“শয়তানি” অর্থনীতি
“স্যার, আপনার একজন গেস্ট আসছে “নিলয়” নামে”। অফিস সহকারি জানাল আমাকে অফিসে ঢুকার সাথে সাথেই।
“কই আমারেতো কেউ ফোন দেয় নাই। কোত্থেকে এসেছে? কখন এসেছে?” কিছুটা আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলাম। কারন বর্তমান কর্মস্থলে তেমন কোন পাবলিক ফাংশন নাই। আর কাউকে দেখা করতে হলে গেইট থেকে অনুমতি নিতে হয়। তার কোনটাই হয়নি!
“স্যার, অনেক আগেই আসছে, খুব জরুরি নাকি!” অফিস সহকারি খুব জোড় দিয়ে বলল। ভাবটা এমন যেন সে বিষয়টা জানে।
“আচ্ছা, আসতে বল”
মুহুর্তেই রুমে প্রবেশ করল অতিথি। চেনা মনে না হলেও তিনি নিজেকে আমার অনকে পরিচিত বললেন। যাই হউক সালাম, শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর আলাপ শুরু।
উনারা ৭ ভাই, ৩ বোন। তিন ভাই মাওলানা, তিন ভাই বিদেশ থাকেন (একজন ইতালি, দুই জন মধ্যপ্রাচ্যে)। এক ভাই করেন গার্মেন্টসের ব্যাবসা। গ্রামে থাকেন দুই বোন এক ভাই। সে ভাই আবার বাহিনীর চাকরি করেন, বর্তমানে অবসরে আছেন। মাওলানা সাহেবগন বিভিন্ন জেলার মসজিদে ইমামতি করে কর্মস্থলেই থাকেন।
বেশ ভালই দিন কাটছিল তাদের। আয়-উন্নতি, সুনাম সবই ছিল। গ্রামে তাদেরকে সবাই সহজ সরল ভাবে।উনাদের বাবাও আলেম ছিলেন। কিন্তু সমস্যা বেধেছে অন্য জায়গায়। মেঝো বোনের বিয়ে হয়েছিল তাদের আপন চাচাতো ভাইয়ের সাথে। চাচাতো ভাইয়েরা গ্রামে খুব শক্তিশালি, বিভিন্ন প্রকারের শক্তি আছে তাদের। একসময় তারা বেশ দুর্বল ছিল, পেশায় ছিল কৃষক। আর এখন অনেক প্রকারের অদৃশ্য ব্যাবসা।
বছর দশেক আগে মা মারা যাওয়ার পর তাদের জমিজমা ভাগের প্রশ্ন আসে। সে যেহেতু বাহিরে থাকে, জমির কাগজ প্যাচ তেমন বুঝেনা। তার বাবা তার চাচার কাছে অনকে জমি কিনেছিল, বসত ভিটার একবড় অংশ। নগদ টাকা দিয়েছিল, জমি দখলে নিয়েছিল তার বাবা ১৯৮০’র দশকেই। কিন্তু, ছেলেমেয়েরা কৃষি কাজে আগ্রহি না থাকায় সেজমি আবাদ করতো চাচা, পরে চাচাতো ভাইয়েরা।
জমি ভাগাভাগির সময় দলিল দেখাদেখি হয় নাই। জাস্ট একটা মৌখিক ভাগাভাগি। এবার বছর চারেক আগে “নিলয়” সাহেব মধ্যপ্রাচ্য থেকে এসে তার গ্রামের জমি বিক্রি করতে গিয়ে দলিলের খোজ নেয়।জানতে পারে, মুল দলিলে মালিক চাচা এবং চাচাতো ভাইয়েরা রয়ে গিয়েছেন। মেঝো বোনের চাচাতো ভাইয়ের সাথে বিয়ে হওয়ায় সে ক্ষমতা খাটাচ্ছে, চাচাতো ভাইদের কথায় সায় দিচ্ছে। কারন তার লাভ বেশি। এটা নিয়ে পরিবারে অনেক ঝামেলা হয়েছে। কিছু একটা কথা কাটাকাটি হলে বড় বড় ধারায় মামলা হচ্ছে তার বিরুদ্ধে, অন্য ভাই-বোনদের বিরুদ্ধে। বাহিনির ভাইও ঐ বোনের পক্ষে কারন তার স্ত্রী চাচাতো ভাইদের পক্ষে। মামলা টামলা সামলাতে গিয়ে লাখ লাখ টাকা অপচয় হয়েছে।
