রফিক সাহেবের দেড় দিন
রফিক সাহেব, পুরো নাম মোঃ রফিকুল ইসলাম। গ্রামে মুরুব্বীরা রফিক্যা বলে। সদ্য অবসরে যাওয়া উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্মকর্তা। এক ছেলে এক মেয়ের গর্বিত বাবা। ছেলে লেখাপড়া শেষে অস্ট্রেলিয়াতে সেটেল, মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়র শেষ বর্ষের ছাত্রী। স্ত্রী সরকারী কলেজের অধ্যাপিকা। রফিক সাহেবের কোন এক সময়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তার মেয়ে।
রফিক সাহেব সবে নতুন চাকরিতে যোগদান করেছেন, উনার স্যার ছেলেটার কর্মদক্ষতা ও পরিশ্রমী দেখে নিজের মেয়ের জন্য মনে মনে সিলেক্ট করলেন। যদিও রফিক সাহেব অতটা সুশ্রী নয়, তবুও তেমন পিছুটান নাই বলে সুন্দরী কন্যাকে পাত্রস্থ করলেন। বিয়ের পর দুই একবার রফিক সাহেব বৌ নিয়ে গ্রামে গেছেন, ছেলে মেয়েরা বলতে গেলে তাদের পিতৃপুরুষের গ্রাম চিনে না।
বিয়ের পর থেকে রফিক সাহেবের আর পিছনে তাকাতে হয় নাই, সব প্রমোশন সময় মতোই পেয়েছেন, নিজের দক্ষতা ও শশুরের সুদৃষ্টি একসাথেই কাজ করেছে। দীর্ঘ চাকরী জীবনে কোন কিছুর অভাব হয় নাই, অবসরের বাকী জীবনটা আরামেই কাটবে।
নামাজ, রোজা,ধর্ম- কর্ম আর দৈনিক পত্রিকা পড়েই সময় কাটছে। বেশ কিছু দিন অবসরটা খুব উপভোগ করলেন কিন্তু আস্তে আস্তে কেমন যেন একাকীত্ব গ্রাস করতে থাকে। সকাল হতেই মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে, স্ত্রী কলেজে, একা একা মনেহয় সময় আর কাটে না, ভাবে দিনটা হয়তো ৪৮ ঘন্টা। স্ত্রী, কন্যা বাসায় ফিরলেও যার যার ভূবনে থাকে, অপেক্ষা রাতের খাবারের টেবিল।
পুরনো স্মৃতিগুলো আবার মানসপটে ভেসে ওঠে। অজপাড়াগাঁয়ে জন্ম, একটা শার্ট, একটা হাফ প্যান্ট, একটা লুঙ্গি, খালি পায়ে তপ্ত ধুলো বা কঠিন শীতে স্কুলে যাওয়া, বিকালে বা ছুটির দিনে মানুষের জমিতে কাজ করা। মেধা ভালো ছিলো বলে ক্লাসের রেজাল্ট সবসময়ই ভালো ছিলো। গ্রামের কলেজ থেকে ইন্টার পাশ করে একা একাই চলে আসে ঢাকা শহরে, খুঁজে বের করে পাশের গ্রামের রিক্সাওয়ালা চাচাকে। তারই রিক্সা গ্যারেজের এক কোণে থাকা, পড়া, খাওয়াটা পাশের ফুটপাথে ছালা দেয়া হোটেলে। এক বেলা রিক্সা চালায়, রাতে পড়ে, তবুও কপাল ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে। ছুটির দিনে হঠাৎ হঠাৎ রিক্সা চালায়, দুটো টিউশন করেই চলে পড়াশুনা।
বিষন্ন মনে রফিক সাহের হাজির হন ডাইনিং এ। তাকে নিয়ে বরাবরের মতোই উন্নাসিক উনার স্ত্রী। গরীব এবং অজপাড়াগাঁয়ের বলে সারাজীবন এমন ব্যবহার পেয়ে সহ্য হয়ে গেছে। মায়ের গুণ মেয়ের মধ্যেও সংক্রমিত। বিয়ের তিন যুগ ধরেই অনেকটা অবজ্ঞা ও মানসিক নির্যাতনের স্বীকার কিন্তু সমাজ, সংস্কার বা সংসারের কথা ভেবে নিশ্চুপ থেকেছেন পুরুষ নির্যাতনে। মনে মনে ভাবলেন কয়েকদিনের জন্য একা একা কোথাও চলে যাবেন। আস্তে আস্তে বললেন আমি কয়েকদিন একটু কোথাও বেড়াতে যেতে চাই, তোমাদের কি সময় হবে? জবাবে উনার স্ত্রী বললেন আমাদের অত বেহুদা সময় নাই, তোমার যে জাহান্নামে যেতে মন চাই যাও, নিজের কথা ভাবো, আমাদেরকে ভাবতে হবে না ! ব্যথিত মনে খাওয়া আধাআধি শেষ করে রফিক সাহেব নিজের ঘরে চলে গেলেন।
