০৪. ০৬. ২৪
“সৌপ্তিক”
——হারুন-অর-রশিদ মজুমদার
অধ্যায় সাত
আজ বৃহস্পতিবার। আজকে আবার সোনার গাঁ হোটেলে আমি ও গালিব আমরা বসবো। আগেই গালিব ও আমার পরিকল্পনা ছিল। বৃহস্পতিবার সপ্তাহের শেষদিন। কাজের চাপ বিকেলে কমে আসে। অনেকটা হালকা হই। সুতরাং এই সময়টা বেছে নিই দু’জনেই। ব্যস্ততার কারণে দীর্ঘদিন গালিবের সঙ্গে দেখা নেই। অনেক দিন পর বসা এই কারণে যে, গালিবের সঙ্গে জনতা ব্যাংক বিষয়ে একটা ডিসকাশন করা প্রয়োজন। স্হান সোনার গাঁ-য় নির্ধারণের আরও একটি কারণ হলো এই যে, বৃহস্পতিবার হলো উইক এন্ড। সোনার গাঁ-য় এই সুবাদে পরিচিত আরও অনেকের সঙ্গেই দেখা সাক্ষাৎ ও কুশল বিনিময় হওয়া সম্ভব। কারো কারো সঙ্গে এই দেখা সাক্ষাৎ ও কুশল বিনিময় করতে করতে অনেক সময় ব্যবসাও হয়ে যায়। কোনো বন্ধু বায়িং হাউজের ওনার বায়ারের সঙ্গে মিটিং শেষে যাচ্ছিলো। হঠাৎ হয়তো দেখা। বললো তার হাতে বেশ কিছু ভালো রেটের অর্ডার আছে। জার্মান মার্কেটের অর্ডার। কাস্টমারও ভালো। ঝকঝকে পেমেন্ট। হাতের ল্যাপটপ ওপেন করে স্টাইল গুলো দেখালে বলি,
“এগুলো তো আমাদের ফ্লোরে চমৎকার প্রোডাকশন হবে। ইতিপূর্বেও সেইম স্টাইলের কাছাকাছি আইটেম আমরা ফ্রান্সে শিপমেন্ট করেছি। ঠিক আছে দিয়ে দাও বন্ধু”।
চলতি পথের প্রাপ্ত অর্ডারে আগামী উইন্টার বা সামার সিজনের মাস খানেক ফ্লোর বুকড হয়ে গেলো। বরাবরের মতো জিম-এ বা উইক এন্ডে ডিস্কো-তে কিম্বা বার-এ এসেছেন কোনো গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীর মালিক। শরীরচর্চা করতে অথবা কাজের চাপ ভুলে কিছুটা বিনোদন পেতে। হঠাৎ দেখা হলে প্রফুল্লচিত্তে আলিঙ্গন করলেন। এ-কথা ও-কথা নানান কথার পর হয়তো এক পর্যায়ে মন খারাপ করে বললেন,
“ভাই, ব্যাংকে এলসি লিমিট ক্রস করেছে। বেশ কিছু ডকুমেন্টস ব্যাংকে সাবমিট করা আছে কিন্তু পেমেন্ট আসছে না। পেমেন্ট গুলো রিয়েলাইজ না হওয়ায় লিমিট ক্রস করেছে। লিমিট ক্রস করাতে ব্যাংক তো গড়িমসি করছে বিবি এলসি ওপেন করতে। ব্যাংকের সমস্যায় অমুক অর্ডারটা তো করতে পারছি না”।
আমি হয়তো বললাম, “ঠিক আছে বায়ারের সঙ্গে খোলামেলা ডিসকাশন করে কনফার্মেশান নিয়ে এলসি ট্রান্সপার করে দিন। আমি ইনশাল্লাহ সাপোর্ট দিয়ে দিবো”।
আচমকা আগামী অটোমন বা স্প্রিং সিজনের মাস দুয়েক প্রোডাকশন ফ্লোর বুকডও হলো। পরিচিত বন্ধু বা ব্যবসায়ী ক্যমুনিটির অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু বান্ধব একজনকে সহযোগিতাও করা হলো। সোনার গাঁ হোটেলে বিভিন্ন মিটিং আয়োজনের এই একটা বাড়তি সুবিধা।
গুলশান অফিস থেকে বৃহস্পতিবার বিকেলে সরাসরি আমি সোনার গাঁ হোটেলে পৌঁছে গেলাম। ওয়ান ওয়ে হাতিরঝিল দিয়ে এক টানে এসেছি বলে আমি আগে পৌঁছাই। গালিব তখনও এসে পৌঁছায়নি। গালিব সেল ফোনে জানালো মহাখালী ডিওএইচএস এর অফিস থেকে রওয়ানা হয়েছে। আমি একা পুল সাইডে এসে বসেছি। সোনার গাঁ-র এই পুলসাইডের দিকটায় গাছের ছায়া। হাতিরঝিলের এক্সটেনশন বলে দক্ষিণ দিকটা খোলামেলা। কাজেই আসে প্রাকৃতিক নির্মল বাতাস। ইট রড সিমেন্ট কনক্রিটের নগরে এক টুকরো সবুজ প্রকৃতির ছোঁয়া পাওয়া যায় এখানে। পুরো এসিতে মোড়ানো সোনার গাঁ হোটেলের অভ্যন্তর। বাইরে পুল সাইডে একেবারে প্রাকৃতিক পরিবেশে বিকেলের নরোম রোদ। গাছের ছায়া ও সুইমিংপুলের টলমল পানি মিলে এক স্লাইস কক্সেসবাজার মনে হয় সোনার গাঁ-র এই পুল সাইডকে। তাই আমার ও গালিব উভয়ের বেশ পছন্দ সুইমিং পুল কেন্দ্রিক এই পুল সাইড।
