My beloved banyan tree.
আমার প্রিয় বটগাছ
ক’দিন থেকে বিশাল ছাতা ধরা আমার প্রাণ-প্রিয় সেই বট গাছটি মনের কোণায় অহরহ উঁকি দিচ্ছে। বট গাছের ইংরেজি নাম Indian Banyan। বৈজ্ঞানিক নাম Ficus benghalensis। গোত্র Moraceae।
রাজশাহী শহরে নিজ বসত বাড়ির দক্ষিণ- পশ্চিমে মাথা ভরা ভালবাসা নিয়ে অবস্থান করছিল চিরহরিৎ বট গাছটি। বাড়ির আঁতুরঘরে দাইমা, কত্তামা ও পিসিমার হাতে জন্ম নেওয়ার পর সেই বটগাছের শীতল হাওয়ায় প্রথম শ্বাস নিয়েছিলাম আমি। এরপর হাঁটি হাঁটি পা পা শুরু হয় তার ছায়ায়ই। শিশুকাল ও বাল্যকালের খেলাধূলো সব ওই বটগাছ-তলা ঘিরেই। তাই গাছটি আমার অস্তিত্বের সঙ্গে গ্রথিত হয়ে আছে। তবে সেই বটগাছটি আর নেই এই ধরাধামে! বাড়ির পাশে বিশাল বুড়িপুকুরের সমাধি হবার আগেই বটগাছটাকে কর্তন ও সমূলে উৎপাটন করা হয়েছিল! কত সহজে যৌবনে ভরপুর অপরূপা বটগাছটা নৃশংসভাবে কেটে ফেলা হয়েছিল সেদিন!
বর্তমানে আমার বাড়ির ব্যাকইয়ার্ড -এর দক্ষিণ-পূর্ব কোণায় প্রায় ৪৫-৪৮ বছর বয়সের একটা চেরি গাছ আছে। সম্ভবত গ্রীষ্মকালে ছায়া ও চেরি ফল পাবার আশায় চেরিগাছটা লাগিয়েছিল আমার বাড়ির পূর্ববর্তী কোনও মালিক। স্বাভাবিকভাবে চেরি গাছের বাড়-বাড়ন্ত অবস্থা। তাই আমার মতোই গ্রীক প্রতিবেশীর অনিচ্ছাকৃত অভিযোগ আছে গাছটার জন্য। কারণ এখন তার ছায়া পড়ার দরুণ গ্রীষ্মকালের সবজি বাগানের ফলন আশানুরূপ হয় না। আবার ঝড়ে ডাল ভেঙে ঘরের উপর পড়ার আশঙ্কা আছে উভয় বাড়িতেই। শরৎকালে ঝরা পাতা পরিষ্কার করতে বয়স্ক প্রতিবেশী স্বামী-স্ত্রীদ্বয়ের খুব কষ্ট হয়! আবার গাছের গোড়া ক্রমশ মোটা হচ্ছে, শেঁকড় দ্রুত চতুর্দিকে ছড়াচ্ছে। তাই তাদের সন্দেহ গাছের শেঁকড় তার ও আমার বাড়ির ভীত নষ্ট করতে পারে – ইত্যাদি। কিন্তু গাছ কাটার ঢালাও অনুমতি নেই এখানে। মাটি থেকে ১.৪ মিটার উপরে একটা বৃক্ষের ব্যাস ৩০সেমি হলে তা কাটতে সিটির অনুমোদন লাগে। তারও আবার নানাবিধ নিয়ম কানুন আছে। তাই দু’এক বছর পরপর ডাল ছেঁটে প্রতিবেশীর অসুবিধে ও ভয় দূর করার চেষ্টা করি। তবে গাছ কাটা বা ডাল ছাঁটারও নিয়ম নীতি আছে এখানে। আমি চাইলেও নিজের ইচ্ছে মতো ডাল ছাঁটতে পারি না। আবার নিয়ম ভাঙলেই বিশাল আকারের জরিমানা সঙ্গে লজ্জিত হবার বিড়ম্বনা তো আছেই! তাই সিটির নির্ধারিত নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে সবাই। এমন কী ওই কাঠুরেরাও। নইলে না – কী তাদের লাইসেন্স বাতিল হবে। কত সুন্দর সরকারি নিয়ম ও তা নিষ্ঠার সাথে যথাযথ পালন এই টরন্টো শহরে।
