পাহাড়টির নির্জনতায় মুগ্ধ সে। আরও মুগ্ধ গুহাটির অবস্থানের কারণে। যদি ভুলে কেউ পাহাড় চূড়ায় চড়েও বসে তাও গুহাটি নজরে পড়েনা। কারণ গুহাতে যেতে হলে চুড়া থেকে আবার এক দেড়শ হাত নীচের দিকে নামতে হয়।
ঝুঁকিপূর্ণ এ পথে মানুষতো দূরের কথা কোন জন্তু জানোয়ারও নামার সাহস করেনা। এখানে আসার পর থেকেই মোহাম্মদ সাঃ-এর চিন্তার জগতে আমূল পরিবর্তন হয়ে গেছে। বিরতিহীনভাবে তিনি চিন্তার অনেক গভীরে বিচরণ করতে পারে।
রাত্রি দ্বিপ্রহরে, ধ্যান ভেঙ্গে যায় তাঁর। বের হয়ে দাঁড়ান সামনের খোলা জায়গায়। এখানে দাঁড়ালে সম্পূর্ণ আকাশ দেখা যায় না। পাহাড় চূড়ায় উঠে এলেন, বসলেন উন্মুক্ত আকাশের নীচে। সমতল চূড়াটিকে বড়ই ভাল লাগে।
এখানে বসলে হৃদয় প্রশস্ত হয়, মন প্রাণ ভরে উঠে, তাই মাঝে মাঝেই এখানে বসেন। আকাশের তাঁরা মিটমিট করছে। অনেকক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে নক্ষত্রপুঞ্জ দেখতে লাগল মোহাম্মদ সাঃ। দেখতে দেখতে এক সময় নিজের অজান্তেই গভীর চিন্তায় ডুবে গেল।
গুহাতে এসে তিনি অনুভব করেন, কেন তাঁর পূর্বপুরুষ আব্দুল মুত্তালিব প্রায়ই এ গুহাতে অবস্থান করতেন! আত্মগ্লানি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য এ গুহাটি ছিল একটি আদর্শ জায়গা।
তবে মুত্তালিব যে কারণে এখানে আসতেন, তার সাথে মুহাম্মদ সাঃ-এর থাকার পার্থক্য আছে। মুত্তালিব নিজের মুক্তির জন্য থাকতেন, আর তিনি থাকা শুরু করলেন সকল মানবের মুক্তির জন্য।
মুক্তির উপায় তিনি জানেন না। উত্তর খুঁজেই চলছেন। কে মানুষের সৃষ্টিকর্তা।
আরবের সেই পূজিত দেবদেবীরা? নাকি খৃষ্টানদের পূজিত যীশু ? নাকি পারস্যের পূজিত আগুন।
তিনি অনুধাবন করতে পারেন যে এরা কেউ সৃষ্টিকর্তা নয়। তবে অনুধাবন করলেইতো আর হবে না! সঠিক উত্তর লাগবে!
কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা তা জানতে হবে। কিন্তু জানতে চাইলেইতো আর হবে না। কার কাছে জানতে চাইবেন তাও তো জানেন না তিনি!
সেই উত্তরদাতা কে হবে? কোথায় খুঁজে বেড়াবেন তাঁকে? কোন পথে খুঁজলে উত্তর পাবেন।
কিন্তু কোন কূলকিনারা পান না। ধ্যানমগ্ন থাকেন ঘন্টার পর ঘন্টা। চিন্তার শুরু আছে, শেষ নাই। ঠিক এমনই এক সময়ে হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন মোহাম্মদ সাঃ।
অগাষ্ট মাসের ১৭ তারিখ, সময় ২৭শে রমজান, শবে কদরের সময়। অমাবস্যার কারণে চারিদিক অন্ধকারে নিমজ্জিত। দূরে মক্কার ঘরবাড়ি হতে কিছু কিছু আলোক বিন্দু দৃশ্যমান। গুহায় বাতাসের শো শো আওয়াজ, ক্ষীণ হয়ে আসছে।
দীর্ঘ সময় পার হল, রাত গভীর, নিঝুম। দূরের আলো নিভূ নিভূ করতে করতে একসময় নিভেই গেল। বাতাসের শো শো আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেল। ঝি ঝি পোকার শব্দ, নিশাচর পাখির আওয়াজ থেমে গেল। পৃথিবী কিছু সময়ের জন্য হয়ে গেল শব্দহীন ও স্থির।
ধ্যানমগ্ন তিনি, শব্দহীন অবস্থা বুঝতে পারলেন না! গুহায় দ্বিতীয় একজন উপস্থিতি হল!
