৪।
পৃথিবীর সভ্যতার সূত্রপাত হতে মানুষের ধর্ম বিশ্বাসের পরিবর্তন কিভাবে হয়েছে, এবং ঐশী ধর্মের উৎপত্তি ও তাঁর বিস্তার কিভাবে হয়েছে এবং তারই ধারাবাহিকতায় ইসলাম ধর্ম কিভাবে এসেছে, মহামানব উপন্যাসে তাই চিত্রায়িত করা হয়েছে।
মহামানব।
ইব্রাহিম নবী-৩
জুডিয়ান পাহাড়ের সবুজ দৃশ্যের শেষ, বৃক্ষহীন ধূসর অঞ্চলের শুরু। এরপরেই নাগেব মরু অঞ্চল। নাগেবের সবচেয়ে বড় শহরের নাম বীরসীবা। এর পাশ ঘেঁষে নাহাল বীর সীবা নামে একটি ওয়াদি চলে গেছে। ওয়াদি হল প্রকৃতি সৃষ্ট খাল। বৃষ্টির পানি এ খালের মাধ্যমে নিস্কাশিত হয়। তাই এখানে কিছুটা পানির দেখাও মেলে, সাথে মেলে ছিটেফোটা গুল্মঘাস আর মরুগাছের। পশুচাড়ন ছিল লোকজনের প্রধান পেশা, এছাড়া কিছু পরিমাণ কৃষিকাজও চলে।
ইব্রাহিমের উপর সহীফা অবতীর্ণ হয়েছিল। ঘরে বসে সহীফা পড়ে সময় কাটে তাঁর। আগের মতো আর বাইরে বের হননা। বলা যেতে পারে একরকম অবসর জীবন যাপন করছেন তিনি। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনা ছিল ভিন্নরকম। হঠাৎই একদিন জিব্রাইল এসে হাজির হয়ে বললেনঃ
হে খলিলুল্লাহ! আল্লাহ আপনাকে কা’বা ঘর পূনঃনির্মান করতে বলেছেন।
ইব্রাহিম নবী জিজ্ঞাসা করলেনঃ
কা’বা ঘর কি?
তাঁর কথা শোনার আগেই জিব্রাইল ফেরেশতা চলে গেছে। তিনি অসহায়ের মতো এদিক ওদিক খুঁজতে লাগলেন। কি করবেন এখন?
ইব্রাহিম চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তিনি কখনো কা’বার নাম শোনেন নাই। এ ঘরের সন্ধান কোথায় পাবেন?
অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন তিনি।
ইব্রাহিমের অসহায়ত্ব যেন জিব্রাইল বুঝতে পারলেন। একদিন রাতে স্বপ্নে জিব্রাইল আসলেন, বললেনঃ
হে খলিলুল্লাহ ! আগামীকাল আপনি উটের পিঠে চড়ে উটটিকে ছেড়ে দিবেন।
ঘুম ভেঙ্গে গেল ইব্রাহিমের। বাকী রাত জেগে রইলেন!
চিন্তা করলেন, আদৌ এরকম করা ঠিক হবে কি, না?
সকালে ইব্রাহিম দূরদেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলেন। উটের পিঠে চড়লেন। কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে উটটিকে ইচ্ছেমত চলার সুযোগ দিলেন।
উটটি চলতে লাগল স্বাধীনমত।
প্রথমেই নিয়ে গেল দক্ষিণ-পূর্ব রাস্তায়। এ পথটি অসংখ্য পাহাড় আর উপত্যকা পার হয়ে চলে গেছে মৃত সাগরের দিকে। মনে কৌতুহল জাগে ইব্রাহিম নবীর! দেখা যাক উটটি কোথায় নিয়ে যায়!
