মহামানব।
পৃথিবীর সভ্যতা
পৃথিবীর সভ্যতার সূত্রপাত হতে মানুষের ধর্ম বিশ্বাসের পরিবর্তন কিভাবে হয়েছে, এবং ঐশী ধর্মের উৎপত্তি ও তাঁর বিস্তার কিভাবে হয়েছে এবং তারই ধারাবাহিকতায় ইসলাম ধর্ম কিভাবে এসেছে, মহামানব উপন্যাসে তাই চিত্রায়িত করা হয়েছে।
মহামানব।
পৃথিবীর সভ্যতা।
———————-‐——————
কৃষিকাজ শুরুর পর থেকে মানুষ স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। সূত্রপাত হয় সুশৃঙ্খল জীবনের। নদী তীরবর্তি উর্বর ভূমি মানুষ বেশী পছন্দ করতো। সেখানে দলবদ্ধভাবে বসবাস করার ফলে সহজেই সেসব জায়গায় সভ্যতার বিকাশ ঘটে।
তবে কিছু কিছু অঞ্চল প্রাকৃতিকভাবে পশু সম্পদ ও নানারকম খাদ্যের উৎসে পরিপূর্ণ থাকায়, সেখানেও মানুষ স্থায়ী হতে থাকে। কিন্তু প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডে সুশৃঙ্খল জীবনের বিন্যাস না থাকায়, সেখানে সভ্যতার সূচনা ঘটলেও তা ছিল অত্যন্ত ধীর।
চারটি বিখ্যাত নদীর তীরে পৃথিবীর প্রথম চারটি সভ্যতার বিকাশ শুরু হয়। নদীগুলো হলো যথাক্রমে নীলনদ, ইফ্রেতিস ও টাইগ্রিসের মধ্যবর্তী অঞ্চল, সিন্ধু নদ ও চীনের ইয়েলো বা পীত নদী। কালক্রমে এই সভ্যতাগুলো বিস্তার লাভ করে, আবার কিছু কিছু সভ্যতা নদীর গতিপথ পরিবর্তনের সাথে সাথে ধ্বংস হয়ে যায়।
সভ্যতা-১
সূর্য ডুবে গেছে কখন টেরই পায় নাই, গোধূলির আলো নিভে নাই তখনও। শখ করে পিরামিড দেখতে আসা। এখানে আছে পরপর তিনটা পিরামিড। একটা আবার এতবড় যে, তা আদৌ মনুষ্য নির্মিত কি না সন্দেহ আছে।
এ বিস্ময়কর জিনিস বিশ্মিত করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কখন যে সব দর্শনার্থীরাই একে একে বিদায় নিয়েছে, তা খেয়ালই করে নাই আগন্তুক।
সে একা! দ্রুত হাঁটতে লাগল ট্যাক্সি ষ্ট্যান্ডের দিকে। পাশেই রহস্যময় স্ফিংস! পাথরের তৈরী বসে থাকা এ সিংহ মূর্তিটির মুখখানি আবার মানুষের। অনেকেই বলে নির্মাতা ফারাও খাফ্রের মুখ এটি। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শেষবার একটু তাঁকাল পথিক।
হঠাতই মুর্তিটি বলে উঠলঃ
দাঁড়াও!
ভয়ে পথিকের রক্ত হিম হয়ে গেল! সে দ্রুত পার হতে চাইল কিন্তু পারলোনা।
মূর্তিটি জিজ্ঞাসা করলঃ
এই পিরামিড তিনটি কে তৈরী করেছে?
পথিকের বিশ্মিত হওয়ার ক্ষমতা লোপ পেয়ে গেছে। মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছেনা। অবশ্য বের হলেও লাভ হতোনা। বড়টা কে তৈরী করেছে জানলেও বাকি দুইটার নাম মনে পড়ছেনা।
শুধু খুফু বলার পর, সে দেখতে পেল সিংহের হাত দুটি বের হয়ে তাঁর গলা টিপে ধরল। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তাঁর।
মৃত্যুর আগে কোনরকমে বলতে পারলঃ
খাফ্রে, মেনেকার!