ধ্যান ভেঙ্গে সম্বিৎ ফিরে পেলেন। সম্মূখে রেশমী কাপড়ের উপর লেখা দেখলেন। কি লেখা বুঝতে পারলেন না। তবে একজনের কন্ঠস্বর শুনলেনঃ
পড়! তোমার প্রভুর নামে।
হতবুদ্ধি, মোহাম্মদ সাঃ বললেনঃ
আমি পড়তে পারি না।
তখন মানুষের অবয়বে জিব্রাইল আঃ তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন, এতো জোরে যে সহ্যের শেষ সীমা পর্যন্ত। তারপর তাঁকে ছেড়ে দিয়ে আবার বললেনঃ
পড়ো, তোমার প্রভুর নামে!
প্রচন্ড চাপে তাঁর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ছেড়ে দেওয়ার পর নিঃশ্বাস নিতে পারলেন। কি ঘটছে কিছুই বুঝতে পারলেন না। কোন রকমে তিনি বললেনঃ
আমি পড়তে পারি না।
আগন্তুক তাঁকে আবারো জোরে চেপে ধরলেন। সেই চাপে তাঁর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল, পৌঁছে গেলেন সহ্যের শেষ সীমানায়। তারপরই কোরআনের প্রথম আয়াত পড়লেন তিনি।
পড়ুন, আপনার প্রতিপালকের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন, সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট বাঁধা রক্তপিন্ড থেকে।
পড়ুন, আপনার প্রতিপালক মহামহিমান্বিত,
যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন,
শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে, যা সে জানত না।
সংবিৎ ফিরে পেয়ে তিনি ভয়ে থর থর করে কাঁপতে লাগলেন। অভিজ্ঞতাটি ছিল ভয়ংকর, বিশাল এক ধাক্কার মত। অজানা এক জগতে পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি।
অন্তরে গাঁথা আয়াত সমুহ নিয়ে গুহা থেকে বেরিয়ে আসলেন তিনি।
তিনি ভাবলেন তাঁকে বোধহয় জ্বীনেরা কাহিন ভেবে ভর করেছে!
আরবের কুখ্যাত জ্বীন উপাসকদের ‘কাহিন’ বলা হয়। হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন তিনি। উদ্দেশ্যহীন ভাবে দৌড়ে গেলেন পাহাড় চূড়ার দিকে।
মক্কা থেকে তিন মাইল দূরে নির্জন পাহাড়ে একাকী মোহাম্মদ সাঃ, টলায়মান শরীর নিয়ে উঠছেন পাহাড়ের গা বেয়ে। চারিদিক অন্ধকার। খাড়া পাহাড়, ফলে যেকোন কিছু ঘটার সম্ভাবনা ছিল।
ভয়ার্ত পরিবেশের মাঝেই তিনি উঠে গেলেন পাহাড়ের চূড়ায়। দূর থেকে বিন্দুর মত দেখা গেল তাঁকে, অসহায় তাঁর অবস্থা। আবার কন্ঠস্বর শুনতে পেলেনঃ
হে মোহাম্মদ, আপনি আল্লাহর পয়গম্বার!