বীরসীবা এলাকা ছিল মরু অঞ্চল। সমুদ্রের মাঝে পাহাড়ের মতোই বেলে আর চুনাপাথরের পাহাড় জেগে উঠেছে বীরসীবার মরুতে।
ধূসর মরুপথ আর পাহাড় অতিক্রম করে এগিয়ে চলছেন তিনি। মাঝে মাঝে সংক্ষিপ্ত পথে পাহাড়ের শিড়দারা বরাবর অতিক্রম করতে হয় বেশ বিপজ্জনকভাবে। এভাবে চলতে চলতে একসময় একটি চূড়া থেকে দূরে সাগর দেখা গেল।
সাগরটির নাম মৃত সাগর বা ডেড সী, এটি উত্তর দক্ষিণ বরাবর লম্বা। সাগর ও এর আশেপাশের এলাকাটিকে জর্ডান রিফ্ট ভ্যালী বলে। এই সাগরের দুইদিকে দুই দেশ! দুই দেশে দুইটি পাহাড় শ্রেনী সাগরের সমান্তরালে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর চলে গেছে। উভয় দেশের পাহাড় মৃত সাগরের দিকে ক্রমশ ঢালু হয়ে নীচের দিকে এক বিশাল উপত্যকা তৈরী করেছে। মৃত সাগরের অবস্থান এ উপত্যকাতেই। আর এটিই হল পৃথিবীর সবচেয়ে নীচু জায়গা।
ক্লান্ত ইব্রাহিম ভর দুপুরে জলপাই গাছের নীচে বসলেন। কেনানে এমন কোন জায়গা নাই যেখানে জলপাই গাছ দেখা যায়না। কিছুদূর গেলে জলপাই গাছ চোখে পড়বেই। দূরের ন্যাড়া পাহাড়ের দিকে ইব্রাহিম তাঁকিয়ে আছেন। বৃক্ষহীন নগ্ন পাহাড়ের স্তরের সজ্জা চোখে পড়ার মতো। সাথে উপত্যকা আর দূর্গম গিরিখাত পাহাড়গুলোকে করেছে ভয়ংকর দর্শন।
ধূসর নগ্ন পাহাড়ে সূর্যরশ্মি পতিত হয়ে বিকিরিত হয়। দূর থেকে মনে হয় কম্পমান আগুনের শিখা। ইব্রাহিমের মনে পড়ে নমরুদের কথা! তাঁকে আগুনে ফেলে দেয়ার কথা।
ইব্রাহিম নবী-৪
বিরাট পরিখায় দিনরাত কাঠ জমা করে আগুন জ্বালানো হয়। দিনের পর দিন দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে। চারিপার্শ্ব এতোটাই উত্তপ্ত হল যে পুড়িয়ে ফেলার উপক্রম। কাছের গাছপালা সব পুড়ে ছাই, দুরের গাছপালাও পোড়া পোড়া। কাছাকাছিতো নয়ই, অনেক দূরেও মানুষ দাঁড়ায় না, পাখিও উড়তে পারেনা।
প্রান্তরের সীমায়, রেখার মতো দাঁড়িয়ে অত্যুৎসাহী কিশোর কিশোরী, যুবক যুবতী আর নরনারীরা। আছে রাজা আর রাজন্যবর্গ। কৌতুহলে সবাই বসে আছে পাশের উঁচু মঞ্চে।
একজন সৈনিক উচ্চস্বরে ঘোষনা করতেই, শুনশান নীরবতা নেমে এল। হঠাৎই মিনজালিকের (দুর থেকে নিক্ষেপ করার যন্ত্র) শব্দ শোনা গেল। গোলার মতো কিছু একটা নিক্ষিপ্ত হল আগুনে। করতালি আর উল্লাসে চাপা পড়ল ইব্রাহিমের আর্তনাদ।
অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল নমরূদ। উপহাস্যে প্রতিধ্বনি ঠিকই ফিরিয়ে দিল ঐ দূর পাহাড়। কিন্তু কেউই শুনতে পারলোনা।
