আমার আমি (অষ্টাদশ পর্ব)
“স্মৃতিতে শিববুড়া”
আমাদের পাড়ার বয়োজ্যেষ্ঠ শিববুড়া লোকটিকে দাদা সম্বোধনে ডাকতাম ৷ সাধারণতঃ ঠাকুর্দা জাতীয় সম্পর্কের সাথে সরাসরি এমন একটি সম্বোধনের প্রচলন আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে আর এর কারণ হিসেবে আমার মনে হতো যে, সম্পর্কের ক্রম যখন শেষ হয় তখন আবার প্রথম থেকে তা আরম্ভ হয় ৷
এ প্রসঙ্গে পার্শ্ববর্তী ঠাকুরপাড়ার যগীন ঠাকুরের কনিষ্ঠ পুত্রের কথা মনে পড়ে যায় ৷ সামান্য দু’চারটি মন্ত্র মুখস্ত করে ছোটখাট কিছু পুজো সারতে যায় সে ৷ যথারীতি পুজো শেষে প্রাপ্ত দক্ষিণাদি বহনের কাজে বরাবরই অভিজ্ঞ এবং বয়োজ্যেষ্ঠ মতিয়া মামা ঝোলা সমেত সহযাত্রী হতেন পুরুষানুক্রমে ৷ দূরের গ্রামে কী একটা পুজোয় দুজনেই যায় ৷ পূজো শুরুর কিছুক্ষণ পরেই যগীন ঠাকুরের পুত্র কানে কানে মতিয়া মামাকে বলে যে তার বাকি মন্ত্র আর মনে পড়ছে না, এখন কী করবে ! মতিয়া মামার তাৎক্ষণিক পরামর্শ, “যেগুলো এতক্ষণ থেকে বলেছিস সেগুলোই বারবার বলতে থাক ৷”
প্রসঙ্গ থেকে কিছুটা সরে এসেছি ৷ বিস্মৃত স্মৃতিতে নানারকমের স্মৃতিকথা এভাবেই জমা থাকে প্রত্যেকের মনেই, তাই একটুআধটু এদিকসেদিক হতেই পারে ৷ যাহোক, বলছিলাম শিববুড়া প্রসঙ্গে ৷ একহারা শ্যামবর্ণের কোমর বাঁকা শিবদাদা বড় গামছা পরিধান করতেন আর উর্ধাঙ্গ বরাবরই অনাবৃত থাকতো শুধু শীতের সময় কোনরকম একটা উত্তরীয় দিয়েই কাজ চালিয়ে যেতেন ৷ সামান্য জায়গাজমিতে কৃষির ওপর নির্ভর করেই চালিয়ে যেতেন সুখদুঃখের সংসারযাত্রা ৷ ব্যক্তিজীবনে এক কন্যা ও পুত্রের জনক ছিলেন তিনি ৷
আমাদের আশপাশে তিন তিনটি পাড়ার মধ্যে তিনিই একমাত্র গঞ্জিকা সেবক ছিলেন এবং বছরের বারমাসেই শুকনো কাশিতে দারুণ অভ্যস্তও ছিলেন ৷ আমরা ছোটরা তার নানারকমের ভৌতিক গল্পের মুগ্ধ ভক্ত ছিলাম ৷ একদিকে গল্প চলতো আর অন্যদিকে তার নিজস্ব শ্রমে শৈল্পিক উপায়ে বানানো গঞ্জিকা সেবনও চলতো – ৷ শিববুড়ার গল্পের প্রতি আমাদের আকর্ষণ এতোটাই ছিলো যে, গঞ্জিকার দুর্গন্ধকে পাত্তা দেয়ার কথা তখন মনেই হয়নি একটিবারও ৷ খুব স্বাভাবিক অভ্যস্তজনিত সম্পর্কের মাঝে এসব কিছুতেই দোষের হয়তো হয় না ৷ তবে উনি ভুল করেও কখনও কাউকেই ওনার গঞ্জিকা সেবনের সঙ্গী করেননি বরং ওনার গঞ্জিকা সরঞ্জামাদি কেউ স্পর্শ করবার সাহসও পেতো না আর এ বিষয়ে ওনার কড়া নজরদারি নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে ৷
শীতকালের প্রতিটি সকাল শিববুড়ার আঙিনায় সববয়সীদের ভিড় থাকতো কাঠের আগুনে শরীর তাপানোর জন্যে ৷ এটি আমৃত্যু প্রচলিত ছিলো – ৷ আগুন তাপানোর সময়ে বিচিত্র সব গল্পগুজব তখনকার দিনে মিডিয়ার অভাব পূরণ করতো ৷ আশেপাশের দু’দশ গ্রামের প্রাত্যহিক ভালোমন্দের খবরাখবর জানা যেতো ওখানে বসেই – ৷ একটু বেলা হলেই যে যার মতো নিজ নিজ কাজে চলে যেতো ৷ প্রাণবন্ত সাহচর্যের এমন দিনগুলি এখন সত্যিই খুব দুর্লভ ৷
আমাদের কিশোর বয়সের এই ভালোলাগার মানুষটির অন্যতম গুণ হিসেবে দেখেছি মৃদঙ্গ বাজনায় ছিলেন দারুণ পারদর্শী ৷ সন্ধ্যে হলেই কীর্তনের সুর আর মৃদঙ্গের বাজনা শোনা যেতো নিয়মিত ৷ পড়ালেখাজনিত চাপের কারণে সেখানে যেতে বিধিনিষেধ থাকলেও মন ঠিক চলে যেতো ওই কীর্তনের আসরে –
” হরি দিন যে গেল সন্ধ্যা হলো, পার করো আমারে ——-!”