আমি প্রবেশ করেই একটি হিমসাগর ম্যাঙ্গো জুসের অর্ডার করেছিলাম ক্যাফেতে। এসে অর্ডার নিয়ে গেছে হোটেল ক্যাফের পরিচিত বয় জিউস মার্মা। পরনে সিঙ্গেল কলারের কফি কালারের ঝুলানো শার্ট। ইন না করে পরা কফি কালারের ঝুলানো শার্টের নিচে শাদা রঙের প্যান্ট। ক্যাফে বয়দের নির্ধারিত এই ড্রেস পরা জিউস মার্মা, হিমসাগর ম্যাঙ্গো জুস নিয়ে এলো। সসম্ভ্রমে মার্মা ভাষার টোন জড়ানো পরিষ্কার আরবি উচ্চারণে সালাম দিলো। সুইমিং পুলের পাশে বসা চেয়ারের সম্মুখের টেবিলের উপর ম্যাঙ্গো জুস পরিবেশন করলো জিউস মার্মা। আমি জিউস মার্মা-র পারিবার স্ত্রী, সন্তানদের কুশলাদি জিজ্ঞেস করে, তাঁদের শারীরিক সুস্থতার খবরে সন্তোষ প্রকাশ করলাম। বরাবরের মতো কিছু টিপস হাতে দিলে জিউস মার্মা খুব খুশি হলো। পুনরায় মার্মা ভাষার টোন জড়ানো পরিষ্কার আরবি উচ্চারণে সালাম দিয়ে মাথা ও শরীর নুইয়ে বিনীত ভঙ্গিতে জিউস মার্মা চলে গেলো। সুইমিংপুলের লাগোয়া টেবিল চেয়ারে একা বসে হিমসাগর ম্যাঙ্গো জুস অল্প অল্প ঢোকে খাচ্ছি। গালিব এসে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত আমি গত মিটিংয়ের পরের আদালতের কার্যক্রম গুলোর আত্মবিশ্লেষণ করতে লাগলাম।
গত মিটিংয়ে গালিব বলেছিলো, “আপনি শুরু থেকেই মামলার কোনো ধার্য তারিখে কোর্টে হাজিরা দিবেন না। আমরা আপনার পক্ষে আদালতে নানান বাহানায় সময় প্রার্থনা করে যাবো। একেবারে শেষ দিনে বিবাদী হিসেবে আপনি কোর্টে হাজির হবেন। আমরা বিবাদীর উপস্থিতিতে পুনঃ শুনানির আর্জি জানাবো মাননীয় আদালতের কাছে। সুতরাং নতুন করে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হবে। বাদী জনতা ব্যাংকের মামলায় অন্তর্বতীকালীন কিছুটা সময়ক্ষেপণ করা গেলো।
কিন্তু গালিবের পরিকল্পনায় বিঘ্ন ঘটালেন মাননীয় আদালত। গালিবের পরিকল্পনা মতো প্রায় বছর পার করে একেবারে শেষের শুনানি দিনে রায় ঘোষণার পর্যায়ে আমি কোর্টে হাজির হলাম। মামলার বাদী বিবাদীর জন্য নির্ধারিত কাঠ গড়ায় আমি আদালতের এজলাসে উপস্থিত। কোর্ট আমাদের পক্ষের আইনজীবী গালিবের বক্তব্য না শুনে একতরফা ভাবে জনতা ব্যাংকের পক্ষে রায় ঘোষণা করে দিলো। আমি বেশ হতাশ হয়ে পড়ি যে, রায় আমাদের বিপক্ষে চলে গেছে। কিন্তু আমি এই রায়ে গালিবকে দেখলাম উৎফুল্ল হতে। গালিব কোর্ট থেকে সিএমএম কোর্টের পাশে আইনজীবী সমিতির বিল্ডিংয়ে তার চেম্বারে ফিরতে ফিরতে বললো,
“হারুন আপনি যা ধরেন তাতেই সোনা ফলে। না চাইতে বৃষ্টি একেই বলে”।
আমি চিন্তিত মনে বললাম, “এ কেমন কথা বললেন? আমরা তো মামলায় হেরে গেছি”।
কোর্টে বিল্ডিংয়ের এজলাস থেকে বেরিয়ে পুরান ঢাকার জজকোর্ট এরিয়ার বাইরে সংলগ্ন গলিপথের ওপারে আইনজীবী সমিতির সুরম্য বিল্ডিং। বিল্ডিংয়ের ৩য় তলায় কোর্ট চলাকালীন কার্যদিবসে কোর্টে যাবার আগে, পরে, মধ্যবর্তী সময়ে বসার জন্য গালিবের ভাড়া করা আকৃতিতে ছোট আলাদা চেম্বার রুম আছে। কোর্ট এজলাস থেকে বেরিয়ে কোর্ট চত্বর পেরিয়ে আমরা একসঙ্গে হেঁটে এই চেম্বার রুমে ফিরে আসি।