ইব্রাহিম-৫
প্রাচীন মেসোপটেমিয়ানরা বহুশ্বেরবাদে বিশ্বাসী ছিলো। প্রতিটি জিগুরাট ও মন্দিরেই ছিল বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ, যেমন ধনি-দরিদ্র, ব্যাবসায়ী, কামার-কুমার, মজুর ও কৃষক শ্রেণীর লোকেদের বসার ব্যাবস্থা। মানুষদের দেবতা ছিল যথাক্রমে আকাশ, বাতাস, পৃথিবী ও সমুদ্র। বিশ্বাস ছিল এরাই চাঁদ, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্রের নিয়ন্ত্রক।
এই মেসোপটেমিয়াতেই ইব্রাহিম আঃ, প্রায় চার হাজার বছর পূর্বে জন্মগ্রহন করেন। জন্মস্থান ছিল বাগদাদ থেকে ৩৯৬ কিলোমিটার দূরে ‘উর’ শহরে। সেখানে বসবাস করত
তখন কালেডীয় জাতি।
উরের রাজা ছিল নমরূদ। ভীষণ উদ্ধত আর অহংকারী। অন্যান্য কৃষি অঞ্চলের রাজাদের মতো, সেও নিজেকে ‘উপাস্য’ দাবী করতো। একদিন রাজজ্যোতিষী ভবিষ্যৎ বানী করল যে, রাজ্যে অচিরেই একটি পুত্র সন্তান জন্মলাভ করবে, যার কারণে তিনি রাজ্য হারাবেন। কথাটি শুনে নমরূদ, রাজ্যের সকল শিশুপুত্রকে হত্যার নির্দেশ জারি করেন।
নমরূদের প্রধান পুরোহিত, আজরের স্ত্রী ছিল সন্তানসম্ভবা। আসন্ন সন্তান প্রসবের কথা চিন্তা করে তিনি লুকিয়ে গুহায় চলে গেলেন। সেখানেই তিনি প্রসব করলেন ফুটফুটে এক সন্তান। নমরূদের লোকজনের কাছে ধরা পড়লে নিশ্চিত মৃত্যু। তাই জেনেশুনেই তিনি নিজ সন্তানকে গুহায় রেখে গেলেন, এতে কিছুটা হলেও বাঁচার আশা থাকে।
গুহাটি পাথরের তৈরী হলেও সেখানে ছিল একটি ঝর্ণাধারা। এক কোনায় পানি জমা হতো। জীবন ধারণের জন্য নূন্যতম পানীয় সুবিধা থাকায় শিশুকাল পার হলে বাঁচার আশা অবশ্যই আছে ভেবে, মা মাঝে মাঝে লুকিয়ে এসে দেখাশুনা করে যায়। এভাবে শিশুটি একা একাই বড় হতে থাকে গুহাতে। তবে প্রতিমুহুর্তে থাকত ধরা পরে যাবার ভয়।
এভাবে দিনের পর দিন বড় হতে থাকে শিশুটি। পার হয়ে যায় তিনটি বছর। গুহার বৈরী পরিবেশে মানসিক বৈকল্যতা নিয়ে শঙ্কা থাকলেও বাস্তবে দেখা গেল অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা তাঁর। কথায় কথায় সে একদিন মা’কে জিজ্ঞেস করলঃ
মা, আমার প্রভু কে?
মা উত্তর দিলঃ
নমরূদ।
শিশুটি বললঃ
নমরূদের প্রভু কে?
প্রশ্ন শুনে মা ভড়কে গিয়ে চড় মারলেন শিশুটির গালে। ঠিক কোন কারণে চড় খেল, শিশুটি তা বুঝতে না পারলেও, মা ঠিকই বুঝলেন এই শিশুটিই হল সেই ছেলে, যার সম্পর্কে নমরূদ স্বপ্ন দেখেছিলেন!