ফজরের নামাজ পড়ে রফিক সাহেব আর বাসায় ফিরলেন না, সাধারণ বেশে সোজা বাস স্ট্যান্ড। সকালে রাস্তা ফাঁকা থাকাতে তাড়াতাড়ি পৌঁছে গেলেন। বাস থেকে নেমে একটা হুড খোলা রিক্সায় চড়লেন, দুই পাশে দিগন্ত জোড়া খোলা মাঠ, ফসলের ছড়াছড়ি, আপনমনে কাজে ব্যস্ত কৃষকেরা। সর্পিল রাস্তা বেয়ে আস্তে আস্তে এগোতে থাকে রিক্সা, চারিদিকে পাখির কুজন, বাচ্চা ছেলেমেয়ের ছোটাছুটি, দূরে গরু ছাগলের ডাকাডাকি, ফিনফিনে মৃদু বাতাসে চুল এলোমেলো, একটা স্বর্গীয় অনুভূতি মনে অনুভূত। সারাজীবনের সব ক্লান্তি মনেহয় এখনই ধূয়ে মুছে গেল, মনটা যেন পৌঁছাতে চায় সেই ছোটবেলায়। গ্রামের আত্মীয়-স্বজন এত সকালে তাকে এই বেশে দেখে অবাক। যে লোক গাড়ী ছাড়া কোথাও যান না, সে রিক্সায় করে বাড়ীতে হাজির। অনেকদিন পর পুকুরে ডুব দিয়ে গোসল করলেন, দলবেঁধে মসজিদে নামাজ পড়ে মা-বাবার কবর জিয়ারত শেষে আনন্দের সাথে মাটিতে বসে ছোট মাছ, ডাল ভাত খেলেন। বিকালে হেঁটে হেঁটে বাজারে যেয়ে নিজ হাতে বাজার করলেন। শেষে টং দোকানে চা খেতে খেতে জম্পেস আড্ডা, যেন রফিক সাহেব ছোটবেলায় ফিরে গেলেন। রাতে খাবার শেষে বললেন আমার জন্য মেঝেতে বিছানা দাও, অনেকদিন পর মেঝের বিছানায় ঘুমাবো।
রফিক সাহেব সারাদিন বাসায় না যাওয়াতে রাতে মা-মেয়ে তাকে ফোন দিলো কিন্তু দেখে ফোন বাসাতেই। চিন্তা করতে থাকলো কোথায় গেল কিন্তু মুখের গাম্ভীর্য ঠিকই বজায় রাখলো। আচ্ছা রাত যাক সকালে দেখা যাবে কি করা যায় ! সকালে পরিচিত সব জায়গায় খবর নিয়েও রফিক সাহেবের কোন হদিশ পেলেন না, অগত্যা থানায় জিডি করলেন।
সকালে রফিক সাহেব মনের সুখে পিয়াজ, কাঁচা মরিচ দিয়ে ভরপেট পান্তা ভাত খেয়ে আস্তে আস্তে ঢাকার দিকে রওয়ানা দিলেন। বাস থেকে নেমে সোজা রমনা পার্কে আসলেন। এক কোণের সিমেন্টের বেন্চে বসে উদাসীভাবে লোকজনের আসাযাওয়া দেখছেন, পাখির কিচিরমিচিরে আত্মমগ্ন হচ্ছেন। চোখ বুঁজে খানিকক্ষণ লম্বা হয়ে শুয়ে থাকলেন। দুপুর গড়াতে মালিবাগে পুরোনো রিক্সার গ্যারেজটা খুঁজে বের করলেন। মালিক পরিবর্তন হলেও গ্যারেজের তেমন পরিবর্তন হয় নাই। পাশের মসজিদে নামাজ শেষ করে তৃপ্তির সাথে ফুটপাথের হোটেলে খেয়ে নিলেন। এরপর গ্যারেজের হাতা ভাঙা চেয়ারে খানিকটা বিশ্রামে আসরের আজান। নামাজ শেষ করে ফুটপাথের চায়ের দোকানের টুলে বসলেন। আরাম করে চায়ে বনরুটি ডুবিয়ে খেতে খেতে দেখলেন অদূরে কালো গ্লাসের প্রাইভেট কার থামলো, একটু পর সাইরেন বাজিয়ে পুলিশের গাড়ী হাজির। ওসি সাহেব স্যালুট দিয়ে বললেন, স্যার চা টা শেষ করেন, একটু আমার সাথে থানায় যেতে হবে। কালো গাড়ী থেকে আস্তে আস্তে উনার স্ত্রী- মেয়ে বের হয়ে আসলেন । রফিক সাহেব বিড়বিড় করে বললেন আর একটা রাত গ্যারেজের চৌকিতে ঘুমাতে চাইছিলাম, হলো না।
১০.০৩.২০২৩
Leave a Reply