আর আমি জিব্রাইল।
আকাশের দিকে তাকালেন, দেখতে পেলেন মানুষের রূপ ধরে দিগন্তে দাঁড়িয়ে আছে জিব্রাইল।
ব্যাপারটি ছিল বিমোহিতকারী এক বিশাল সত্ত্বার মুখোমুখি হওয়া, যা গোটা দিগন্তকে ঢেকে রেখেছিল। যার কাছ থেকে পলায়ন করা ছিল অসম্ভব।
আকাশের যে দিকেই তাকান সেদিকেই, আগের মতই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন জিব্রাইলকে।
তারপর দ্বিতীয়বার শুনলেনঃ
হে মোহাম্মদ! আমি জিব্রাইল!
আল্লাহর বাণীবাহক।
নির্জন চূড়ায় বিধ্বস্ত অবস্থায় একাকী দাঁড়িয়ে তিনি।
হেরা পর্বত থেকে কোনমতে বাড়ি আসলেন বিবি খাদিজার কাছে। কাঁপতে কাঁপতে খাদিজাকে বললেনঃ
জড়িয়ে ধর আমায়। জড়িয়ে ধরো আমায়।
ভয়ে খাদিজার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কি হয়েছে, কেন এরকম হল?
তবে কিছুই জিজ্ঞাসা করলেন না, বিচলিত হলেন না খাদিজা, ধৈৰ্য্য ধরে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে লাগলেন।
কম্বল দিয়ে জড়িয়ে দিলেন স্বামীকে। যতক্ষণ না কম্পিত দেহ স্থির হল, ততক্ষণ জড়িয়ে ধরে থাকলেন। প্রাণপ্রিয় স্বামী কম্পিত দেহে বলে যেতে লাগল তাঁর ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা।
খাদিজা তাঁকে অভয় দিতে থাকলেন, তাঁর আতংক দূর করার চেষ্টা করতে লাগলেন।
খাদিজা দূঢ় স্বভাবের স্বাধীনচেতা একজন রমনী। যার ছিল মোহাম্মদ সাঃ-এর উপর গভীর আস্থা। ওহী প্রাপ্তির পূর্বে ও পরে যিনি তাঁর স্বামীকে যুগিয়েছেন আত্মবিশ্বাস।
খাদিজার ছোট ভাই আওয়াম, বিয়ে করেছিলেন মোহাম্মদ সাঃ-এর ফুফু সাফিয়াকে। সাফিয়ার কাছেই তিনি মোহাম্মদ সাঃ-এর বাণিজ্যিক অভিজ্ঞতার কথা জানতে পারেন।
তাই তিনি মোহাম্মদ সাঃ কে তাঁর বানিজ্যিক প্রতিনিধিত্ব করার প্রস্তাব পাঠান।
সেই শুরু! এরপর দেখেই ভাললেগে গেল তাঁকে। তাঁর কর্মকান্ডে হয়ে গেল মন্ত্রমুগ্ধ। তারপর ভালবাসার ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হওয়া শুরু হল, ক্রমেই গভীর থেকে গভীরতর।
একসময় বিয়ে হয়ে গেল তাদের। বিয়ের পর সুখেই কাটতে লাগল জীবন। একসময়
বুঝতে পারলেন তাঁর স্বামী নির্জনতা পছন্দ করেন। গুরুত্ব দিলেন স্বামীর পছন্দকে। নিজে কষ্ট পেলেও মুখ ফোটে কখনোই কিছু বলতেন না স্বামীকে। অনেক ভরসা তাঁর স্বামীর উপর।
ধীরে ধীরে আরও নির্জনতা আরও ধ্যানপ্রিয় হয়ে উঠল তাঁর স্বামী। মাঝে মাঝেই থাকতে লাগলেন হেরা গুহায়। আজ রাতে তিনি যখন এসেছেন কাঁপতে কাঁপতে অসহায়ের মতো। তখন খুব কষ্ট পেলেন।