বৃটিশ আমলে সিনিয়র আইনজীবিদের ড্রেস ছিলো ইউনিভার্সিটির সমাবর্তনের ড্রেসের মতো দুই কাঁধে, বুকে, পিঠে কুচি কুচি করে কারুকাজ করা আজানু লম্বিত পুরো শরীর ঢাকা কালো গাউন। সিঙ্গেল কলারের শাদা শার্টে গলায়, বৃটিশ আদলে নেকটাইয়ের মতো কাপড়ের না শক্ত শাদা কাগজের তৈরি নেকটাই। উল্টো “ভি” আকৃতির দু’পাশে নিচে ঝুলানো প্রায় ছয় ইঞ্চি লম্বা, গলা পেছিয়ে চিকন ফিতা দিয়ে পেছনে গিঁট দিয়ে বাঁধা। আঁটোসাটো হয়ে গলায় ঝুলে থাকা চমৎকার দৃষ্টি নন্দন এই শাদা নেকটাই। একে আইনাঙ্গনের ভাষায় বলে ব্যান্ড। সিঙ্গেল কলারের শাদা শার্ট, কালো গাউন ও শাদা ব্যান্ড। বৃটিশ আমলের এই ড্রেসকোড বাংলাদেশের আইনাঙ্গনে এখনো বিদ্যমান এবং এজলাসে পরা বাধ্যতা মূলক। অবশ্য জুনিয়র আইনজীবীগণের ড্রেসকোড হলো নর্মাল শাদা শার্টের উপর কালো কোট। জুনিয়র আইনজীবীগণ ম্যাচিং করে কালো কোটের সঙ্গে কালো প্যান্টও পরে থাকে। কালো প্যান্ট কিন্তু ড্রেসকোড না। আইনজীবী সমিতিস্হ চেম্বারে ফিরে, সিঙ্গেল কলারের শাদা শার্টের ওপর চকচকে গর্জিয়াস কালো গাউন ও শাদা ব্যান্ড পরা দীর্ঘাকায় ধবধবে ফর্সা গালিব। ডান হাতে কোর্ট ফাইল ধরা বলে বাম হাতে ঢোলা কালো গাউন সামলে নিয়ে, উঁচু কালো গদি মোড়ানো নিজ আসনে বসতে বসতে বললো,
“হারুন ভালোই হলো। এবার আমরা হাইকোর্টে যাবো। কারণ মাননীয় আদালত আমাদের বক্তব্য আমলে না নেয়ায় আমাদের মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন হয়েছে। দেশের জনগণের মৌলিক অধিকারের পক্ষে হাইকোর্টের অবস্হান খুব কঠোর। কাজেই হাইকোর্টের নির্দেশে নিন্ম আদালতে পুনঃ শুনানি শুরু হবে। যে পর্যন্ত আমাদের মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন হওয়ার আর্জির শুনানি হাইকোর্টে শুরু ও রায় না হবে, সে পর্যন্ত নিন্ম আদালত তাদের রায়ের বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নিতে পারবে না। এই মর্মে রিট করে হাইকোর্ট থেকে নিন্ম আদালতের রায় স্থগিত রাখতে অতি সত্বর রুল জারি করাবো। আমরা আবেদন করলে রুল জারি হবেই অবধারিত ভাবে। মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন হওয়া যা-তা কথা না।
এদিকে হাইকোর্টে মামলার যা জট তাতে হাইকোর্টে আমাদের মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন হওয়ার আর্জির শুনানিতে অনেক সময় লাগবে। যেহেতু আমাদের মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন হয়েছে সেহেতু হাইকোর্ট অবশ্যই আমাদের পক্ষেই নিন্ম আদালতে পুনঃ শুনানির রায় দিবে। সেটা সময় সাপেক্ষ। হাইকোর্টের নির্দেশ মোতাবেক নিন্ম আদালতে আবার শুনানি শুরু হবে। খুবই দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এর মধ্যে জনতা ব্যাংকের বিরুদ্ধে আমাদের দায়েরকৃত ক্ষতিপূরণ মামলার শুনানির অনেকটাই অগ্রগতি হবে। এই জন্যই বললাম যে হারুন, আপনি যা ধরেন তাতেই সোনা ফলে।
