এমন ঘনঘোর বরিষায়-
ঘন মেঘে আকাশটি গেছে ঢেকে। আমি আকাশের পাণে চেয়ে চেয়ে ভাবি – আচ্ছা, ঐ ঘন পুঞ্জিভূত মেঘের মাঝে ভেসে ভেসে কেউ কি এসেছে আমার দেশ থেকে? পদ্মা যমুনা, মেঘনার বাষ্পীভূত জলকণায় সিক্ত হয়ে, ইলিশের আঁশটে গন্ধ মেখে, কদম গুচ্ছের মিষ্টি গন্ধ, অথবা কোন মায়ের শুকিয়ে যাওয়া নোনা জলকে ধারণ করে কেউ কি এসেছে এই দূর দেশে? ভাবতে ভাবতে মেঘেরা নেমে আসে আকাশ থেকে বৃষ্টির রূপ ধরে। ঝুম বৃষ্টিতে ছেয়ে যায় চরাচর। গাছের পাতারা হুড়হুড়ি করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, আমার বাগানের হানিস্যাকল ফুলগুলি একটা মৃদু গন্ধ ছড়িয়ে মাথা নাড়িয়ে বৃষ্টিকে করে আবাহন। তীব্র তাপদাহে হলুদাভ বিষণ্ণ ঘাসগুলো বৃষ্টিতে ভিজে মুহূর্তে সেজে উঠে সবুজ বসনে। ঘন বৃষ্টি আছড়ে পড়ে দেওয়ালের গায়ে, কাচের জানালার পর, আমার মনোজগতের বিস্তীর্ণ শুষ্ক ভূমির পর। আমি আমার মনের গহীনে বৃষ্টি পতনের শব্দ শুনি, সে শব্দে মিশে থাকে দূরাগত কোন বিলাপের ধ্বনি, এক সর্বগ্রাসী হাহাকার। একটা অনন্ত শূন্যতা ছুটে এসে আমায় জড়িয়ে ধরে। জলকণায় সিক্ত হয়ে জেগে ওঠে বিষণ্ণ স্মৃতিরা।
এই বৃষ্টি ভেজা প্রকৃতির পানে তাকিয়ে আমি ভুলে যাই কেন মেঘ জমে, কেন বৃষ্টি ঝরে। মনে পড়ে কবিবর মহাদেব সাহার কথা – মানুষ নাকি কাগজ আবিষ্কারের পূর্বেই এই বিশাল আকাশে লিখে রেখেছিল প্রেমের কবিতা। সেই কবিতাই নাকি ঝরে পড়ে বৃষ্টির রূপ ধরে, বর্ষার রূপ ধরে। আমি আজ বৃষ্টির মাঝে অশ্রুতপূর্ব কোন কবিতার ছন্দ শুনি। তাকিয়ে দেখি হাসির ফেরিওয়ালা, মানুষকে অনাবিল আনন্দে মাতোয়ারা করা বিচিত্র চার্লি চ্যাপলিন বৃষ্টির মাঝে হেটে চলেছেন। আমি চিৎকার করে বলি– চার্লি, তুমি বৃষ্টিতে ভিজছ কেন? সে নির্লিপ্ত হয়ে বলে যায় – ‘আমি বৃষ্টিতে হাঁটি যাতে কেউ আমার অশ্রু দেখতে না পারে’। কি বিচিত্র মানুষের মন! কি বিচিত্র অনুভূতি! চার্লি তার চোখের জলকে আড়াল করতে চায়, আর পৃথিবীর অন্য কোন এক প্রান্তে কোন এক অভিমানী বৃষ্টিকে বারণ করে বলে – ‘ওগো বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছুয়ো না আমার এতো সাধের কান্নার দাগ ধুয়ো না’।
আমার জীবনের অপ্রাপ্তিগুলো ইদানীং বড় বেশী কষ্ট দেয়। তাই আমারও চার্লির মতো বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করে; ইচ্ছে করে ঝুম বৃষ্টির মাঝে হেটে চলি উদ্দেশ্যহীন ভাবে দূরে বহুদূরে। আমি মনে মনে বলি – যখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরে, জীবনের সমস্ত প্রাপ্তিকে ছাপিয়ে কেন অপ্রাপ্তিগুলো আমায় ঘিরে ধরে? কেন আদিগন্ত প্রকৃতির মাঝে শুধু অনুভব করি বিশাল শূন্যতা? আমার কি কোন অসুখ করেছে – কোন এক ভালো না লাগার অসুখ ! দূর থেকে হুমায়ুন বলে উঠে – ‘মাঝে মাঝে বৃষ্টি নামে, একঘেয়ে কান্নার সুরের মতো সে-শব্দ। আমি কান পেতে শুনি। বাতাসে জামগাছের পাতায় সরসর শব্দ হয়। সব মিলিয়ে হৃদয় হা-হা করে উঠে। আদিগন্ত বিস্তৃত শূন্যতার কি বিপুল বিষণ্ণতাই না অনুভব করি। জানালার ওপাশের অন্ধকার থেকে আমার সঙ্গীরা আমায় ডাকে। একদিন যাদের সঙ্গ পেয়ে আজ নিঃসঙ্গতায় ডুবেছি’। আমি ওকে বলি তুমিও বিষণ্ণতায় ডুবে যাও হুমায়ুন ? অথচ, তুমি না বৃষ্টি বিলাসী? নেত্রকোনার গ্রামের বাড়ীতে তুমি খোলা আকাশের নিচে ঝুম বৃষ্টির মাঝে খাটিয়ায় শুয়ে থাক বালিশে মাথা রেখে; তুমি টিনের চালে বৃষ্টির সিম্ফনি শুনতে নুহাস পল্লীতে বানাও স্বপ্নের ঘর, বৃষ্টিবিলাস – এসবই কি তোমার পাগলামি? হুমায়ুন হেসে বলে – রজার মিলার কি বলেছ জান? – ‘কিছু মানুষ আছে যারা বৃষ্টিকে অনুভব করে, বাকিরা শুধু শরীর ভেজায়’। আমি বলি, আমি জানি তুমি শুধুশুধু বৃষ্টিতে শরীর ভেজাও না। তুমি বৃষ্টিকে বড় বেশী ভালবাস, যেমন করে ভালবেসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বৃষ্টি তার সৃষ্টির প্রেরণা। বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে তিনি লিখে ফেলেছেন শতাধিক কবিতা। সে কবিতা আজোও আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আমি কান পেতে শুনি হেমন্ত গাইছে
‘এমন দিনে তারে বলা যায় এমন ঘনঘোর বরিষায়’…’
আমি রবীঠাকুরকে জিজ্ঞেস করি কবি, এমন দিনে তাকে কি বলা যায়? কবি হেসে বলেন ‘যাকে ভালোবাসি তার দু’হাত চেপে ধরে বলতে ইচ্ছা করে জন্মজন্মান্তরে তুমি আমার।
ব্যাকুল বেগে আজি বহে বায়
বিজুলি থেকে থেকে চমকায়।
যে কথা এ জীবনে রহিয়া গেল মনে
সে কথা আজি যেন বলা যায়
এমন ঘন ঘোর বরিষায় …’
Leave a Reply