এ ধরনের চেহারা কখনও আগে দেখেননি। দৃঢ়চেতা একজন মানুষ এরকম হয়ে যাবে তা চিন্তাও করেননি তিনি।
তবে হাল ছাড়ার পাত্রী নন তিনি। জড়িয়ে ধরে আছেন তাঁকে, শক্ত করে। কোন অবস্থাতেই কোনরকম ক্ষতি হতে দিবেন না, তাঁর স্বামীর।
মোহাম্মদ সাঃ ঘুমিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে, খাদিজা রওনা দিয়েছিল ওয়ারাকার কাছে। তখনও চারিদিক অন্ধকারে নিমজ্জিত। সুবহে সাদিকের সময় আসন্ন।
খাদিজার বিশ্বাস ওয়ারাকা এই ঘটনার সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারবে। সেই সময় ধর্মীয় পুস্তক সম্পর্কে তাঁর চেয়ে জ্ঞানী গোটা আরবে আর কেউ ছিল না।
তাছাড়া, তিনি খ্রীষ্টান ও ইহুদী ধর্মীয় যাজকদের মত আশা পোষণ করতেন যে, মক্কা নগরীতে একজন নবীর আগমন হবে।
তাই খাদিজা যখন মোহাম্মদ সাঃ-এর সাথে হেরা গুহায় ঘটে যাওয়া ঘটনা খুলে বলল, তখন ওয়ারাকার দু’চোখে আনন্দাশ্রু দেখা গেল।
ওয়ারাকা বললঃ
খাদিজা তোমার কথা যদি সত্য হয় তবে হেরা গুহায় যিনি এসেছিলেন তিনি হল, ‘নামুস’। যার অর্থ অদৃশ্য উপদেষ্টা। যিনি এসেছিলেন মুসা আঃ ও ঈসা আঃ এর কাছে।
যে বাণী তিনি মোহাম্মদ সাঃ-এর কাছে এনেছেন, তা সম্পূর্ণ ঐশ্বরিক বাণী। আর সে অনুযায়ী মোহাম্মদ সাঃ হল নবুওত প্রাপ্ত শেষ নবী।
এ আমাদের পরম সৌভাগ্য, যে আরব ভূমিতে এই প্রথম একজন নবীর আগমন ঘটল।
খাদিজাকে ধর্মীয় ব্যাখ্যা শুনানির পর দৃঢ় স্বরে ওয়ারাকা আবার বললঃ
এ বিষয়ে তুমি কোনরূপ সন্দেহ পোষণ করো না। বাড়ি ফিরে গিয়ে যতদ্রুত সম্ভব তাঁকে আমার কথাগুলো বলবে।
ওয়ারাকা এখন বৃদ্ধ হয়ে গেছে, চোখেও দেখতে পান না। হয়তো স্মৃতিশক্তিও কমে গেছে। কিন্ত খাদিজার স্মৃতিশক্তি কমেনি।
আজও মনে আছে একদা তাঁর স্বপ্নের ব্যাখ্যায় কি বলেছিলেন ওয়ারাকা।
এখন তাঁর কথা শুনে খাদিজার বুঝতে বাকী রইল না যে, তাঁর স্বামী সদ্য নবুওত লাভ করা একজন নবী।
মক্কায় ভোর হল, কুয়াশাচ্ছন্ন চারিদিক। শীতের সময় তাই দূর্বল আলোয়, ঘর-বাড়িগুলো নানা উচ্চাতার প্রচ্ছায়া সৃষ্টি করতে লাগল মাটিতে। ধীরে ধীরে প্রচ্ছায়ারা, ছায়ায় রুপান্তরিত হয়ে গেল।
কুয়াশা ভেদ করে হালকা আলো এসে পড়েছে দুয়ারে। আবছা আলোয় সারা ঘর জুড়ে সৃষ্টি করেছে এক রহস্যময় পরিবেশ। বাহিরে শোনা গেল কবুতরের দ্রুত ডানা ঝাপ্টানোর আওয়াজ। দু’একজন মানুষের কথাবার্তা হালকা ভাবে কানে ভেসে এল।
চোখ মেলে তাকালেন মোহাম্মদ সাঃ।
Leave a Reply