৩।
পৃথিবীর সভ্যতার সূত্রপাত হতে মানুষের ধর্ম বিশ্বাসের পরিবর্তন কিভাবে হয়েছে, এবং ঐশী ধর্মের উৎপত্তি ও তাঁর বিস্তার কিভাবে হয়েছে এবং তারই ধারাবাহিকতায় ইসলাম ধর্ম কিভাবে এসেছে, মহামানব উপন্যাসে তাই চিত্রায়িত করা হয়েছে।
মহামানব।
সভ্যতা-২
পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতার কেন্দ্র ছিল মেসোপটেমিয়া। ৩৫০০ খৃষ্টপূর্বাব্দে সেখানে সভ্যতার শুরু হয়। বর্তমান ইরাকের দুই নদী টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিসের মধ্যবর্তী উর্বর অঞ্চলকে বলে মেসোপটিমিয়া বা ফার্টাইল ক্রিসেন্ট।
উর্বর এই অঞ্চলে যাযাবরেরা ঘুরে বেড়াত। তাই তখন তাবু কেন্দ্রিক রাজারা শাসন করে বেড়াত। ধীরে ধীরে লোকজন জমতে থাকে, একসময় শুরু হয় কৃষিকাজ। কৃষিকাজের জন্য লোকজন স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। এরপর শুরু হয় বিভিন্ন সভ্যতার উত্থান। সুমেরীয়, আক্কাদীয়, অ্যাসিরিয়, ব্যাবিলনীয়, নব্য ব্যাবিলনীয়রা ছিলো মেসোপটিমিয়া সভ্যতার অংশ।
এ সকল সভ্যতার কোনটি আগে বা কোনটি পরে উৎপত্তি লাভ করে। কোনটি আবার দূর্বল হয়ে অন্য সভ্যতার সাথে প্রতিবেশী দেশের মতো সহাবস্থানে থেকে আবার শক্তি সঞ্চয় করে। একসময় এমন হয় যে পাশের শক্তিশালী সভ্যতাকে ধ্বংস করে দেয়।
মেসোপটেমিয়া ছিল সমতল, তাই সামরিক আক্রমণের দিক দিয়ে প্রাকৃতিক কোন প্রতিবন্ধকতাই ছিলোনা। এর পূর্ব, উত্তর আর উত্তর-পশ্চিম দিক পাহাড়ী জাতিরা বসবাস করত। এ সকল পাহাড়ীরা সম্পদের লোভে প্রায়ই আক্রমণ করত। আত্মরক্ষার্থে মেসোপটেমিয়রা তাই নগরের চারিদিকে নিরাপত্তার প্রাচীর তৈরী করতো। এতেও কিন্তু শেষরক্ষা হতোনা তাঁদের।
মেসোপটেমিয়ান সভ্যতার এই দীর্ঘ সময়ে আশেপাশে কোন না কোন জাতির উত্থান ঘটতো। তাঁরা মেসোপটেমিয়ার সম্পদের প্রতি আকৃষ্ট ছিল। সভ্যতার মানদণ্ডে নিম্নমানের থাকলেও সুযোগ পেলেই তাঁরা মেসোপটেমিয়ায় আক্রমণ করে বসতো।
এদের মধ্যে মিত্তানি, হিট্টাইট, মিডিয়া, লিডিয়া, পারসিস, পার্থিয়া, এলাম উল্লেখযোগ্য। তবে এরা কেউই এ অঞ্চল দখলে রাখতে পারেনি।
এদের আক্রমণ কোন এক সভ্যতা ধ্বংস করলেও, রাজত্বের সুযোগ্ করে দিয়েছে অন্য এক সভ্যতার।
মেসোপটেমিয়ার দক্ষিণে প্রথমেই উৎপত্তি লাভ করে সুমেরীয় সভ্যতা। দীর্ঘদিন সুমেরীয়দের রাজত্ব চলে সেখানে। সুমেরীয়দের বিখ্যাত রাজা ছিল গিলগামেশ। তাঁকে নিয়ে মহাকাব্যও রচিত হয়েছে।