জনতা ব্যাংকের বিরুদ্ধে আমাদের দায়েরকৃত ক্ষতিপূরণ মামলা হয়তো প্রতিপক্ষ, সরকারি ব্যাংক বলে কোর্ট দীর্ঘমেয়াদী করে দিবে কিন্তু ইনজাস্টিস করবে না। রায় আমাদের পক্ষেই আসবে। রায় পক্ষে আনতে যতটুকু চেষ্টা তদবির আইনাঙ্গনে প্রচলিত আছে ততটুকু চেষ্টা তদবির আমরাও করবো। বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচাগ্র মেদিনী। রায় আমাদের পক্ষে আসবে কারণ আপনি তো কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব না। রাজনৈতিক মামলায় কখনও কখনও রাষ্ট্রীয় প্রভাবে ইনজাস্টিস হলেও হতে পারে। কিন্তু অরাজনৈতিক ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই সম্ভাবনা একেবারে জিরো। সাধারণ বিচার প্রার্থী নিক্তির মাপে ন্যায় বিচার পায় বলেই আইন আদালতের প্রতি, দেশের আপামর জনসাধারণের আস্হা এখনো অটুট আছে।
আমার অল্প অল্প ঢোকে ম্যাঙ্গে জুস খেতে খেতে স্মৃতিচারণের ফাঁকে, পুল সাইডে গালিব এসে উপস্থিত হলো। আমি উচ্ছ্বসিত হয়ে দাঁড়িয়ে ছার্কোল কালারের স্যুট, গ্রে কালারের শার্ট ও চকচকে কালো সু পরিহিত দারুন স্মার্ট গালিবকে হাই ফ্রেন্ড বলে অভ্যর্থনা জানালাম। গালিব আমার সঙ্গে হ্যান্ডসিক করে সামনের চেয়ারে বসলো। আমি যেমন গত কার্যক্রম গুলোর যাবর কাটছি। গালিবও হয়তো তা-ই করছিল। তাই ইতিপূর্বের দিনের ধারাক্রমের রেশ টেনে গালিব আমার সামনের চেয়ারে বসতে বসতে কেচেগুন্ডুস ভবিষ্যদ্বানী করলো,
“ধরেন হাইকোর্টে আমাদের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্নের শুনানি শুরু হলো। হাইকোর্টে যা মামলার জট তাতে এই শুনানি শেষ হয়ে রায় ও ডিগ্রি হাতে পেতেও লাগবে কমপক্ষে তিন বছর সময়। তারপর আবার প্রথম থেকে শুরু হবে নিন্ম আদালতে পুনঃ শুনানি। তার রায় ও ডিগ্রি হাতে পেতে লাগবে কমপক্ষে এক বছর সময়। এর মধ্যে কোর্ট যতোই সরকারি ব্যাংকের বিরুদ্ধে আমাদের ক্ষতিপূরণ মামলা বলে ধীরে চলুক না কেনো, কোর্টে আমাদের দাখিলকৃত অকাঢ্য দলিল দস্তাবেজ ও প্রমাণের আলোকে ইতোমধ্যে আপনার পক্ষেই আমাদের দায়েরকৃত ক্ষতিপূরণ মামলার রায় হবার সম্ভবনা। এটাই আইন এটাই আদালত। আর একেই বলে আইনের মারপ্যাঁচ”।
আমি গালিবকে উঁচু মানের তাত্ত্বিক আইনজীবী ভাবতাম। যেহেতু মেধাবী। কিন্তু এখন বুঝলাম যে, গালিব প্র্যক্টিক্যালি একজন ঝানু আইনজীবী বনে গেছে। গালিব যখন ভরাট কণ্ঠে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কথা গুলো বলছিল তখন, কাঁচা হলুদ বর্ণের গালিব যেন ভবিষ্যত দর্শনের একেবারে পেশাদার উত্তেজনায় লাল হয়ে গেছে। পুল সাইডে বিকেলের রোদ এসে উঁচা লম্বা গালিবের কাঁচা হলুদ শরীরে পড়ায়, আমি গালিবের ফর্সা গ্রীবায় রক্ত চলাচলের ফুলে উঠা নীল রগগুলো স্পষ্ট দেখতে পেলাম। বুঝতে কষ্ট হলো না যে, গালিব একেবারে মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত একজন পেশাদার আইনজীবি। আজ সোনার গাঁ হোটেলের পুল সাইডের বসায় গালিব, সঙ্গে করে এসিস্ট্যান্ট জান্নাতকে ইচ্ছে করেই আনেনি। কারণ আজ শুনবো “রিলায়েন্স এয়ার” পর্বে রাধিকা ও অপূর্বার সঙ্গে গালিবের সেক্সুয়াল সম্পর্কের রোমাঞ্চ বিষয়ে। যে বিষয়ে জান্নাত অবগত হোক এটা গালিব চায় না নিজ দর্শন ও সঙ্গত কারণে।