হাত দুটি সরে গেল। বড় বড় শ্বাস ফেলতে লাগল লোকটি।
মরুভূমির পাহারাদার স্ফিংস নিয়ে এমনই রহস্যময়তা ছিল একসময়। সেই রহস্য দূর হলেও মিশরীয়দের অনেক রহস্যই এখনও অজানা।
নীলনদের উর্বর উপত্যকায় এ সভ্যতার উৎপত্তি হয়েছে খৃষ্টপূর্ব ৩২০০ সালে। প্রথমে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নগর বা নোমের উৎপত্তি হয়। সভ্যতা গতিশীল হয় যখন রাজা মেনেস উত্তর আর দক্ষিণ মিশরকে একত্রিত করেন। মিশরের রাজাদের ফারাও বলা হয়। একত্রিত হওয়ার আগে বলা হতো স্করপিয়ন।
ধীরে ধীরে ফেরাউনরা একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠে। তাঁরা ছিল প্রধান শাসক, প্রধান বিচারক, প্রধান ধর্মীয় ও সামরিক নেতা। নিজেদেরকে মনে করতো ঈশ্বরের অংশীদার। প্রভাব, প্রতিপত্তি আর শক্তিমত্তা দেখে জনগণও তাই বিশ্বাস করতো। তাঁদের কথাই ছিল আইন, তাঁদের কথাই ছিল ঈশ্বরের কথা।
জনগণ নির্দ্বিধায় তা মেনে চলতো।
মিশরীয়রা বহু দেবদেবীর পূজা করত। প্রতিটা নগরের আলাদা দেবদেবী ছিল। মেমফিসের প্রধান দেবতা ছিল প্টা। আবার ওনু বা হোলিওপলিস শহরে ছিল সূর্যদেবতা, রে। উর্বরতার দেবতা আমেন ছিল থিবস শহরের প্রধান দেবতা।
শিকার ধরার জন্য তাঁরা যে সকল পশুকে নির্দিষ্ট করতো, শিকারের পূর্বে তাঁরা ঐ সকল পশুর পূজা করতো। পরবর্তীতে বিভিন্ন দেব-দেবীর মূখাকৃতি নানা ধরনের পশুর রূপে প্রকাশ করতো তাঁরা।
মিশরীয়রা বিশ্বাস করতো, এ জীবন, মৃত্যু পরবর্তী জীবনের অংশ। মৃত্যুর পর তাঁরা আলাদা জগতে আবার জীবন্ত হয়ে উঠবে। আবার রাজ্য শাসন করবে।
ফারাওদের তাই মৃতদেহকে অবিকৃত রাখার নিদারুণ চেষ্টা ছিল। এক পর্যায়ে সফলও হয়, দেহ অবিকৃত রাখার কৌশল হিসাবে মমি বানিয়ে ফেলে তাঁরা।
মমি বানালে কি হবে দেহগুলোকে রক্ষা করার জন্য মজবুত ঘরের দরকার। প্রথম প্রথম তাঁরা মাটির ইট দিয়ে তৈরী করতো সমাধি মন্দির, মাসতাবা। দেখতে অনেকটা আয়তাকার, উচ্চতার দিকে কিছুটা ঢাল বিশিষ্ট।
পরবর্তীতে মাসতাবার পরিবর্তে পিরামিড বানানো শুরু করে। পিরামিডের ভিতরে ফেরাউনের মৃতদেহের সাথে ক্রীতদাসদের মেরে মমি করে রেখে দিত। যেন মৃত্যুর পরে জীবিত হয়ে ফারাওদের কাজকর্ম করতে পারে। ভোগ বিলাসের জন্য সঙ্গে দিত সোনাদানা আর নিত্য ব্যবহার্য্য জিনিসপত্র।
তবে পিরামিড বানানোর উদ্দেশ্য শুধু যে দেহ রক্ষাই ছিল তা নয় বরং মানুষের ভয় আর শ্রদ্ধা অর্জন করাও ছিল অন্যতম উদ্দেশ্য। আবার এ নির্মাণ কাজে কিছুটা অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যও সাধিত হতো।
বছর বছর নীলনদের বন্যার সময় লোকজন কর্মহীন হয়ে পড়লে পিরামিড বানানোর কাজ শুরু হতো। ফলে লোকজন ব্যাস্ত হয়ে যেত আর অর্থনীতিতে প্রাণের সঞ্চার হতো।
