসী ছিলো। প্রতিটি জিগুরাট ও মন্দিরেই ছিল বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ, যেমন ধনি-দরিদ্র, ব্যাবসায়ী, কামার-কুমার, মজুর ও কৃষক শ্রেণীর লোকেদের বসার ব্যাবস্থা। মানুষদের দেবতা ছিল যথাক্রমে আকাশ, বাতাস, পৃথিবী ও সমুদ্র। বিশ্বাস ছিল এরাই চাঁদ, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্রের নিয়ন্ত্রক।
এই মেসোপটেমিয়াতেই ইব্রাহিম আঃ, প্রায় চার হাজার বছর পূর্বে জন্মগ্রহন করেন। জন্মস্থান ছিল বাগদাদ থেকে ৩৯৬ কিলোমিটার দূরে ‘উর’ শহরে। সেখানে বসবাস করত
তখন কালেডীয় জাতি।
উরের রাজা ছিল নমরূদ। ভীষণ উদ্ধত আর অহংকারী। অন্যান্য কৃষি অঞ্চলের রাজাদের মতো, সেও নিজেকে ‘উপাস্য’ দাবী করতো। একদিন রাজজ্যোতিষী ভবিষ্যৎ বানী করল যে, রাজ্যে অচিরেই একটি পুত্র সন্তান জন্মলাভ করবে, যার কারণে তিনি রাজ্য হারাবেন। কথাটি শুনে নমরূদ, রাজ্যের সকল শিশুপুত্রকে হত্যার নির্দেশ জারি করেন।
নমরূদের প্রধান পুরোহিত, আজরের স্ত্রী ছিল সন্তানসম্ভবা। আসন্ন সন্তান প্রসবের কথা চিন্তা করে তিনি লুকিয়ে গুহায় চলে গেলেন। সেখানেই তিনি প্রসব করলেন ফুটফুটে এক সন্তান। নমরূদের লোকজনের কাছে ধরা পড়লে নিশ্চিত মৃত্যু। তাই জেনেশুনেই তিনি নিজ সন্তানকে গুহায় রেখে গেলেন, এতে কিছুটা হলেও বাঁচার আশা থাকে।
গুহাটি পাথরের তৈরী হলেও সেখানে ছিল একটি ঝর্ণাধারা। এক কোনায় পানি জমা হতো। জীবন ধারণের জন্য নূন্যতম পানীয় সুবিধা থাকায় শিশুকাল পার হলে বাঁচার আশা অবশ্যই আছে ভেবে, মা মাঝে মাঝে লুকিয়ে এসে দেখাশুনা করে যায়। এভাবে শিশুটি একা একাই বড় হতে থাকে গুহাতে। তবে প্রতিমুহুর্তে থাকত ধরা পরে যাবার ভয়।
এভাবে দিনের পর দিন বড় হতে থাকে শিশুটি। পার হয়ে যায় তিনটি বছর। গুহার বৈরী পরিবেশে মানসিক বৈকল্যতা নিয়ে শঙ্কা থাকলেও বাস্তবে দেখা গেল অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা তাঁর। কথায় কথায় সে একদিন মা’কে জিজ্ঞেস করলঃ
মা, আমার প্রভু কে?
মা উত্তর দিলঃ
নমরূদ।
শিশুটি বললঃ
নমরূদের প্রভু কে?
প্রশ্ন শুনে মা ভড়কে গিয়ে চড় মারলেন শিশুটির গালে। ঠিক কোন কারণে চড় খেল, শিশুটি তা বুঝতে না পারলেও, মা ঠিকই বুঝলেন এই শিশুটিই হল সেই ছেলে, যার সম্পর্কে নমরূদ স্বপ্ন দেখেছিলেন!
