২৩. ০৩. ২৩
পিতা ও পুত্রী
——-হারুন-অর-রশিদ মজুমদার
এক.
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। কেবলই একটি নাম মাত্র নয়,একটি ইতিহাস। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাঁর ড্রইং রুমে সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছেন। ১৯৩৮ইং সাল। তাঁর তরুণী কণ্যা দীনা নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সম্মুখে। গম্ভীর প্রকৃতির হালকা-পাতলা দীর্ঘাকায় মিস্টার জিন্নাহ হাতে ধরা বিলেতি চুরুটে খুব চিন্তিত মনে টান দিয়ে,উপরের দিকে ধোঁয়া ছেড়ে দীনাকে লক্ষ্য করে বললেন,”ভারতবর্ষে কোটি কোটি মুসলমানের আবাস। আছে কোটি কোটি মুসলমান ছেলে। তুমি কেনো একটি ফারসি ছেলেকে পছন্দ করলে? তোমার এই মত পাল্টাতে হবেই দীনা। এই বিয়ে হতে পারে না।
আমি ভারতবর্ষের মুসলমানদের নিরঙ্কুশ সমর্থন পেয়ে রাজনীতি করছি,আর তুমি কিনা একটা অমুসলিম ছেলেকে বিয়ে করবে? তুমি কি জনসম্মুখে আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করতে চাও”? যদিও জিন্নাহ বোঝেন এ তো আমারই রক্তের উত্তরাধিকার। আমার মতো অনমনীয়ই হবে। তবুও শেষ চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কি? ১৯ বছরের তরুণী দীনা জিন্নাহ চোয়াল শক্ত করে থেকে ভারতবর্ষের একজন প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ ও আইনজীবি পিতার সম্মুখে দাঁড়িয়ে পূর্ববৎ মেঝের দিকে তাকিয়ে জবাব দিলো,”ভারতবর্ষে কোটি কোটি মুসলমান থাকতে তুমিও একজন ফারসি নারীকে বিয়ে করেছিলে বাবা”।
মিস্টার জিন্নাহ আবারও সিগারেটে একটা গভীর টান দিয়ে সুদুর পানে ধোঁয়া উড়িয়ে দিতে দিতে অতি দৃঢ় আত্মাভিমান নিয়ে বললেন,”মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র বাবাকে পরিচিত গন্ডির বাইরে কেউ চিনতো না। তিনি নিজ গন্ডিতেও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র পিতা হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। তুমি তা নও দীনা। তোমার পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ভারতবর্ষের মুসলমানদের কাছে শুধুই নেতা নন। ভারতবর্ষের উত্তর-দক্ষিণ পূর্ব-পশ্চিম এর সকল জাতির মুসলমান ও ধনী-গরীব সকল মুসলমানদের ঐক্যের প্রতীক। সেই মুসলমানদের নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র মেয়ে হয়ে একজন অমুসলিম বিয়ে করে তুমি তাকে অপমান করতে পারো না দীনা”।
দুই.
একটু থেমে নিয়ে হঠাৎ আনমনা হয়ে মিস্টার জিন্নাহ বললেন,”আমার কী অপূর্ব সুন্দর গোঁফ ছিল দেখেছ”? দীনা তেমনি নতজানু হয়েই বললো,”দেখেছি। তবে, আমাদের পুরনো এলবামে। আমার জন্মের পর তোমাকে কখনও গোঁফ রাখতে দেখিনি। গোঁফে তোমাকে দারুণ মানাতো বাবা”। জিন্নাহ আনমনা হয়ে বললেন,”আমারও প্রিয় ছিল আমার গোঁফ। আমি প্রফেশনে আইনবিদ ও নেশায় রাজনীতিবিদ উভয়ের সাথেই আমার গোঁফ মানানসই ছিল বলেই আমার বিশ্বাস। সেই আমার প্রিয় গোঁফ কেটেছি বিয়ের আগে,তোমার মায়ের চাওয়াকে অগ্রাধিকার দিয়ে। অথচ তোমার সেই মা আমাকে ভুল বুঝে,তোমাকে নিতান্তই শিশু অবস্হায় রেখে আত্মহত্যা করলো।
