।।পর্ব -১০।।
১৯৮২ সালে প্রথম হজ্বট্রিপের সময় BNS শহীদ সালাউদ্দিন জাহাজে সরকার নিয়োজিত “আমিরুল হজ্ব” সাহেবের দূর্ব্যাবহারে যখন জাহাজের ক্রু এবং ক্যাটারিং কোম্পানীর স্টাফরা অতিষ্ঠ, ঠিক এমন সময় একদিন দুপুরের খাবারে তন্দুর রুটি দেয়ার এক সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে “আমীরুল হজ্ব” অনেক হজ্বযাত্রীকে ক্ষেপিয়ে তোলেন। তাদের দাবি, “এই রুটি খাওয়ার অযোগ্য”। এই সংবাদ পেয়ে অধিনায়ক কমান্ডার সারোয়ার নিজাম স্যার তরিৎ ব্যাবস্থা নিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। কিন্তু তিনি এই ঘটনার মূল নায়ক আমিরুল হজ্বকে একটা চরম শিক্ষা দেয়ার জন্য তাকে “মিউটিনির” অপরাধে অভিযুক্ত করেন, এবং তাকে তার কেবিনে নজরবন্দি করে একজন অস্রধারী নাবিক নিয়োগ করেন সার্বক্ষণিক পাহারার জন্য। নেভি জাহাজে মিউটিনির সর্বোচ্চ শাস্তি যে মৃত্যুদণ্ড, এবং এই মৃত্যুদন্ড কার্যকর করতে জাহাজের ক্যাপ্টেনকে যে কোনো কারন দর্শানোর দরকার পড়েনা, এই কথাটা “আমিরুল হজ্বকে” জানানোর পর তিনি প্রাণভয়ে একেবারেই ভেঙে পড়েন। একপর্যায়ে নিজাম স্যার হজ্ব শেষে জেদ্দাহ থেকে ফেরার পথে তার সাধের “আমিরুল হজ্ব” খেতাবটি স্থগিত করলে তিনি সাধারণ যাত্রীদের কাতারে “সামিল” হতে বাধ্য হন। যাত্রা শেষে জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে ডক করার পর “আমিরুল হজ্ব” সাহেবকে সবার শেষে ছেড়ে দিলে তিনি জাহাজ থেকে একরকম “নিজের জীবন নিয়ে” পালিয়ে বাঁচেন। সেই চমকপ্রদ কাহিনীর বিশদ বর্ণনা আছে নিজাম স্যারের লেখা “হিজবুল বাহার থেকে শহীদ সালাউদ্দিন-জলপথে হজ্বযাত্রার গল্প” বইটাতে।
সম্ভবত, সেই তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদের সময় এই “আমিরুল হজ্ব” পদবীর কোনো লোক জাহাজে ছিলেন না, বা থাকলেও হয়তোবা তিনি তার পূর্বসূরির “অতীত শিক্ষাকে” স্মরণ করে তার উপর ন্যস্ত দ্বায়িত্ব সঠিক ভাবেই পালন করেছিলেন। তবে আমি জাহাজে এই নামটি কখনো শুনেছি বলে আমার এখন সঠিক মনে পড়ছে না। কিন্তু “আমিরুল হজ্ব” জাহাজে থাক বা না থাক, হজ্বযাত্রীদের নিয়মিত দেখাশোনা ও তদারকীর জন্য মনোনীত অফিসারটি ছিলেন আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় ও অত্যন্ত প্রিয় প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা অফিসার তখন লেফটেন্যান্ট ওয়াহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া স্যার। নৌবাহিনীতে তিনি ডাবলু আই (WI) ভূঁইয়া নামে অত্যন্ত সুপরিচিত ছিলেন। ভূঁইয়া স্যার প্রতিদিন দুপুর ও রাতের খাবারের সময় জাহাজের ডেকে Rounds (পরিদর্শন করা) নিতেন। ভূঁইয়া স্যার আমাদেরকে তার নিজের সন্তানের মতোই স্নেহ করতেন, তাই, আমার অফ ডিউটি থাকলে প্রায়ই দুপুরে তিনি আমাকে বলতেন “চল্ কিবরিয়া, একটা রাউন্ড নিয়ে আসি তোকে নিয়ে”। আর বলাই বাহুল্য, আমি সাথে সাথেই স্যারের ডেপুটি হিসাবে তার পিছু নিতাম।
