নিঃসঙ্গতা
হোসেন আবদুল মান্নান
এ কথা চিরন্তন সত্য যে, মানুষ সামাজিক জীব। তাকে সমাজবদ্ধ হয়েই বসবাস করতে হয়। এর বাইরে গিয়ে সুস্থ দিনযাপন আদৌ সম্ভব নয়। দিনের শেষে মানুষ ঘরে ফিরে আসে। অন্যান্য প্রাণীকেও আশ্রয়ে ফিরতে হয়। তবু মানুষের ফেরা অন্য প্রাণীর চেয়ে সম্পুর্ন আলাদা। মানুষের ঘরে ফেরা মানে জীবন থেকে জীবনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়া আদি এবং অবিনাশী সভ্যতার আলোকসম্পাত করে যাওয়া। তাই মানুষকে মানুষের নিবিড় সান্নিধ্য নিয়েই বেঁচে থাকতে হয়। একা হয়ে, বিচ্ছিন্ন হয়ে বা এক পায়ে দাঁড়িয়ে বেঁচে থাকা একেবারে কল্পনাতীত। বাঁচার জন্য পাতা ঝরার শব্দ যেমন দরকার, পায়ের শব্দও খুব জরুরি।
২.
নিঃসঙ্গতাকে সুনির্দিষ্ট করে সংজ্ঞায়িত করা যায় কিনা আমার জানা নেই। তবে এর পক্ষে বিপক্ষে নানা মত রয়েছে। এটা কী একাকীত্ব, নির্জনতা, বিষন্নতা, বিচ্ছিন্নতা, বন্ধুহীনতা, অসামাজিকরণ না অন্য কিছু? বরঞ্চ বলা যায়, মানুষ যেহেতু জন্মগতভাবেই সঙ্গপ্রিয় সেখানে নিঃসঙ্গতা বা একাকীত্ব তার কাছে কখনোই কাম্য নয়। একজন নিঃসন্তান, নির্বংশ, ভূমিহীনও তা চায় না। সম্ভবত মানুষই সবচেয়ে অদ্ভুত প্রাণী, যে পৃথিবীতে একা আসে এবং একা যায় কিন্তু একাকীত্বকে মোটেই আমলে নিতে পারে না। সে কখনও একা থাকতে চায় না বরং একাকীত্বের ঘোর প্রতিপক্ষ হয়েই বাঁচতে শিখে। তবুও সমাজে সংসারে কিছু মানুষ ক্রমাগত একা হয়ে যায়। সক্রেটিস বলেছেন, ” সৎ, সাহসী ও বিবেকবান মানুষের বেশি বন্ধু হয়না, তারা সবসময় নিঃসঙ্গ, একা এবং এক সময়ে একাকীত্ব এদের গ্রাস করে নেয়”। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, রাগী মানুষরা নিঃসঙ্গ এবং একা, তারা কবিতা লিখতে জানেনা।
৩.
একসময়ে আমার বাবার মতন আরও দু’একজন প্রচন্ড প্রতিপত্তিশালী অশীতিপরকে তাঁর শেষ বেলায় খুব কাছে থেকে দেখেছিলাম। প্রবহমান নিষ্ঠুর সময় কিভাবে তাদের সঙ্গে প্রতারনা করেছে, প্রতিশোধ নিয়েছে। আমার বাবা সমাজের কোনো সেলিব্রিটি বা মহান কেউ ছিলেন না। কিন্তু নিঃসঙ্গতা বা একাকীত্ব তাকে যেভাবে স্পর্শ করে গিয়েছিল হয়তো বিশাল মহীরুহ তুল্য বরেণ্যকেও একইভাবে পীড়িত করে গেছে। এতে ধনী গরীব, ছোট বড়ো, শিক্ষিত অশিক্ষিত নির্বিশেষে সকলের অনুভূতি প্রায় কাছাকাছি ও সমান। এঁদের প্রকাশ ভঙ্গি ভিন্নতর হলেও মরমের যাতনা ছিল এক এবং অভিন্ন। বিস্ময়কর ব্যাপার হল, পৃথিবীর সকল মানুষই হেসেখেলে অবলীলায় তারুণ্য থেকে প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে যায়। কিন্তু রহস্যটা অনুধাবন করতে পারে না। যখন সে পারে তখন প্রায় অসহায়ত্বের কবলে এসে পতিত হয়।
৪.
মনে পড়ে, ৮২ বছর বয়সে আমার বিপত্নীক বাবা একদিন আমাকে বেশ অভিমানের ভাষায় নালিশের মত করে বলেছিলেন, “সারাদিন ঘরের খোলা এ বারান্দাটায় বসে থাকি। নামাজ পড়ি, কোরআন শরীফ পড়ি। এদিক ওদিক দেখি। সামনের ফসলের মাঠ আর বিল-ঝিলের দিকে তাকিয়ে থাকি। মানুষ যায় মানুষ আসে। সবাইকে চিনি না। আমাকে দেখে কেবলই সরে যায়। সকলেই কেমন মহাব্যস্ত। সময় নেই কথা বলার। একবার দু’বার ডাক দিই, শুনে না, শুনলেও ভান করে চলে যায়। আমি বলতে চাইলেও তারা কথা লম্বা করে না। অথচ আজ তুমি বাড়িতে এসেছ, দ্যাখো, কত জনের ভিড় লেগে আছে ? তুমি চলে যাও, সঙ্গে সঙ্গে বিরানভূমি হবে আমার এ আঙিনা, আমার চারপাশ”।
বাবা হয়তো রবীন্দ্রনাথের মতন করে বলতে পারেন নি ‘আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ’। বা ‘বিষাদ আমার মন ছুঁয়েছে ভালো নেই, আমি ভালো নেই ।
৫.
আমি এখনো আমার বাবার বয়সে উপনীত হয় নি। তবুও গত কয়েকদিন একটানা ভেবে চলেছি, কিন্তু এর কুল-কিনারা মেলাতে পারি নি। ভাবছি, আমি কী একই পথের পথিক নই? তবে কী মানুষই মানুষকে নিঃসঙ্গ করে দেয়, নিয়ত গুরুত্বহীন করে তুলে? আমার আসন্ন একাকীত্বকে তখন কেন বাবার মত করে বুঝতে পারি নি? তাঁর দুঃখবোধ, তাঁর নিঃসীম নিঃসঙ্গতার মর্মবাণী ? তাঁর অব্যক্ত বেদনার কথা? কেন বাবার সেই প্রশ্নের যথাপোযুক্ত উত্তর দিতে পারলাম না? আজ ষাটোর্ধ বয়সে এসে আমি যখন হারে হারে অনুভব করছি, আমার নিঃসঙ্গতার চেয়ে কতগুণ অধিক ও যন্ত্রণাবিধূর ছিল বাবার। আমরা কী কেউ আমাদের রক্তের পূর্বসূরি কোনো অশীতিপর বা নবতিপর বৃদ্ধজনের এমন প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে সক্ষম?
আমরা সকলই কী এঁদের প্রশ্নগুলোকে
সযতনে এড়িয়ে যাই না?
বৃদ্ধের আত্মবিলাপ বলে উড়িয়ে দিই না?
তাহলে এটা কেন হয়?
এটা কী কেবলি বহমান সময়ের অমোঘ নিয়তি?
না প্রকৃতির হাতে তোলা অদৃশ্য ন্যায়দন্ড?
এমন বিচারের তুল্যমূল্য নিয়ে চুল-ছেঁড়া গবেষণা অনাগত কাল অবধি চলুক।
Leave a Reply