এখানে বলে রাখা দরকার বিমান বাহিনী থেকে পদত্যাগের পর, গালিব আর কখনোই শবনম কিংবা নার্গিস কারও সঙ্গে নূন্যতম যোগাযোগ রাখার তাগিদ অনুভব করেনি। শবনম কিংবা নার্গিসও গালিবের সঙ্গে আর কখনও যোগাযোগ করেনি। গালিব বললো,
“বিমান বাহিনী থেকে পদত্যাগ করে এক মাসের মাথায় রিলায়েন্স এয়ারের পাইলট পদে যোগদান করে আমি আমার প্রফেশনে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। পৃথিবীর দেশে-দেশে এয়ারপোর্টে-এয়ারপোর্টে হোটেলে-হোটেলে কাটিয়েছি কয়েকটি বছর চরম ব্যস্ততায়। আজ পর্যন্ত আমি জানি না কোথায় শবনম? নার্গিসের কি হলো? এমনকি অন্য কেউও আমাকে দু’জনের বিষয়ে অবগত করাক তা-ও আমি চাইনি বলেই হয়নি। যদিও নার্গিস আমার খালাতো বোন এবং আমাদের ধানমন্ডিরই স্হায়ী বাসিন্দা। তবু্ও তার বিষয়েও আমি কিছুই জানি না। এমন ভাবে আমি আমার বেদনাদায়ক অতীত থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম ও আছি”।
এদিন গালিব কিছু সগতোক্তি করলো। আমি কিছু না বলে তার দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ের মর্মবেদনার সগতোক্তি গুলো মন দিয়ে শুনলাম। কোনো মন্তব্য না করে। গালিব বলে চললো,
“হারুন, দুইটি নবজাত শিশু পাশাপাশি বেডে জন্মালে যদি ভুলক্রমে পরিবর্তন হয়ে যায়। তবে এক সময় হয়তো আপন বাবা-মাকে ফিরে পাবার সম্ভবানা থাকে। কিন্তু দুইটি লাশ একই সঙ্গে মসজিদে জানাজা শেষে যদি পরিবর্তিত হয়ে যায়। দুইজন চলে যায় অচেনা স্বজনদের কাঁধে চড়ে কফিন পেঁচিয়ে দুই অচেনা কবরে। তাদের আর কস্মিনকালেও স্বজনের চরণ স্পর্শ পাবার সুযোগ নেই। এতে আর কি ক্ষতি? কবরে তারা নিজ নিজ ভুল পরিচয় নিয়েই থাকে স্বজনের কাছে। কোনো ক্ষতি নেই। শিশু দু’টোরও যদি প্রত্যাবর্তন না হয় নিজ নিজ মা-বাবার সান্নিধ্যে কি ক্ষতি? তারা সন্তান স্নেহেই লালিত পালিত হবে ভিন্ন পিতা-মাতার কোলে কোনো ক্ষতি নেই।
মসজিদ, মন্দির কী অপূর্ব জায়গা। এখানে গরীব মানুষ বাইরে আর ধনী ব্যক্তি ভেতরে ভিক্ষা চায়। বরযাত্রার সময় বর সবার পেছনে থাকে আর বরযাত্রীগণ যায় আগে আগে। কবর যাত্রায় মৃতদেহ সবার আগে থাকে আর শোকাতুর সারিবদ্ধ স্বজনরা থাকে পেছনে। অর্থাৎ সমস্ত দুনিয়া সুখের দিনে থাকে আগে আর দুঃখের দিনে থাকে পেছনে। মোমবাতি জ্বালিয়ে মৃত মানুষ কে স্মরণ করা হয়। অন্যদিকে মোমবাতি নিভিয়ে পালন করা হয় জন্মদিন। সারাটা জীবন বোঝা বইলো দেয়ালের পেরেকটা, মানুষ সুনাম করলো পেরেকে টাঙ্গানো ছবিটার। যে নুনের মতো তিতকুটে জ্ঞান দেয়, সেই আসল বন্ধু। মিষ্টি কথার আড়ালে থাকে চতুর দূরভিসন্ধি। এইজন্যই নুনে কখনোই পোকা ধরে না, অন্যদিকে মিষ্টিতে পিঁপড়ের ছড়াছড়ি। মদ বিক্রেতা কে কোথাও যেতে হয়না, দুধ বিক্রেতাকে পাড়ায় পাড়ায় লোকের দরজায় দরজায় ঘুরতে হয়। আমরা দুধ বিক্রেতাকে সর্বদা বলি পানি মেশাননি তো? মদে নিজ হাতে পানি মিশিয়ে খাই। একই গ্রন্থাগারে ইঞ্জিল আর কোরান একসাথে থাকে, নিজেদের মধ্যে কখনোই লড়াই করেনা। এদের নিয়ে যারা লড়াই করে, তারা ইঞ্জিল আর কোরান কোনদিনও পড়েনা। মানুষকে জানোয়ার বললে ক্ষেপে যায়, সিংহ বললে খুশি হয়। হারুন, এই কথা গুলো আমার না। সেই ছোট বেলায় আমি কোথায় যেন পড়েছি? ঠিক মনে পড়ে না। কিন্তু কথা গুলো আমার অন্তরের গহীনে খোদাই হয়ে গেছে।