অথচ আশির দশকের শেষ দিকে নানান উপকারে ভরপুর রাজশাহী শহরের প্রিয় বটগাছটি নিদ্বিধায় কেটে ফেলা হয়েছিল। আমি তখন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, জয়দেবপুরে কর্মরত। একদিন ছুটিতে বাড়ি গিয়ে রিক্সা থেকে নেমেই দেখি আমার প্রিয় বটগাছটা নেই! একেবারে ফাঁকা। কী হলো? কোথায় গেল? বাবা ধরা গলায় বললো – কেটে ফেলেছে! — মানে? কী অপরাধ করেছিল গাছটা? আমার মনে হচ্ছিল আমার শরীরের ধর থেকে মুন্ডুছেদ করা হলো! সারা শরীর অবশ হয়ে গে’ছিল সেদিন। বাবা, মা ও কত্তামা কীভাবে শান্তনা দেবে আমায়? কারণ তাদেরও মর্মান্তিক দিনটির কথা বলতে যেন শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল! জানলাম আমাদের বাড়ির সদস্যদের, পাড়া- প্রতিবেশীদের, পথচারীদের কাকুতি – মিনতি ও মতামতের তোয়াক্কা না করে দুবৃত্তরা চালিয়েছিল ওই বটগাছে কুঠারাঘাত!
বটগাছটি ছিল আমাদের নিঃস্বার্থ বন্ধু। ছিল অক্সিজেন দাত্রী ও পরিবেশ দূষণ হরণকারী। একটা বটগাছ ৫০০ থেকে ৬০০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। তাই পরিবেশের কী ক্ষতি হলো তা তারা বোঝেনি সেদিন!
তার মূলগাছের ডাল থেকে অনেক ঝুরি (aerial roots) বার হতো। কত্তামা ঝুরিগুলোকে ‘ব’ বলতো। আমরা পাড়ার ছেলেমেয়েরা সেই ঝুলন্ত ঝুরি ধরে দোল খেতাম। ঝুরিগুলো ক্রমান্বয়ে বড় হয়ে স্তম্ভমূল নামে মাটিতে গ্রথিত হতো। তারপর ডালপালা ও পাতা দিয়ে নিজেকে বিস্তৃত করতো। ছাতার মতো বট গাছের ছায়ায় চলতো আমাদের রান্নাবাটি খেলা। একটু বড় হলে বিকেলে অথবা স্কুল ছুটির দিনে আমরা তার নিচে এক্কা-দোক্কা, কিত্কিত্, হা ডু ডু, বদন, বৌচি, রুমাল চুরি, গোল্লাছুট, কানামাছি, তেঁতুলের বীচি দিয়ে বাগ-বকরি, পাঁচটা ছোট ছোট পাথর দিয়ে হাত্তা, ইত্যাদি খেলায় মেতে উঠতাম। অরণ্য ষষ্ঠী পূজো হতো ওই বটমূলে। আমাদের পাড়ার সকলে ও আশেপাশের অঞ্চল থেকে আসতো বহু ভক্তবৃন্দ। ছোট খাট মেলা বসতো তখন সেখানে। পূজো শেষে শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা বিনিময় পর্ব চলতো। তখন বটতলা হয়ে উঠতো নানান ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী ও গোত্রের মানুষের এক মহামিলন ক্ষেত্র। তাছাড়া তার পাতা, বাকল, ফল ও আঠা ওষুধি হিসেবে ও নানান কাজে ব্যবহৃত হতো। প্রখর রোদ, ঝড়, বৃষ্টিতে বিপন্ন মানুষের আশ্রয়স্থল ছিল ওই বটগাছ। ছিল ক্লান্ত পথিকের শরীর মন জুড়ানোর ও প্রশান্তি লাভের ভরসা-স্থল। ব্যবসার জন্য গ্রাম থেকে ধান, চাল, শস্য, কাঠ, গরুর