কি কঠিন সমস্যা। ভাইয়েরা বিদেশ থেকে টাকা পাঠিয়েছে, গ্রামে জমি কিনেছে বাবা আর মেঝো বোন। সে শিক্ষিতা, গ্রামে সরকারি চাকরি করেন। লেখাপড়া শিখে এতটা খারাপ এবং লোভী হতে পারে তা তিনি বিভিন্নভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন।
নিলয় সাহেব ২০১০ এর দশকেই ঢাকার শহরতলিতে মাইগ্রেট করেন, তার দুই মেয়ের নিরাপত্তা আর কল্যাণে। বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ছোট মেয়ের বিয়ে নিয়ে কথা হচ্ছিল। এলাকার থেকে সম্পর্ক আসছে। ছেলে আমারিকায় থাকে, বেশ বড় মাপের রোজগার আছে তার। কিন্তু, এই বিয়েতে বাধ সাধছে তার মেঝোবোনের জামাই এবং মেঝোবোন। তার ছেলের সাথেই উনার মেয়েকে বিয়ে দিতে হবে। তার ছেলে এলাকায় ঠিকাদারি ব্যাবসা করে।
নিলয় কোন মতেই বোনের ছেলের সাথে তার মেয়েকে বিয়ে দিবেন না। কিন্তু, তারা তার মেয়ের এবং নিলয়ের সম্পর্কে খারাপ কথা ছড়াচ্ছে: তারা সন্ত্রাসী, অনেক মামলা আছে, মেয়ের চরিত্র ভাল না, ইত্যাদি। কি ভয়ানক সমসা!
৩০/৪০ বছর জমি ভোগ করেও নিজের জমির মালিকানা পাচ্ছে না, নিজের মেয়েকে নিজের ইচ্ছামত বিয়ে দিতে পারছেনা। জমি নাকি চাচাতো ভাইদের নামে মাঠ পর্চায়। এ নিয়ে মামলা করতে গিয়ে আরোও মামলায় জড়িয়েছে। অধিকার হারিয়েছে, অধিকার চাইতে গিয়ে মামলার শিকার হয়েছে। নিজের মেয়ের বিয়ে দিতে সমস্যা হচ্ছে, তাদের কাছে না দেওয়ায় মেয়ের নামে কলংক শুনতে হচ্ছে।
সবশুনে খুব খারাপ লাগছিল। ভাবছিলাম সবই মিথ্যে! ছেলেমেয়ে পালছি, বড় করছি। অথচ তারাই একসময় একে অপরের সাথে বিবাদে জড়াবে!
স্থানীয় ওসিকে ফোন দিলাম। ওসি বিষয়টা জানে। উনি শুনেই জানালেন যে, সমস্যাটা রাজনৈতিক এবং দলিল-পত্রের। পুলিশের সাধ্য নাই এই দুই প্রকার সমস্যা মিটানোর। উনি কথা দিলেন, সাধ্যমত চেষ্টা করবেন। অনেকে হয়তো বলবেন, “পুলিশ ইচ্ছা করলে সব পারে”। হ্যা, পুলিশ অনেক ক্ষেত্রে পারে তবে যদি দুই পক্ষের অন্তরে আলো বা মাথায় বিবেক থাকে, বা সহজ-সরল হয়। গরল লোকের সমস্যা পুলিশ সমাধান করতে পারে না, বরং নিজেই ভিক্টিম হয়ে যায় সমাধান করতে গিয়ে।
শয়তান অনকে শক্তিশালি, বিচক্ষন এবং দূরদর্শী। সে অনেক প্রত্যয়ী। সৃষ্টিকর্তার সাথেই সে তর্ক করেছে, চ্যালেঞ্জ ছুড়েছে যে, মানুষ কিভাবে সরল হয় তা সে দেখে নিবে। সে তার খেলা দেখাচ্ছে, এতে উজ্জীবিত হচ্ছে অর্থনীতি। আদালত, কৌশলি, ল-এনফোর্সার ইত্যাদির আয়তন, ক্ষমতা বাড়ছে এই শয়তানি অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে। বাড়ছে এক পক্ষের দুর্ভোগ, তবে সে পক্ষ দুর্বল পক্ষ। সবল পক্ষ আরও সবল হচ্ছে, শয়তানি অর্থনীতি পাচ্ছে উচ্চতর গতি এবং কাঠামো।
দারুন লেখা