সংসার জীবনের নানাবিধ উত্থানপতনের কারণে আমাদের পাড়া থেকে বসতবাড়ি উঠিয়ে শিববুড়া বেলান নদীর ওপারে সপরিবারে চলে যান ৷ তবে আমাদের সম্পর্কের টান বিনষ্ট হতে দেখিনি কখনও ৷ হাটেবাজারে দেখা হতো, কুশলাদি বিনিময় হতো ৷ নদীর এপার আর ওপার – ৷
আমরা মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থী তখন ৷ সন্ধ্যাবেলা ওপারের পাড়া থেকে কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো ৷ বর্ষাকালের ভরাট নদীর এপারে দাঁড়িয়ে খবর পেলাম শিববুড়া মারা গেছেন ৷ কষ্টে বুকটা ভরে গেলো ৷ শেষবারের মতো শিববুড়াকে দেখতে আমরা সমবয়সী চার-পাঁচজন সাঁতরিয়ে ওপারে গেলাম সন্ধ্যার পরে পরেই ৷ স্বজন সুহৃদদের পাশাপাশি আমাদের চোখেও তখন জল ৷
মনে আছে বেশ, চারিদিকে জলের কারণে শবদাহের সুবিধে না থাকায় দাহ না করে সমাধিস্থ করা হয় সদ্যপ্রয়াত শিববুড়াকে এবং এসকল কার্যাদি সম্পন্ন করতে কখন যে রাত প্রায় দশ-এগারটা বেজে যায় বুঝতে পারিনি ৷ সমাধিস্থল থেকে একে একে সবাই যখন চলে গেলেন তখন আমরা পাঁচ কিশোর একা হয়ে গেলাম ৷ নবকুমারের মতোন দেখলাম, যতদূর দৃষ্টি যায় চারিদিকেই শুধু জল আর জল ! সামনে বিশালাকার স্রোতবাহী বেলান নদী ৷ সুনসান অন্ধকার শ্মশান ৷ এতক্ষণে কিছুই মনে হয়নি লোকজনের সমাগমে কিন্তু শেষমুহুর্তটা যে এমন অতিপ্রাকৃত ঘটনার মুখোমুখি আমাদের দাঁড় করাবে এটি ভাবিনি ভুল করেও ৷ তখন কেঁদেছিলাম প্রয়াত শিববুড়ার শেষযাত্রার কারণে আর এখন কান্নার জল শুকিয়েছে শিববুড়ার প্রেতাত্মা কখন যে আমাদের সামনে এসে কুশলাদি জিজ্ঞেস করে এই ভয়ে ৷ সর্বোপরি শিববুড়ার কাছে শোনা শ্যাঁওরা গাছের জীবন্ত পেত্নী যেনো আমাদের সামনেই দাঁড়িয়ে – ৷
সাঁতরে পার হওয়ার সাহসও হচ্ছিলো না ৷ শিববুড়া রসিকতা করে পূর্বসম্পর্কের জেরে পা টেনে ধরে কিনা ৷ বড় বিপজ্জনক পরিস্থিতির মুখোমুখি আমাদের সেই অলুক্ষণে রাতটি ৷ সৌভাগ্যবশতঃ নদীর ওপারে হারিকেনের আলোয় আমাদেরকে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়েছে এতক্ষণে ৷ কোলাহল এবং হাঁকডাকে কিছুটা প্রাণ ফিরে আসে ভৌতিক আবহ থেকে ৷ আমার মামাতো দাদা সাঁতরিয়ে পার হয়ে সবাইকে নিয়ে এপারে ফিরিয়ে নিয়ে আসে ৷ অনেকদিন সেই স্মৃতি আমাদের তাড়া করতো ৷
ক্রমশঃ
Leave a Reply