ভূঁইয়া স্যারের সাথে আমার শহীদ সালাহউদ্দিন জাহাজে প্রথম পরিচয় হলেও এর পরের বছর ১৯৮৩ সালেই আমরা একসাথে চট্টগ্রাম নৌঅঞ্চলের অফিসারস লেডিস ক্লাব আয়োজিত “প্রজাপতি নির্বন্ধ” নামে এক সাড়া জাগানো মঞ্চনাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে আমাদের মধ্যে যে গভীর আত্ম্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠে, সেটা পরবর্তী জীবনে স্যারের অবসরের পরেও সম্ভবত ১৯৯৬/৯৭ সালে তার “আকৎসিক মৃত্যুর” আগ পর্যন্ত অটুট ছিল। ভূঁইয়া স্যার ছিলেন পারিবারিক ভাবেই একজন গভীর সাংস্কৃতি পাগল লোক। অত্যন্ত জনপ্রিয় বাংলা ছায়াছবি “আগুনের পরশমনি”তে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পাক বাহিনীর টর্চার সেলে “পাকিস্তানী আর্মি কর্নেলের” ভূমিকায় ওয়াহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া স্যারের অনবদ্ধ অভিনয় আমরা অনেকেই হয়তো এখনো ভুলি নাই। মহান আল্লাহ পাক ভূঁইয়া স্যারকে বেহেস্ত নসিব করুন, আমীন।
যাইহোক, ভূঁইয়া স্যার খুবই অমায়িক ও আন্তরিক আলাপচারিতার মাধ্যমে হজ্বযাত্রীদের ভালো-মন্দের খোঁজ-খবর নিতেন। একবার এমনি এক দুপুরে রাউন্ডসের সময় জাহাজের পিছনে বাম দিকের লাক্সারি কেবিনের গা ঘেসে ওয়েদারডেকে বসে থাকা একদল মুসুল্লিদের সাথে ভূঁইয়া স্যার যখন খাবার-দাবারের খোঁজখবর নিচ্ছিলেন, তখন সত্তুরোর্ধ একজন মুসুল্লি হাউ মাউ করে কেঁদে খাস চিটাগোনিয়ান ভাষায় বললেন “বাজী..আরে উগ্গা কেঁচা মরিচ দেওন ফরিবো যে …আই খাওন ন ফারি যে… ইত্যাদি ইত্যাদি “, অর্থাৎ “বাবা, আমাকে একটা কাঁচা মরিচ দিতে হবে, …এছাড়া আমি খাবার খেতে পারছি না…”। এই কথা শোনার সাথে সাথেই ভূঁইয়া স্যার আমাদের সাথে থাকা ক্যাটারিংয়ের একজন প্রতিনিধিকে জিজ্ঞাসা করলেন যে এর কোনো সুরাহা করা যায় কিনা। ক্যাটারিংয়ের প্রতিনিধি বিনয়ের সাথে জানালেন যে, “স্যার এখন স্টোরে কোনো কাঁচা মরিচ অবশিষ্ট নেই। যা ছিল, তার সবটাই রান্না ও যাত্রীদের কাঁচামরিচের বিপুল এক্সট্রা চাহিদা মেটাতে দ্বিতীয় দিনেই শেষ হয়ে গেছে”। এই বিষয়টা ভূঁইয়া স্যার ঐ বৃদ্ধ মুসুল্লীকে যতই বোঝাতে চেষ্টা করেন, ঐ মুসুল্লী ততই “শোকের মাতমের” মতোই কান্না করতে থাকেন। যেহেতু এই সমস্যার কোনো বাস্তব সমাধান নেই, তাই ভূঁইয়া স্যার এই মুরুব্বির গায়ে হাত বুলিয়ে কিছুক্ষন সহমর্মিতা দেখান। এরপর আমরা সবাই বাকী মুসুল্লি যাত্রীদের দিকে এগিয়ে যাই পরিদর্শনের জন্য।