সুমেরদের রাজত্ব চলার সময়ই সুমেরের উত্তরে আক্কাদ নগরকে কেন্দ্র করে আক্কাদীয় সভ্যতার বিকাশ হয়। একসময় আক্কাদীয়রা সুমেরীয়দের বেশীরভাগ অঞ্চল দখল করে নেয়। তবে সুমেরীয়রা কোন রকমে টিকে থাকে। একসময় প্লেগ, দুর্ভিক্ষ আর মহামারিতে আক্কাদিয়রা দূর্বল হয়ে যায়। এ সময় যাযাবর গুটি জাতির আক্রমণে আক্কাদীয় সভ্যতা বিলুপ্ত হয়ে যায়।
সেসময় সুমেরীয়রা শক্তিশালী হয়ে আবার মেসোপটেমিয়া শাসন করতে থাকে। সুমেরীয় বিখ্যাত রাজা উর নাম্মুর বেশকিছু আইন তৈরী করে। এ সময় ইব্রাহিম নবী জন্মগ্রহণ করে, হয় উর নামক শহরে।
আসুর ছিল মেসোপটিমিয়ার উত্তরে অবস্থিত আক্কাদিয় সাম্রাজ্যের একটি করদ রাজ্য। দীর্ঘ খরার কবলে পড়ে সুমেরীয়রা দূর্বল হয়ে পড়লে, অ্যাসিরিয় নামে আরেকটি জাতি ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠে। একসময় সুমেরের বেশীরভাগ অঞ্চল দখল করে শুরু করে অ্যাসিরিয় সভ্যতা। এরপর মেসোপটেমিয়ার ইতিহাস থেকে বিদায় নেয় সুমেরীয় ও আক্কাদীয়রা।
অ্যাসিরিয়দের রাজত্ব চলাকালীন সময়ে, আক্কাদের দক্ষিণে ছোট্ট শহর ব্যবিলনে অ্যামোরাইট জাতির লোকজন বসবাস করা শুরু করে। ধীরে ধীরে তাঁরা ব্যাবিলন কেন্দ্রিক উন্নত সভ্যতার সৃষ্টি করে। মেসোপটেমিয়ার উত্তর চলে অ্যাসিরিয়ার শাসন আর দক্ষিণে মেসোপটেমিয়ার খন্ড-বিখন্ড নগর রাষ্ট্রগুলোকে এক করে একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য গঠন করে ব্যাবিলনীয়রা।
রাজা হাম্বুরাবীর সময় ব্যাবিলনীয় সভ্যতার চূড়ান্ত পর্যায় বলে ধরা হয়। তাঁর সময় অ্যাসিরিয়াও ব্যাবিলনীয়দের আওতায় চলে আসে। তিনি বিখ্যাত ছিলেন হাম্বুরাবী কোড নামে লিখিত আইন সংকলনের জন্য। চোখের বদলে চোখ, খুনের বদলে খুন; এ জাতীয় অনেক আইন সেখানে লেখা ছিল। এটা ছিল পৃথিবীর প্রথম লিখিত আইন।
ব্যবিলনীয় সভ্যতার অধীনে থেকেও অ্যাসিরীয়রা টিকে ছিল। তবে রাজা হাম্বুরাবীর মৃত্যুর পর ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্য দূর্বল হয়ে পড়ে। এই সুযোগে সীমান্ত সংলগ্ন মিট্টানীরা আক্রমণ করে ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্যের অ্যাসিরিয় অংশ দখল করে।
প্রায় একই সময় তুরস্কের হিট্টাইটরাও ব্যাবিলন শহর আক্রমণ করে লুটপাট চালায়। এই আক্রমণের ফলে ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্য আরও দূর্বল হয়ে পড়ে। এ দুর্বলতার সুযোগে জাগ্রোস পার্বত্য অঞ্চলের ক্যাসাইটরা ব্যাবিলন দখল করে সেখানেই বসবাস শুরু করে।
মিটানী ও ক্যাসাইটরা চলে গেলে, আবার জেগে উঠে মৃতপ্রায় অ্যাসিরিয়া। রাজা টিলগাথ পাইলাজার-১, ব্যাবিলন দখল করে বিলুপ্তি ঘটায় ব্যাবিলনীয় সভ্যতার। ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ মেসোপটেমিয়ার উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করে অ্যাসিরিয়রা। প্রথম দিকে তাঁদের রাজধানী ছিল আসুর।