গালিব এসে আমার পাশে বসতে দেখেই ক্যাফে বয় জিউস মার্মা আবারো, মার্মা টোনে পরিষ্কার আরবি উচ্চারণে সালাম দিয়ে আমার কাছে এলে, আমি কোরাল মাছের বার-বি-কিউ অর্ডার করেছিলাম। একটি দেড় কেজি ওজনের। একটি তিন কেজি ওজনের কোরাল বার-বি-কিউ অর্ডার করেছিলাম। তিন কেজি ওজনের কোরাল বার-বি-কিউটি পার্সেল বক্সে দিতে বলেছিলাম। আর দেড় কেজি ওজনের কোরাল বার-বি-কিউটি এখানে পরিবেশন করতে বলেছিলাম। খাবার শেষে সুগার ফ্রী ব্লাক কফি সার্ভ করার অর্ডার করেছিলাম। গালিবের সগতোক্তি শেষ হতেই জিউস মার্মা দেড় কেজি ওজনের কোরাল বার-বি-কিউটি এনে আমাদের টেবিলে পরিবেশন করলো। আর খুব সুন্দর করে সোনার গাঁ-র লোগো যুক্ত রেপিং পেপারে মোড়ানো, সোনার গাঁ-র লোগো খচিত বক্সে তিন কেজি ওজনের কোরাল বার-বি-কিউটি পার্সেল নিয়ে এলো। আমি ও গালিব টেবিলে পরিবেশন করা কোরাল বার-বি-কিউ, ডিশ থেকে ছুরি ও কাঁটা চামচ সহযোগে কেটে এনে সামনের প্লেটে রেখে খাবার উদ্যোগ নিলাম। জিউস মার্মা হাতের পার্সেল বার-বি-কিউটি টেবিলের উপর রেখে তার প্রতি ইঙ্গিত করে, মার্মা টোনে বিশুদ্ধ বাংলায় বললো,
“স্যার, পার্সেল বার-বি-কিউটি কি পার্কিং-এ গাড়িতে ড্রাইভারের কাছে দিয়ে আসবো”?
আমি জিউস মার্মা’র মুখের উপর চোখ রেখে বললাম, “এই বার-বি-কিউটি তোমার বউ ছেলে-মেয়ের জন্য আমার পক্ষ থেকে আজকের ডিনার হিসেবে উপহার। বাসায় ফেরার সময় নিয়ে যাবে”।
জিউস মার্মা করুণ দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। যেন সে হতবিহ্বল হয়ে গেছে। সে আমতা আমতা করতে লাগলো। ঠিক কি ভাষায় সে অভিব্যক্তি প্রকাশ করবে তা খুঁজে পাচ্ছে না। আমি বললাম,
“জিউস, বাচ্চাদের সুশিক্ষিত, মানবিক ও পরিশ্রমী হতে শেখাবে। যদি হয় তবেই তোমার ত্যাগ স্বার্থক হবে। যাও”।
জিউস মার্মা মাথা নিচু করে আমাদের সম্মুখের টেবিলের উপরে রাখা তিন কেজি ওজনের, বার-বি-কিউ পার্সেল বক্সটি বিনয়ের সহিত নিতে গিয়ে, যাওয়ার সময় বললো,
“স্যার, খাওয়া শেষ হলেই আমি কফি সার্ভ করে দিয়ে যাবো”।
জিউস মার্মা চলে গেলে আমি বললাম, “হ্যাঁ। আমার বেশ মনে আছে আপনি মন খারাপ হলে, এই কথা গুলো আগেও বলতেন। সেই রেওয়াজ আজও অব্যাহত রেখেছেন দেখছি। যাহোক কোরাল বার-বি-কিউ খেতে খেতে রাধিকা কি করে এলো? আপনার জীবনে। এই প্রসঙ্গটা বলেন”।
রাধিকা
আমি গোটা কয়েক তাগাদা দেয়ার পর গালিব শান্ত সৌম্য স্বরে বলতে শুরু করলো,
“রাধিকার পুরো নাম রাধিকা পান্ডে পিঙ্কী। পুরান দিল্লির অভিজাত এলাকার আদি বাসিন্দা। স্লিমফিট লম্বা টকটকে ফর্সা চেহারায় আর্য আভিজাত্যের ছাপ। ওর আভিজাত্য পূর্ণ আচার আচরণে আমার মতে, বংশগত ভাবে ওর মোঘল আমাত্যদের উত্তরাধিকার হওয়া সম্ভব। কিন্তু কখনও এ বিষয়ে আমি কিছু জিজ্ঞেস করিনি। রাধিকা ছিল আমার ফ্লাইটের কেবিন ক্রু। তার সাথে জড়ানোটা একেবারে আকস্মিক। একবার আমরা লন্ডন থেকে ফ্লাইট নিয়ে নিউইয়র্ক এসেছি। রাত্রি যাপন করবো নিউইয়র্কের “ফায়ার অন দ্য আইচ” ফাইভ স্টার হোটেলে। যেদিন আমরা