আমিও আর গোঁফ রাখিনি তোমার মায়ের সম্মানে। জীবন বড়ো জটিল দীনা। তুমি যার জন্য আজ আমাকে ভারতবর্ষের মুসলমানদের কাছে হেয় করবে,দেখো একদিন সে-ই তোমাকে বেশি কষ্ট দিবে। জীবনের সবচেয়ে বড়ো আঘাতটা হয়তো তার পক্ষ থেকেই আসবে। দীনা দৃঢ় কণ্ঠে বললো,”বাবা ওয়াদিয়া এক অন্য রকম ছেলে। একদিন তুমিও স্বীকার করবে আমি ওয়াদিয়াকে পছন্দ করে কোন ভুল করিনি”। স্বল্পভাষী মি: জিন্নাহ বললেন,”মনে রেখো,পৃথিবীর কোন বাবা-মা তার সন্তানের কাছে ধন সম্পদ আশা করে না। কোনো পিতা-মাতা চায় না,সন্তান শেষ জীবনে তাকে কামাই করে খাওয়াবে,এই প্রত্যাশা করে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্তানকে পড়ায় না।
বাবা মায়ের একমাত্র চাওয়া,সন্তান মানুষের মতো মানুষ হোক। সন্তান সুখী হউক। সমাজে পিতা-মাতার বংশের মুখ উজ্জ্বল করুক। তুমি শুধু এইটুকু বিবেচনায় রাখবে। এটুকুই প্রত্যাশা। মিস্টার জিন্নাহ হাতের সুগন্ধী হাভানা চুরুটের দিকে তাকালেন। তামাক পুড়িয়ে সিগারেটের আগুন মধ্যমা ও তর্জনী আঙুল স্পর্শ করেছে। তিনি সুগন্ধী মসলাদার হাভানা চুরুটের শেষাংশ স্ট্রেতে গুঁজে ঘষে ঘষে মনোযোগ সহকারে আগুন নেভাতে নেভাতে বললেন,”তুমি তোমার সিদ্ধান্তে অনড় থাকলে এই সংক্রান্ত এটাই আমার শেষ কথা। যাও”। দীনা জিন্নাহ-র জন্ম ১৫ই আগষ্ট ১৯১৯ ইং। দেশ ভাগের অর্থাৎ ১৯৪৭ইং এর ১৫-ই আগষ্ট পাকিস্তান সৃষ্টির ঠিক ২৮ বছর আগে। দীনা জিন্নাহ ১৯৩৮ সালে দীনা ওয়াদিয়া নাম ধারণ করে,বিয়ে করেন নেবিল ওয়াদিয়া নামক ফারসী যুবককে।
তিন.
দীনা ওয়াদিয়া ও নেবিল ওয়াদিয়ার ১৯৪৩ইং সালে বিবাহ বিচ্ছেদ হলে,একমাত্র ছেলেকে নিয়ে দীনা জিন্নাহ বম্বের পৈত্রিক নিবাস,জিন্নাহ হাউজে বসবাস শুরু করেন। বাকী জীবন কাটিয়ে দেন পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বম্বে পরিত্যাগ করে পাকিস্তান চলে যাওয়া বম্বের পরিত্যাক্ত বাড়িতে। দীনা জিন্নাহ জীবনে একবার পাকিস্তান গিয়েছিলেন ১৯৪৮ইং সালে,পিতার রাষ্ট্রীয় চেহলামে অংশ নিতে। এটাই ছিল তার প্রথম ও শেষ বারের মতো পাকিস্তান সফর। আমৃত্যু তিনি ভারতেই ছিলেন। পাকিস্তান সরকারের পাকিস্তানে বসবাসের সকল প্রকারের উপঢৌকন সমেত আন্তরিক প্রস্তাবাবলীও তিনি সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেন।