অনেক ফারাওয়ের পুত্র সন্তান না থাকায়, অথবা কোন ফারাও দূর্বল হলে তাঁর ঘনিষ্ঠ কোন আমত্য অথবা জেনারেল ফারাও হতো। কখনওবা আগের ফারাওকে হত্যা করে; নতুন কেউ ফারাও হতো। এক্ষেত্রে জতি একজন দূর্বল, অক্ষম, অপ্রাপ্তবয়েসী ফারাওয়ের পরিবর্তে একজন সক্ষম ফারাওকে স্বাগত জানাত।
তবে মানুষের দেবত্বপ্রাপ্ত রাজপরিবারের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালবাসা দূর হতোনা। সে কারনে নতুন শাসককে এমন শক্তি প্রদর্শন করতো হতো যে, পুরাতন ফারাওদের কীর্তিকেও ছাড়িয়ে যায়।
প্রথম পিরামিড তৈরী করে ফারাও জোসার। তাঁর স্থপতি ছিল ইমহোটেপ। ইমহোটেপকে নিয়ে অনেক কিংবদন্তি প্রচলিত ছিল মিশরে।
তবে মাঝেমধ্যেই দেশী বিদেশী অনেক দস্যুদল এসব পিরামিডে লুটপাট চালাতো। তাই পরের দিকের ফেরাউনেরা পাথরের পাহাড় কেটে কেটে গুহা তৈরী করে সেখানে মমি রেখে দিত।
থিবসের ভ্যালীতে এরকম অসংখ্য মমি পাওয়ায়, তাই এ জায়গার নাম হয়ে যায় ভ্যালী অব দ্য কিং।
শুধু মাসতাবা আর পিরামিড নয়, শক্তি আর ক্ষমতা প্রকাশ করার জন্য তাঁরা ওবেলিস্ক, মন্দির, আর রাজকীয় প্রাসাদ তৈরী করতো। স্থাপত্যে তাঁরা যে প্রযুক্তির ব্যবহার দেখিয়েছে, তা এ যুগেও বিস্ময়কর ঠেকে। কিভাবে খনি থেকে বিশাল বিশাল সব পাথর তুলে আনতো আর কিভাবেই তা বয়ে নিয়ে যেতো তা আজও রহস্য। নিঃসন্দেহে মিশরীয়রা ছিল অনেক উন্নত মানের, অনেক উন্নত চিন্তার।
দীর্ঘসময় ফারাওরা ধর্মীয় ব্যাপারে একই ধরনের চিন্তাভাবনা করলেও, ফারাও চতুর্থ আমেনেমহাত হঠাতই একেশ্বরবাদের প্রচলন করেন। তিনি বহু দেবদেবীর পূজা বন্ধ করে আতেনের পূজা চালু করেন। আতেন মানে সূর্য। তিনি তাঁর নিজের নামও পরিবর্তন করে রাখেন আখেনাতেন।
মন্দিরের রহস্যময় পরিবেশ ছেড়ে মধ্য দিবসের সূর্যের দিকে সেজদার রীতি চালু করলেন তিনি। তবে আশ্চর্যজনকভাবে দিকটি ছিল কা’বা মূখী।
তাঁর এই নতুন ধর্ম প্রচারে তিনি প্রভাবশালী পুরোহিতদের সাথে কোনভাবেই পেরে উঠলেন না। অনেক দমন নিপীড়ন চালালেন, শেষে রাজধানী সরিয়ে আনলেন আখেনাতেনে। তবুও মিশরীয়দের ধর্ম বিশ্বাসে কোন পরিবর্তন হলোনা। এ ধর্ম বিশ্বাস তাঁকে এতোই আচ্ছন্ন করে রেখেছিল যে নিজ পুত্রের নাম রাখেন তুতেনাখতেন।
তাঁর মৃত্যুর পর মিশরীয়রা আবার ফিরে গেল বহুশ্বেরবাদে। সারা মিশরে একজনও একেশ্বরবাদী রইলোনা, এমনকি তাঁর পুত্রের নামও পরিবর্তন করে রাখা হলো পুরোনো দেবতা অমেনের নামে তুতেনখামেন।
লিখন পদ্ধতির প্রাথমিক রূপ উদ্ভাবিত হয়েছিল নাকাদা সংস্কৃতির সময়ই, হাজার বছরের মধ্যেই এর পূর্ণরূপ হায়ারোগ্লাফিক্সের ব্যবহার শুরু হয়। এখানে একটি ছবি একটা করে অক্ষর বোঝায়। প্রথমে পাথরের উপর উৎকীর্ণ করলেও পরে প্যাপিরাস গাছ পাথরের নীচে রেখে দিয়ে সমান করে লিখতো।
সাহিত্য, কলা, গণিত, ত্রিকোণমিতি, চিকিৎসা-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতিতে মিশরীয়রা প্রচুর উন্নতি সাধন করেছিল।