নিউইয়র্ক আসছিলাম সেদিন ফ্লাইটে এক কান্ড ঘটলো। দুইজন পিওর হোয়াইট ছাত্র-ছাত্রী আমাদের ফ্লাইটের যাত্রী ছিলো। নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির তরুণ ছাত্র নিউইয়র্কের স্হায়ী বাসিন্দা মাইকেল রেভারেন্ড এবং একই ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নরত তরুণী ছাত্রী লন্ডনের স্হায়ী বাসিন্দা মার্গারেট এঞ্জোলা। দুজনেই লন্ডন থেকে আমাদের ফ্লাইটে উঠলো নিউইয়র্ক যাবে বলে। বিজনেস ক্লাসে দুইজনের পাশাপাশি সিট। হাতে লেটেস্ট মডেলের আই মোবাইল ফোন, হীরার আংটি, বিপুল দামী ঘড়ি। পরনে ব্র্যন্ডের পোশাক আশাকে ও চলনে-বলনে বোঝা যায়, দুইজনই অতি উচ্চ ধনী পরিবারের সন্তান।
ফ্লাইট ছাড়ার ঘন্টা খানেক পরেই রেভারেন্ড এবং এঞ্জোলা কম্বল গায়ে জড়িয়ে পরস্পর প্রি-সেক্স করতে শুরু করলে, ফ্লাইটে কর্মরত ক্রু রাধিকার এটা সর্বপ্রথম নজরে আসে। রাধিকা প্রথমে গোপনে আকারে ইঙ্গিতে নিজ উদ্যোগে তাদেরকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু তারা রাধিকাকে কেয়ার না করে এক পর্যায়ে দুইজনই কামোত্তেজনায় বেসামাল হয়ে, কম্বল গায়ে দিয়ে পুরোপুরি সেক্স শুরু করে দিলে রাধিকা এই খবর আমাকে ককপিটে এসে জানায়। আমি ইন্ডিয়ান এ্যাংলো খৃষ্টান কো-পাইলট রেমন্ড রোজারিও-কে দায়িত্ব দিই বিষয়টি মিমাংসা করার। রেমন্ড রোজারিও রাধিকা সহ অন্যান্য ক্রু-দের সঙ্গে নিয়ে তাদের কাছে গিয়ে প্রকাশ্য ফ্লাইটে এমত ব্যববিচার বন্ধের আহ্বান জানায়। যাতে অন্যান্য যাত্রীদের মধ্যে এই পরিস্থিতি নিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়। কো-পাইলট রেমন্ড রোজারিও মিনতি স্বরে রেভারেন্ড ও এঞ্জোলাকে এ-ও বলে যে,
“প্লিজ, এমন কোনো কাজ করবেন না যাতে আমাদের বিমান সংস্থার সুনাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়”।
উভয়ই আমাদের কো-পাইলট, ক্রু তাদেরকে থোড়াই কেয়ার করে। মাইকেল রেভারেন্ড ও মার্গারেট এঞ্জোলা উম্মাদের মতো কম্বলের নিচে তাদের রমন চালিয়ে যেতে থাকে। রেমন্ড রোজারিও, রাধিকা সহ অন্যান্য ক্রুগণ রেভারেন্ড ও এঞ্জোলা-কে সেভাবে কঠিন কিছু বলতেও পারছে না। যেহেতু তারা সম্মানিত যাত্রী। তবে কয়েকজন খুব সম্ভবত মুসলিম কৃষ্ণাঙ্গ নারী-পুরুষ যাত্রী এই ব্যবিচারে ক্রুদ্ধ হয়ে তাদেরকে শাসায়। কিছু শেতাঙ্গ যাত্রী এসেও রেভারেন্ড ও এঞ্জোলা-কে মধ্য আকাশে রমন না করতে রিক্যুয়েস্ট করে। কিন্তু কিছুতেই দমবার পাত্র-পাত্রী নন রেভারেন্ড ও এঞ্জোলা। লন্ডন থেকে নিউইয়র্ক বারো ঘন্টার জার্নি। যাত্রা পথের বাকিটা সময় এই অপ্রীতিকর ঘটনায় বিমানে একটি অস্বস্তিকর পরিবেশ গড়ে উঠে। নারী, পুরুষ, শিশু যাত্রী সহ আমরা সকলেই একটি বিব্রতকর অবস্থায় জার্নিটা শেষ করি।