আরও একবার পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে টেলিফোনে,পাকিস্তান সফর নিয়ে কথা হয় দীনা জিন্নাহর। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বললেন,”দীনা,মা আমার,আমার শেষ সময় ঘনিয়ে এসেছে। তুমি পাকিস্তান চলে আসো”। দীনা জিন্নাহ চোয়াল শক্ত করে টেলিফোনে বললেন,”আমার মায়ের কি হবে? আমার মায়ের লাশ ভারতে আছে। আমার মায়ের কবর কি তুমি ভারত থেকে পাকিস্তানে নিয়ে যেতে পারবে? পারবে না।তাই মায়ের ভারতের মাটিতেই হবে আমার শেষ ঠিকানা। তোমার এই পাকিস্তান প্রীতি,পাকিস্তানের স্বপ্নে বিভোর অতন্দ্র মুহূর্ত গুলোই আমার মায়ের মৃত্যুর কারণ বাবা। যে পাকিস্তান আমার মায়ের মৃত্যুর কারণ সেই পাকিস্তানকে আমি ঘৃণা করি। ইহজীবনে সেই পাকিস্তানের রাণী হিসেবেও যদি আমাকে ঘোষণা করা হয়,তবু সেই পাকিস্তানে আমি যেতে পারি না। বসবাসের কথা তো চিন্তাও করা যায় না বাবা”।
টেলিফোনের অপরপ্রান্তে সর্বময় ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিকারী পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নির্বাক হয়ে রইলেন। এই পাকিস্তানের জন্য তার এতো আত্মত্যাগ কি পাকিস্তানবাসী মনে রাখবে? নাকি তারা আমার জীবন যৌবনকে পাকিস্তানের জন্য, ভারতবর্ষের মুসলমানদের জন্য উৎসর্গ করাকে,একদিন বেমালুম ভুলে যাবে? আমি আমার পরিবার হারিয়েছি। জীবনের সকল আরাম আয়েস ত্যাগ করেছি,এই পাকিস্তান রাষ্ট্র কায়েম করার লক্ষ্যে। ভুলে যাওয়া উচিত হবে না। কারণ এমনটা হলে,পরবর্তী কালে তাদের বিপদে আপদে আর কোনো মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ,তাদের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে এগিয়ে আসবে না। আমার ক্ষতির চেয়ে সেটাই তাদের জন্য হবে সবচেয়ে বড়ো ক্ষতি। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কাঁপা কাঁপা হাতে টেলিফোন রিসিভার,সেটের উপর নিঃশব্দে রাখলেন। জীবনে কি চেয়েছি? আমি কি সফল? এই টেলিফোন সংলাপের পর মাত্র মাস কয়েক বেঁচে ছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান কায়েম হবার পর মাত্র সতেরো মাস বেঁচে ছিলেন কায়েদে আজম।
চার.
চোখ ঝলসে যাওয়ার মতো সৌন্দর্য নিয়ে জন্মে ছিলেন লেডি রতন বাঈ ওরফে রতি। মুম্বাইয়ের সবচেয়ে ধনী পরিবারের মেয়ে। বয়সে ২৪ বছরের বড় জিন্নাহর প্রেমে পড়ল ষোড়শী রতি। জিন্নাহ বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়ে দেশে এসেছেন। ভারববর্ষের রাজনীতির মাস্টারমাইন্ড। স্বল্পভাষী,ভদ্র,দেখতে সুদর্শন। জিন্নাহ-রতি-দার্জিলিং আর বরফের পাহাড় সব মিলিয়ে একটা ভালোবাসার গল্প শুরু হলো। জিন্নাহ লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য। তাই রতির বাবা ভালোবাসা ঠেকাতে কোর্টের শরণাপন্ন হলেন। ভালোবাসা,কোনো কিছু দিয়েই আটকে রাখা যায় না। কোর্টের আদেশ অমান্য করে লুকিয়ে দেখা করা কিংবা চিঠি লেখা চললো আরও দুই বছর।
আঠারো তম জন্মদিনের প্রথম প্রহরে ভালোবাসার পূর্ণতার জন্য পরিবার,ধর্ম সব ছেড়েছুড়ে এক কাপড়ে চলে আসল রতি জিন্নাহ-র কাছে। দিল্লি জামে মসজিদে বিয়ে হলো। দেন মোহর ১০০১ টাকা। ভালোবাসার উপহার হিসেবে বাসর রাতে মিস্টার জিন্নাহ,এক লক্ষ পঁচিশ হাজার টাকা রতির হাতে তুলে দিলেন। রতি অবাক বিস্ময়ে দীর্ঘ সময় তাকিয়ে থাকলেন জিন্নাহর দিকে। সৈয়দ শামসুল হক এক কবিতার পঙ্তিতে লিখেছিলেন,”একবার পাইবার পর নিতান্তই মাটির মনে হয় সোনার মোহর”। রতির শাড়ি,চুড়ি,চোখ ঝলসানো সৌন্দর্য,অপেক্ষা,মুগ্ধতা সবকিছুই মিস্টার জিন্নাহর কাছে সোনার মোহর থেকে মাটি হতে থাকল ধীরে ধীরে ।