ধর্মীয় কাজে ছিল পুরোহিতদের একচেটিয়া অধিকার। তাঁরা ছিল সমাজের উচ্চশ্রনী। এছাড়াও লিপিকার, প্রশাসনিক কর্মকর্তারা ছিল মর্যাদাসম্পন্ন।
কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ জনগণের অবস্থান ছিল সবার নীচে। সভ্যতার শুরুতে ক্রীতদাস থাকলেও, সংখ্যায় কম ছিল। অন্যান্য সভ্যতার চেয়ে মিশরীয় দাসদের অবস্থা ভাল ছিল। বেশকিছু সামাজিক অধিকার তাঁরা ভোগ করতে পারতো।
মিশরের নীল উপত্যকা ছিল প্রাকৃতিকভাবে সুরক্ষিত। তাই বৈদেশিক আক্রমণ বলতে গেলে ছিলোই না। শুধু নিজেদের মধ্যে কিছু যুদ্ধ ছাড়া মিশরকে দীর্ঘদিন বড় কোন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার দরকার হয়নি।
পূর্বে ছিল দূর্গম সিনাই উপত্যকা। অত্যন্ত দূর্গম হওয়ায় এ পথে আক্রমণ সহজ ছিলোনা। উত্তরে ভূমধ্যসাগর থাকায় আর পৃথিবীতে জাহাজ চলাচল শুরু না হওয়ায়, আক্রমণের কোন সম্ভাবনাই নাই। পশ্চিমে মরুভূমি থাকায় এ পথেও কেউ আক্রমণ করতোনা। দক্ষিণে নীলনদের চতুর্থ জলপ্রপাত। এ পথে সহজেই কেউ নেমে আসতো না, সেখানে সংগঠিত আক্রমণতো দূরের কথা। ফলে সভ্যতার শুরু থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর পর্যন্ত মিশর ছিল মিশরীয়দের।
মিশরীয়রা পশ্চিম এশিয়ার জুডিয়া, ইসরাইল, ফিনিসিয়, লিডিয়দের সাথে ব্যবসা বাণিজ্য করতো। এছাড়া পুন্টের সাথেও ছিল তাঁদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক। পুন্ট হলো আফ্রিকান হর্ণের অন্তর্গত দেশসমূহ যেমন সোমালিয়া, ইথিওপিয়া ইত্যাদি। প্রাচীনকালে সেখানেও সভ্যতার উম্মেষ ঘটেছিল।
দেশীয় ফারাওরা মিশর আড়াই হাজার বছর শাসন করলেও মাঝে কিছুদিন স্থানীয় প্রশাসক, হিসকোস নামক কেনানী সম্প্রদায়, পুরোহিতশ্রনী, লিবিয় বারবার ও কুশীয় ফারাওদের শাসন চলেছে।
লেভাল্টের উপর কর্তৃত্ব নিয়ে মিশর বরাবরই সতর্ক থাকত। এ কারণে অ্যাসিরিয়ার সাথে প্রায়ই বিরোধে জড়াতো। এ বিরোধের জের ধরেই অ্যাসিরিয়ার আসুরবনিপাল মিশর দখল করে বসে।
তবে তিনি মিশরের শাসন স্থানীয় শাসকদের কাছেই ন্যাস্ত রাখেন। এ সকল শাসকদের সৈতে রাজা বলা হতো। কিছুদিন পর সৈতে রাজারাও অ্যাসিরিয়ার অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে আবার স্বাধীনভাবে মিশর চালাতে থাকে।
ষষ্ঠ শতাব্দীতে ব্যাবিলনের সম্রাট নেবুচাদনেজার পশ্চিম এশিয়া দখল করলেও মিশর দখল করে নাই। তবে তিনি জেরুজালেম ধ্বংস করে দেন। তাঁর মৃত্যুর পর পারস্যের শাহেনশাহ ক্যামবিসিস সমগ্র মেসোপটেমিয়া ও মিশর দখল করে সরাসরি পারস্যের শাসন চালু করে।
খৃষ্টপূর্ব ৩৩২ সালে আলেকজান্ডার মিশর আক্রমণ করলে পারস্যের মিশরীয় শাসক বিনা যুদ্ধে মিশরকে গ্রীকদের হাতে তুলে দেন। পরবর্তিতে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মিশর আর মিশরীয়দের থাকেনা, বিশ্বও আর দেখতে পায়না নতুন কোন পিরামিড।
Leave a Reply