ইব্রাহিম-৬
শিশুটির পিতা ছিল নমরুদের প্রধান পুরোহিত। তবে তাঁর প্রধান পেশা ছিল মূর্তি বানিয়ে বাজারে বিক্রি করা। আর মানুষেরা এই মূর্তিগুলোই ক্রয় করে তাদের পূজা করতো।
ছেলের জন্মতে আজর ছিল খুশি। তিনি ভাবলেন; আমার পর এই ছেলে হবে একদিন পুরোহিত, রক্ষা করবে বংশের ঐতিহ্য। খুশিতে আজর পুত্রের নাম রাখলেন ইব্রাহিম।
ইব্রাহীমের জ্ঞান-বুদ্ধি দেখে অবাক হয় আজর। মনে মনে স্বপ্ন দেখে ছেলে তাঁর চেয়েও ভাল মূর্তি বানাবে, তাঁর চেয়েও সুনাম ছড়িয়ে পড়বে। অপরদিকে ইব্রাহিমের স্বপ্ন ছিলো একদিন তাঁর বাবা আর মূর্তি তৈরী করবে না, তাঁর পূজা করবে না। একই ঘরে দুইজন মানুষ দুই বিপরীতমূখী স্বপ্ন দেখে বড় হতে লাগল।
দিনে দিনে ইব্রাহিমের ভাবনা পরিপূর্ণতা পেতে লাগল। তিনি ভাবেন, যারা কারো উপকার করতে পারে না, যারা কারো অপকারও করতে পারে না, তারা খোদা হয় কেমন করে? আবার
দেবতাগুলি নিজেকে রক্ষাও করতে পারেনা যদি কেউ ক্ষতি করতে চায়।
সৃষ্টিকর্তা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিলেন, তাঁর উপর সহীফা অবতীর্ণ হয়। এতে তাঁর জ্ঞানচক্ষু খুলে যায়। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, সৃষ্টিকর্তা নিয়ে মানুষের ভুল ভাঙ্গতে হবে।
একদিন তিনি তাঁর বাবাকে বললেনঃ
বাবা, আপনি এবং আপনার জাতির লোকেরা পরিস্কার ভুলের মধ্যে আছেন।
আজর সরাসরি ইব্রাহিমের দিকে না তাঁকিয়ে কান খাড়া করল, ছেলে বলে কি!
যে শোনে না, যে দেখে না এবং যে কারও উপকার করতে পারে না, আপনারা কেন সেই মূর্তির পূজা করেন, বললেন ইব্রাহিম।
সমাজপতিদের অনেকেই উপস্থিত ছিল। ইব্রাহিমের কথা শুনে তাঁরা হতবুদ্ধি হয়ে গেল।
ইব্রাহিম আরও বললঃ
আমার কাছে এমন জ্ঞান এসেছে, যা তোমার কাছে আসেনি। অতএব তুমি আমাকে অনুসরণ কর, আমি তোমাকে পথ দেখাব।
কথাশুনে সমাজপতিরা ভয়ংকর রেগে গেল। এসব কি বলে ইব্রাহিম!
জীবনভর তাঁরা মূর্তিপূজা করে এসেছে। তাঁদের জীবনের অংশ হল এই মূর্তি। তাঁদের আনন্দ-বেদনার অংশ হল মূর্তি। আজ এসব কি শুনছে!
সবাই আজরের মূখের পানে চেয়ে যেন বুঝিয়ে দিতে চাইল তাঁদের মনোভাব। আজরের দারুণ মানসম্মানে লাগল। সে ক্রুদ্ধ হয়ে বললঃ
ইব্রাহীম!
তুমি যদি কথা বলা বন্ধ না কর, তবে আমি পাথর মেরে তোমার মাথা ভেঙ্গে দিব। আজ থেকে তুমি আর আমার সাথে থাকবে না।
পিতার কথায় ইব্রাহীম বললেনঃ
বাবা, তোমার উপর শান্তি বর্ষিত হৌক! আমি আমার পালনকর্তার কাছে তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব।
তুমি এখান থেকে চিরতরে বিদায় হয়ে যাও! চীৎকার করে উঠল আজর।
আমি পরিত্যাগ করছি তোমাদেরকে এবং আল্লাহ ব্যতীত তোমরা যাদের পূজা কর তাদেরকে, বলে সেখান থেকে বের হয়ে গেল ইব্রাহিম।
সমাজপতিরা ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর গমন পথের দিকে তাঁকিয়ে রইল।
Leave a Reply