১৯১৮ইং সালের বসন্তে যে ভালোবাসার টানে তাদের বিয়ে হলো,জীবনের বসন্তে সেই ভালোবাসা আর ধোপে টিকল না। রাতে বিছানায় শুয়ে রতি যখন জিন্নাহকে নিয়ে ভাবে,জিন্নাহ তখন ভারতবর্ষের কোটি কোটি মানুষের স্বপ্ন নিয়ে নিয়ে ভাবে। রাত যায়,দিন আসে,দিন যায়,রাত আসে। জিন্নাহ একবারের জন্যও রতির দিকে তাকানোর সময় পায় না। চেনা পুরুষ চোখের সামনে বদলে গেল,বদলে গেল ভালোবাসা। রাগে,দুঃখে,অভিমানে,অপমানে রতি ২৯ বছর বয়সে ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করল। রতির বাবা নিজের সব রাগ,অভিমান ভেঙে দশবছর পর এই প্রথম জিন্নাহকে ট্রাঙ্ক কলে মৃত্যুর খবর দিলেন। রাজনীতির ব্যস্ত মানুষ জিন্নাহ কবরস্থানে ছুটে আসলেন। কবরে দু’মুঠো মাটি দিতে গিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন জিন্নাহ, রতি ভালোবাসার পুরষ্কার পেল। আর,ভারতবর্ষের মানুষ সেই প্রথম,সেই শেষ জিন্নাহর মনের ভাব প্রকাশ দেখল।
মহারাষ্ট্রের পুন্জলাল ঠাকুর ছিলেন জিন্নাহর পিতা। তিনি মুসলিম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে নামঃ “পুন্জোভাই জিন্নো”-তে রূপান্তরিত করে,চলে আসেন মহারাষ্ট্র থেকে বোম্বে। তারও পরে চলে যান করাচিতে। ১৯০৪ইং সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর রাজনৈতিক জীবন শুরু। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৮৭৬ইং সালের ২৫শে ডিসেম্বর করাচিতে জন্মগ্রহন করেন। বোম্বে ও করাচিতে কাটে তাঁর স্কুল জীবন। করাচি থেকে ১৮৯২ইং সালে ম্যাট্রুক্যলেশন পাশ করে লন্ডন যান ব্যারিস্টারী পড়তে। ১৮৯৬ইং সালে ব্যারিস্টার হয়ে করাচিতে ফিরে আসেন। ১৮৯৭ইং সালে বোম্বেতে আইন পেশা শুরু করেন। জিন্নাহ এককালিন দাদা ভাই নওরোজের ব্যাক্তিগত সচিব ছিলেন। তাঁর হাত ধরেই জিন্নাহ’র রাজনীতি শুরু হয় ১৯০৬ইং সালে,কংগ্রেসে যোগদানের মধ্য দিয়ে। মিস্টার জিন্নাহ মুসলিম লিগে যোগদান করেন ১৯১২ইং সালে। আর কংগ্রেসে ফিরে যাননি।
Harun-Ur-Rashid Majumder. Managing Director. RF Textile Industries Ltd. Chairman. Standing Committee on HIV & Eye. BGMEA
বি.দ্র.ঐতিহ্যগত ভাবে বাংলাদেশের মানুষ ইতিহাস বিমুখ। পাশাপাশি বই বিমুখ। তাঁরা বর্তমানের উপর ভর করে বেঁচে থাকে। মনে রাখা উচিত,যিনি সম্মুখে ১০০ মিটার লাফ দিবেন তাঁকে কমপক্ষে ১০-২০ মিটার পিছিয়ে অতঃপর ১০-২০মিটার দূরত্ব দৌড়িয়ে এসে,নির্দিষ্ট দাগে দাঁড়িয়ে সর্বশক্তি নিয়োজিত করে ১০০ মিটার লাফ দিয়ে তবে স্বর্ণ,রৌপ্য কিংবা ব্রোঞ্জ পদক অর্জন করতে হয়। নচেৎ নয়।
পুনশ্চঃ সংলাপ গুলো একেবারেই কাল্পনিক।
Leave a Reply