মাটির মায়া
আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে চিত্রা নদী, নদীর দুই পাশে অনেক গ্রাম, সবার সীমানা শেষ হয় নদীর পাড়ে। এককালে এই নদীতেই চলতো বড় বড় নৌযান, এখন বর্ষায় ছোট বড় নৌকা চললেও বছরের অন্য সময় দেখা পাওয়া দায়। গ্রাম গুলোতে হিন্দু মুসলমানের অত্যন্ত ভালো সহাবস্থান, বিভিন্ন উৎসবে সবাই মিলে মিশে আনন্দ করে। ঈদের আনন্দ সবাই মিলে, দূর্গা বা বাসন্তী পূজোতেও সবাই মিলে মিশে একাকার। বিকেলের আড্ডাতে একসাথে ঝালমুড়ি বা চা শিঙাড়া, বিয়ে- বৌভাত বা সামাজিক কোন অনুষ্ঠানে সবার উপস্থিতি থাকবেই।
অযোদ্ধার বাবরি মসজিদ কিংবা গুজরাটের রামমন্দির ইস্যুতে যখন ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়, তখন তার রেশ বাংলার মাটিতেও চলে আসে। আমাদের দেশের অতি ধার্মিক বা বকধার্মিকেরা রামু, চৌমুহনী, কুমিল্লা বা রংপুরে মন্দির পোড়ায়, ঐ এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের ভাইয়েরা ভীত- সন্ত্রস্তভাবে দিন কাটায় কিন্তু আমাদের এলাকায় এ সবের কোন আঁচ লাগে না। এটা সবার পৈতৃক নিবাস, যার যার ধর্ম সেই পালন করে, সবাই মিলেমিশে বসবাস করে।
আমাদের গ্রামের বিপিন কাকা ( বিপিন কৃষ্ণ সাহা) সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি, মাঠে জমি জিরাত ভালোই, নিজে কাজ করে, কামলা রেখেও কাজ করায়, চাষাবাদের পাশাপাশি বাজারে ভূষি মালের ছোট ব্যবসা আছে। সংসারে কোন অভাব অনটন নেই, মেয়ে দুটো বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন, ছেলে তিনটাও ছোট খাটো ব্যবসা করছে। বাড়ীর চারিধারে বিভিন্ন ধরনের গাছগাছালিতে ভর্তি, ফল ফলাদি বা আনাজ না কিনলেও চলে, প্রয়োজনে পাশের বাজার থেকে মাছ, তেল কিনলেই হয়। বিপিন কাকা অতি মিশুক ধরনের মানুষ, ছোট বড় সবার সাথেই মিশেন, যাত্রাপালা, কীর্তন বা গানের অনুষ্ঠানে তার সরব উপস্থিতি, উপস্থিত থাকেন বাজারের কেরাম বা দাবার বোর্ডেও।
হঠাৎ একদিন সকালে চারিদিকে কানাঘুষা, ফিসফাস, বিপিন কাকা গতরাতে সপরিবারে ওপারে চলে গেছে। সব কাজ ফেলে গ্রামের লোকজন বিপিন কাকার বাড়ীতে হাজির, গোয়ালঘরে ঠিকই গরু বাঁধা, ছাগলের ঘরে ছাগল, হাঁস মুরগীর ঘরে হাঁস মুরগী ঠিকই আছে কিন্তু কোন ঘরে কোন মানুষ নাই, ঘরগুলোর দরজা খোলা। সবার মন খারাপ, এমন ভালো মানুষটা কেন সবকিছু ফেলে ভারতে চলে যাবে ! জানা গেল প্রতিবেশী এক মুসলমানের কাছে গোপনে সব বিক্রি করে রাতের আঁধারে ভারত চলে গেছেন, জমির ক্রেতা তাকে সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছেন, উনাদের চলে যেতে যেন কোন সমস্যা না হয় সেজন্য ক্রেতা বিষয়টি গোপন রেখেছেন, এখন এসেছেন দখল বুঝে নিতে।
সবার মুখে একই কথা, বিপিন বাবু কেন ভারত যাবেন, তার এখানে কিসের সমস্যা, তিনি তো স্বচ্ছল মানুষ, ভারতে যেয়ে কি উনি ভালো থাকবেন ? দিন আসে দিন যায়, মাস- বছর যায়, শোনা যায় বিপিন কাকার সেই হাসিখুশী জীবন আর নেই, দেহ ভারতে থাকলেও মনটা এই মাটির জন্য প্রতিনিয়ত কাঁদে। জীবন কোন সময় থেমে থাকে না, সময়ের পরিক্রমায় সবাই ভুলে গেছে বিপিন কাকাদের।
হঠাৎ এক গোধুলী লগ্নে হাটে-বাজারে, পাড়ায়- মহল্লায় সরব আলাপ বিপিন কাকা মাটির টানে ফিরে এসেছেন। সাথে ছোট ছেলে এসেছে, বেশ কিছুদিন থাকবেন, উঠেছেন পাশের বাড়ীর দাদার কাছে। সকাল বিকাল বিপিন কাকার চারপাশে মানুষের ভিড়, কেমন আছে, কেমন ছিলো, কেন চলে গেল, কতদিন থাকবে ইত্যাদি ইত্যাদি, সঙ্গে চা সিগারেট চলছে।
বিপিন কাকা আড্ডা জমিয়ে রেখেছে, মনে হচ্ছে তিনি আগের মতোই আছেন। হাট বাজারে যাচ্ছেন, মন্দিরে যাচ্ছেন, কালীতলার( বটতলায়) প্রার্থনা করছেন, সবার সাথে হাসিখুশি ভাবে চলছেন কিন্তু কোথায় যেন একটু ছন্দপতন হয়েছে, আগের সেই উচ্ছ্বলতার একটু ঘাটতি চোখে পড়েই। এভাবেই চলে গেল সপ্তাহ দুয়েক, শোনা গেল কাল সকালে উনি ভারতে ফিরে যাবেন, সবার সাথে কুশলাদি বিনিময় করে অনেক রাতেই ঘরে ফিরলেন। শরীরটা ভালো না লাগাতে রাতে আর কিছু খেলেন না।
ছেলেটা বেশ ভোরে উঠেছে, সূর্য উঠার আগেই বেরোতে হবে নইলে বর্ডার পার হতে সমস্যা হবে। নিজে স্নান শেষ করে কাপড় চোপড় গোছাচ্ছে আর বাবাকে ডাকছে কিন্তু বাবার কোন সাড়া না পেয়ে গায়ে হাত দিয়ে বজ্রাহত, দেহ একেবারে শীতল। ডুকরে কেঁদে ওঠে ছোট ছেলেটা, বাড়ীর সবাই দেখে কাউকে কিছু না বলেই বিপিন কাকা ঘুমের মধ্যেই পরপারে, জন্মভূমির মাটির মায়া ত্যাগ করতে পারলেন না বিপিন কাকা।
১৭.০৩.২০২৩
Leave a Reply