এই ঘটনায় আমি মনে মনে বেশ অবাক হয়েছিলম ঐ বৃদ্ধ মুসুল্লীর কান্ড দেখে, আর ভাবি কাঁচা মরিচছাড়া খাবার খেতে পারে না এ আবার কেমন কথা! কিন্তু নিয়তির কি পরিহাস, পরবর্তী চাকরী জীবনে দীর্ঘদিন চট্টগ্রামে থাকার কারণে আমিও একসময় কাঁচামরিচ খাওয়ার পোকা হয়ে উঠি। আসলে তুলনামূলক ভাবে ঢাকার চেয়ে চিটাগাংয়ের মানুষ অনেক বেশি ঝাল খেতে অভ্যস্ত। এখন এই বিদেশ বাড়িতে আমাদের ঝাল খাওয়ার পরিমান দেখলে আমাদের নিকট পরিচিতজনদের চক্ষু চড়ক গাছে উঠে! এমনকি, গত ২০১৬ সালে দক্ষিণ-প্রশান্ত মহাসাগরে সস্ত্রীক ১৪ দিনের এক লাক্সারি ক্রূজের সময় প্রায় তিনশ’ গ্রাম কাঁচামরিচ আমাদের ভ্রমণ সঙ্গী হয়েছিল! আমাদের রুমের কেবিনেট ফ্রিজ থেকে প্রতিদিন গোটা চারেক কাঁচামরিচ সকালে ব্রেকফাস্টের সময় ডাইনিং হলের “eggs to order” শেফদের হাতে তুলে দিয়ে অনুরোধ করতাম পেঁয়াজ-কাঁচামরিচের ওমলেট তৈরি করার জন্য। আর গরম গরম সেই ওমলেট খাওয়া ছিল আমাদের একটা অন্যতম রুটিন কাজ। ফলে, ক্রূজের সম্ভবত তৃতীয় দিনেই ডাইনিং হলের শেফরা আমার স্ত্রীকে দেখলেই হাসতে হাসতে কাঁচামরিচের জন্য হাত বাড়িয়ে দিতো।
যাইহোক, এই খাবার-দাবারের রাউন্ডস (rounds) ছাড়াও আমাদের আরো দুইটি রুটিন কাজ ছিল। যার প্রথমটি ছিল প্রতি ওয়াক্তে নামাজের আগে জাহাজের কেবলার দিক ঠিক করা এবং দ্বিতীয়টি ছিল যাত্রা পথে Time zone পরিবর্তনের সাথে সাথে জাহাজের ঘড়ির সময় পরিবর্তন করা। যেহেতু জাহাজ পূর্ব থেকে পশ্চিমে কোর্স করে ক্রমাগত উত্তর-দক্ষিন বরাবর মেরেডিয়ান অতিক্রম করছিলো, তাই ঘড়ির সময়েরও পরিবর্তন হচ্ছিলো। আমি প্রায়ই ডিউটিতে থাকার সময় নিচের ডেকে নেমে সোজা চলে যেতাম জাহাজের পিছনের দিকে খোলা বেশ বড় একটা হল রুমে। দেখতে কতকটা বিমান রাখার হ্যাঙ্গারের মতোই এই জায়গাটা ছিল গোটা জাহাজে একমাত্র বড় খোলা জায়গা, যেখানে একসাথে প্রায় ৪’শ মুসুল্লি জামাতে নামাজ আদায় করতেন। এছাড়াও ফজর থেকে এশা পর্যন্ত এখানেই চলতো ইসলামী মাসলা-মাসায়েলের জমজমাট মাহফিল। ফলে রাত ১০ টায় বিছানায় যাওয়ার জন্য জাহাজের বাঁশি (pipe down) বাজার আগ পর্যন্ত এই এলাকাটা সব সময়েই মুসুল্লিদের ভীড়ে গমগম করতো । এই হলরুমের সামনের বাল্কহেডের সাথে ছিল একটা দেয়াল ঘড়ি আর ঠিক মাথার উপরে ছাদের মধ্যে “কিবলার দিক” নির্দেশনার জন্য ছিল প্রায় দুই ফুট লম্বা হার্ডবোর্ডের তৈরী ঘড়ির কাটার মতো একটা কাঁটা। আমাদের কাজ ছিল প্রতিদিন এই “কিবলার কাঁটা” টাকে নিয়মিত নামাজের আগে ঘুরিয়ে “কিবলা মুখী” করা। মোটামুটি জেদ্দা যাওয়ার পথে এই ছিল হজ্বযাত্রীদের সাথে মেলামেশার একমাত্র সুযোগ। এই অভিজ্ঞতাই রুটিনভাবে চলতে থাকে জাহাজ জেদ্দায় পৌঁছে যাত্রীদের জাহাজ ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত।
(চলমান…..)
এই লেখার অন্যান্য পর্ব পড়ার জন্য এই হ্যাসট্যাগে #সাগরপথেহজ্বযাত্রারঅভিজ্ঞতা
ক্লিক করুন, ধন্যবাদ।
প্রাক্তন ক্রুজশিপ MV হিজবুল বাহার। ছবি সৌজন্যে-ইন্টারনেট।
Leave a Reply