ইব্রাহিম-৬
শিশুটির পিতা ছিল নমরুদের প্রধান পুরোহিত। তবে তাঁর প্রধান পেশা ছিল মূর্তি বানিয়ে বাজারে বিক্রি করা। আর মানুষেরা এই মূর্তিগুলোই ক্রয় করে তাদের পূজা করতো।
ছেলের জন্মতে আজর ছিল খুশি। তিনি ভাবলেন; আমার পর এই ছেলে হবে একদিন পুরোহিত, রক্ষা করবে বংশের ঐতিহ্য। খুশিতে আজর পুত্রের নাম রাখলেন ইব্রাহিম।
ইব্রাহীমের জ্ঞান-বুদ্ধি দেখে অবাক হয় আজর। মনে মনে স্বপ্ন দেখে ছেলে তাঁর চেয়েও ভাল মূর্তি বানাবে, তাঁর চেয়েও সুনাম ছড়িয়ে পড়বে। অপরদিকে ইব্রাহিমের স্বপ্ন ছিলো একদিন তাঁর বাবা আর মূর্তি তৈরী করবে না, তাঁর পূজা করবে না। একই ঘরে দুইজন মানুষ দুই বিপরীতমূখী স্বপ্ন দেখে বড় হতে লাগল।
দিনে দিনে ইব্রাহিমের ভাবনা পরিপূর্ণতা পেতে লাগল। তিনি ভাবেন, যারা কারো উপকার করতে পারে না, যারা কারো অপকারও করতে পারে না, তারা খোদা হয় কেমন করে? আবার
দেবতাগুলি নিজেকে রক্ষাও করতে পারেনা যদি কেউ ক্ষতি করতে চায়।
সৃষ্টিকর্তা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিলেন, তাঁর উপর সহীফা অবতীর্ণ হয়। এতে তাঁর জ্ঞানচক্ষু খুলে যায়। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, সৃষ্টিকর্তা নিয়ে মানুষের ভুল ভাঙ্গতে হবে।
একদিন তিনি তাঁর বাবাকে বললেনঃ
বাবা, আপনি এবং আপনার জাতির লোকেরা পরিস্কার ভুলের মধ্যে আছেন।
আজর সরাসরি ইব্রাহিমের দিকে না তাঁকিয়ে কান খাড়া করল, ছেলে বলে কি!
যে শোনে না, যে দেখে না এবং যে কারও উপকার করতে পারে না, আপনারা কেন সেই মূর্তির পূজা করেন, বললেন ইব্রাহিম।
সমাজপতিদের অনেকেই উপস্থিত ছিল। ইব্রাহিমের কথা শুনে তাঁরা হতবুদ্ধি হয়ে গেল।
ইব্রাহিম আরও বললঃ
আমার কাছে এমন জ্ঞান এসেছে, যা তোমার কাছে আসেনি। অতএব তুমি আমাকে অনুসরণ কর, আমি তোমাকে পথ দেখাব।
কথাশুনে সমাজপতিরা ভয়ংকর রেগে গেল। এসব কি বলে ইব্রাহিম!
জীবনভর তাঁরা মূর্তিপূজা করে এসেছে। তাঁদের জীবনের অংশ হল এই মূর্তি। তাঁদের আনন্দ-বেদনার অংশ হল মূর্তি। আজ এসব কি শুনছে!
সবাই আজরের মূখের পানে চেয়ে যেন বুঝিয়ে দিতে চাইল তাঁদের মনোভাব। আজরের দারুণ মানসম্মানে লাগল। সে ক্রুদ্ধ হয়ে বললঃ
ইব্রাহীম!
তুমি যদি কথা বলা বন্ধ না কর, তবে আমি পাথর মেরে তোমার মাথা ভেঙ্গে দিব। আজ থেকে তুমি আর আমার সাথে থাকবে না।
পিতার কথায় ইব্রাহীম বললেনঃ
বাবা, তোমার উপর শান্তি বর্ষিত হৌক! আমি আমার পালনকর্তার কাছে তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব।
তুমি এখান থেকে চিরতরে বিদায় হয়ে যাও! চীৎকার করে উঠল আজর।
আমি পরিত্যাগ করছি তোমাদেরকে এবং আল্লাহ ব্যতীত তোমরা যাদের পূজা কর তাদেরকে, বলে সেখান থেকে বের হয়ে গেল ইব্রাহিম।
সমাজপতিরা ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর গমন পথের দিকে তাঁকিয়ে রইল।
Leave a Reply