খাওয়ার বিচালি বা খড় ইত্যাদি বোঝাই করা গরুরগাড়ি আসতো রাজশাহী সাহেব বাজারে। আসা – যাওয়ার পথে পরিকল্পনা অনুযায়ী বটগাছ তলা ছিল তাদের বিরতি নেওয়ার ও রাত্রি যাপনের স্থান। বটতলায় রান্নাবান্না করতো গাড়োয়ান চাচারা। পাশে আছে বুড়িপুকুরের জল। অন্য কিছুর প্রয়োজন হলে মায়ের উদারহস্ত তো আছেই। এখনও পরিষ্কার মনে আছে সেই বটতলায় একজন পাগলী বাস করতো। খাওয়া দাওয়াটা আমার করুণাময়ী মায়ের খাদ্য ভান্ডার থেকে চলতো। সব সময় মুখে ঝি ঝি শব্দ করতো বলে আমরা তাকে ঝিঝি পাগলী বলতাম, তবে অবশ্যই সম্মানের সাথে। এমনই সব বিপন্ন মানুষের আশ্রয়স্থলও ছিল ওই বটগাছ।
শুধু মানুষই নয়, কুকুর, বিড়াল, পশু-পাখি, সাপ ইত্যাদি প্রাণীর খেলাধূলা ও জীবন নির্বাহের নির্ভয় আশ্রয়স্থলও ছিল ওই বটগাছ। বিষধর সাপসহ কত রকমের সাপ যে বাস করতো ওই গাছে। তবে হ্যাঁ, কখনো তারা কাউকে কাটেনি। কাটবেই বা কেন, বট গাছের অতিথিপাখি ও বুড়িপুকুরের মাছ, ব্যাঙ ছিল তাদের নিশ্চিত আহার যে। গাছের ফোকরে সাপ ও পাখি উভয়ই বাসা বাঁধতো। বটগাছে ডুমুরের মতো সবুজ ফল হতো। পাকলে লাল ফলগুলো গাঢ় সবুজ পাতার মাঝে এক অপূর্ব সৌন্দর্যের আবহ তৈরি করতো। বাদুর, কাক ও শালিকের প্রিয় খাদ্য পাকা লাল বটফল। ঝাঁকে ঝাঁকে বাবুই, চড়ুই, টিয়া, বুলবুল, চিল, শকুনও আসতো তা খেতে। তাদের কিচির মিচির শব্দগানে গাছ হতো মুখরিত! পত্ পত্ শব্দে তাদের এক সাথে গাছে উড়ে এসে বসা আবার একসাথে উড়ে যাওয়াটা কী যে চমৎকার মনকাড়া ছিল। এ ছাড়াও লক্ষীপেঁচা, কোকিল, ফিঙেরও ছিল আনাগোনা। বসন্তে কোকিলের কুহু ডাক বিমোহিত করতো সবার মনকে। বক ও মাছরাঙা বুড়িপুকুরে ছোঁ মেরে মাছ ধরতো আর বটগাছে আরামে বসে জমিয়ে তা খেতো। আহা কী সে চোখ জুড়ানো মনোরম দৃশ্য! বটগাছের পাদদেশ টলটলে গভীর জলাধার বুড়িপুকুর আর উপরে অসীম নীলাকাশ। আর মাঝে সেইগাছে পাখিদের আনন্দ নৃত্য। যেন এক মাধূর্যেভরা পৃথিবী।
ইদানিং এক এফবি পোস্টে জানলাম বর্তমানে বাংলাদেশের সব চেয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিপাটি ছায়াঘেরা শহর রাজশাহী। আমার খুব ভাল লেগেছে। আমি সত্যি গর্বিত। নগরায়নে বর্তমান দায়িত্ব প্রাপ্তরা আমাদের তখনকার দিনে যদি থাকতেন হয়তো আমার প্রিয় বটগাছ ও বুড়িপুকুর নিশ্চহ্ন হতে দিতেন না। আর সেখানে বিলাসবহুল দালান কোঠা ও বাজার গড়ে উঠতো না!
আমার প্রিয় বটগাছ ও বুড়িপুকুর ঘিরে স্বর্ণদিনগুলি আমাকে আষ্টেপিষ্ঠে বেঁধে রেখেছে ! কারণ ওরাই যে ছিল একদিন আমাদের ঠিকানা।
Leave a Reply