লৌহ হাতিয়ারের কারণে তাঁরা সামরিক দিক দিয়ে ভীষণ শক্তিশালী হয়ে উঠে। হিট্টাইটদের কাছ থেকে প্রথম লৌহের ব্যবহার শিখে তাঁরা।
এরপর অ্যাসিরিয়ার শক্তিশালী রাজা ছিল সেনাচেরিব আর আশুরবিনিপাল। সেনাচেরিব ইসরাইল ও জুডিয়া পর্যন্ত দখল করে। তাঁর পুত্র আশুরবিনিপাল মিশর দখল করে। মিশরে সে মিশরীয় শাসক নিয়োগ করে মেসোপটেমিয়ায় চলে আসে। সেসময় রাজধানী সরিয়ে নিয়ে আসা হয় নিনেভে।
আশুরবিনিপালের মৃত্যুর পর অ্যাসিরীয়রা দূর্বল হয়ে পড়ে। এর কিছু অংশ মিশর, কিছু অংশ পারস্য দখল করে। তবে একটি অংশ ক্যালডীয় নামে শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে।
ক্যালডীয় রাজা নবোপোলাসার আশেপাশের রাজ্যের সহায়তায় নিনেভ ধ্বংস করে। মূলত তিনিই এ ক্যালডীয় সভ্যতার প্রতিষ্ঠিতা। তাঁরপুত্র নেবুচাদনেজার ব্যাবিলন দখল করার পর এ নগরের ব্যাপক সমৃদ্ধি ঘটে। তিনি শহরের চারিদিক ঘিরে বিশাল চওড়া দেয়াল তৈরী করেন।
ইসরাইল, জুডিয়া, ফিনিসিয়া, সিরিয়াসহ বিশাল এলাকাজুড়ে সাম্রাজ্য স্থাপন করেছিলেন তিনি।
পাহাড়ী এলাকা মিডিয়ায় ছিল তাঁর স্ত্রীর রাজ্য। ব্যাবিলনের সমতল ভূমিতে তাঁর মন বসে না। ব্যাপারটা নেবুচাদনেজারের দৃষ্টি এড়ালোনা। পাহাড়ের মতো করেই তৈরী করলেন ঝুলন্ত বাগান!
স্ত্রীর প্রতি ভালবাসার নিদর্শন স্বরূপ ঝুলন্ত বাগান তৈরি করলে কি হবে স্বভাবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠুর। অবাধ্যতার কারণে তিনি ইহুদীদের পবিত্র নগরী জেরুজালেম ধ্বংস করে দেন। বন্দি করে নিয়ে আসেন হাজার হাজার ইহুদীকে। ইতিহাসে একে ব্যাবিলনের বন্দিদশা বলে।
মেসোপটেমিয়রা বহ দেবদেবীর পূজা করতো। কোন নগরের প্রধান দেবতা আসুর হলে অন্য নগরে তা মারদুক। কোথাও বা ছিল শামাস বা সূর্য। পরকালে তাঁদের কোন বিশ্বাস ছিলোনা।
সভ্যতার শুরুর দিকে পুরোহিতরাই শাসক ছিল, পরবর্তিতে শাসক হিসাবে রাজা তৈরী হয়। কোন কোন সভ্যতায় পুরোহিতের গুরুত্ব কম ছিল।
তাঁদের মন্দিরকে জিগুরাট বলা হতো। রোদে পোড়া ইটের তৈরী মন্দিরগুলি ছিল পিরামিড সদৃশ। কয়েকটি ধাপে তৈরী জিগুরাটের সর্বোচ্চ ধাপে থাকত মন্দির, বিচারলায় ও দরবার হল। ফলে উপরের প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহৃত হতো একটি পুণ্যস্থানের মতো।
তবে এটা অবাক করার মতোই ব্যাপার যে হিব্রু বাইবেলের অনেক কাহিনীর সাথে মেসোপটেমিয়ার অনেক উপাখ্যানের মিল পাওয়া যায়।
Leave a Reply