নিউইয়র্কে ফ্লাইট ল্যান্ড করলে কিছু সংক্ষুব্ধ যাত্রী রেভারেন্ড ও এঞ্জোলার বিরুদ্ধে এয়ারপোর্ট পুলিশে অভিযোগ দিলো। নিউইয়র্ক এয়ারপোর্টের পুলিশ অভিযুক্ত রেভারেন্ড ও এঞ্জোলা-কে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ কন্ট্রোল রুমে নিয়ে বসালে, আমরা সংশ্লিষ্ট বিমান কর্মকর্তা হিসেবে দায়মুক্ত হই। এই ধরনের একটি একেবারে অনভিপ্রেত ও অস্বস্তিকর কান্ডকারখানায় পুরো জার্নি ঝক্কির মধ্যে দিয়ে কেটেছে।নিরাপদে ফ্লাইট ল্যান্ড করে কো-পাইলট রেমন্ড রোজারিও-র কাঁধে হাত রেখে তৃপ্তির নিঃশ্বাস নিয়েছিলাম। যাত্রীদের লাগেজ হস্তান্তর ও ফ্লাইট লগ এরিয়ায় পার্কিং সহ আনুষঙ্গিক কাজ সেরে হোটেলে ফিরে আসি ফ্লাইট অবতরণের চার ঘণ্টা পর। নিউইয়র্কে আমাদের জন্য নির্ধারিত হোটেল “ফায়ার অন দ্য আইচ”-এ আমি, রেমন্ড রোজারিও, রাধিকা সহ সকল সহকর্মী যখন এসে পৌঁছাই তখন সকলেই অত্যন্ত ট্রায়ার্ড। হোটেলে যখন পৌঁছাই তখন শীতকালের বরফাচ্ছাদিত বিকেল চারটা। ট্রায়ার্ড প্রত্যেকে যার যার নির্ধারিত রুমে চলে গেলাম।
গালিব বলতে বলতে কোরাল মাছের কাঁটা বাছায় মনোযোগী হয়েছে। কাঁটা বাছা শেষে ছুরি ও কাঁটা চামচ দিয়ে আগলে কোরাল মাছের বার-বি-কিউ ডিশ থেকে কেটে তুলে নিচ্ছে নিজ প্লেটে। প্লেটে কোরাল মাছের বার-বি-কিউ ডিশ থেকে তুলে নিতে নিতে সতর্ক চোখে প্লেটের দিকে তাকিয়ে থাকে। যাতে কাটা চামচ ও ছুরির ফাঁক গলে মাছের কাটা টুকরো যাতে নিচে পড়ে না যায়। কিংবা মাছের কাঁটা মুখে পুরে গলায় বিঁধে না যায়। গালিব আমাকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে,
“হারুন, আপনি জানেন আমি খুব একটা লোকজনের সঙ্গে মিশুক প্রকৃতির বলতে যা বোঝায় তা না। আমি কিছুটা অন্তর্মুখী আপনেরাও বলেন আমি নিজেও বুঝি। কাজেই আমি বেছে বেছে দুই একজনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হই। টুক-টাক কথা বলি। অন্যদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় থাকলেও সম্পর্কটা হাই-হ্যালো পর্যন্ত থাকে। রিলায়েন্স এয়ারেও আমি বেছে বেছে যে দুই একজনের সঙ্গে কথা বলি তাদের একজন আমার অধস্তন সহকর্মী রাধিকা। অমন দহরম মহরম কিছু না- মিস রাধিকা ভালো? কেমন আছো? শুভ সকাল, শুভ দুপুর, বা শুভ রাত্রি। ওটুকুই। এটা ঠিক যে অত্যন্ত সুন্দরী নারীদের প্রতি, চুম্বকে যেমন লোহার আকর্ষণ তেমনই সব পুরুষের সহজাত একটা আকর্ষণ থাকে। কাজেই আমারও আছে। সেই আকর্ষণ থেকেই রাধিকার সঙ্গে টুকটাক কথা বলা। আমি এ পর্যন্ত দেশে দেশে ইউরোপীয়, এশীয়, মধ্যপ্রাচ্যের কিম্বা ল্যাটিন আমেরিকার যতো সুন্দরী বিমানবালা দেখেছি তাদের একজনও রাধিকার ধারে কাছে যাবার মতো রূপসী না। কী ফিগারে! কী ফেইস কাটিংএ! কী দুধে আলতা স্কিন কালারে! চমৎকার দেহবল্লরীর অধিকারী রাধিকা। চোখ ধাঁধানো অপূর্ব সুন্দরী বলতে যা বোঝায় রাধিকা ঠিক তা-ই। তবু আমার অধস্তন বলে ওই টুকটাক কথা বলা পর্যন্তই শেষ। এর অধিক কিছু না। যাহোক সেদিন বিকেল গড়িয়ে রাত অবধি আমি রুমেই ছিলাম। রাত দশটা নাগাদ বুফে ডিনার সেরে রুমে এসে টিভি দেখছিলাম। প্রায় আধা ঘণ্টা পর রাত সাড়ে দশটা নাগাদ হঠাৎ রাধিকা আমার রুমে এসে হাজির।
এখানে বলা আবশ্যক হোক ফাইভ স্টার হোটেল তবু, আমি রিলায়েন্স এয়ার কোম্পানির বরাদ্দকৃত সাধারণ রুমে কখনোই ঘুমাই না। আমি এডিশনাল চার্জ নিজ ফান্ড থেকে দিয়ে প্রেসিডেন্টশিয়াল স্যুটে অবস্থান করি। সেটা নিউইয়র্ক, লন্ডন, সিডনি, হামবুর্গ, দিল্লী, দুবাই, আঙ্কারা, টোকিও যেখানেই হোক না কেনো। বাড়তি খরচ মেটাতে সাপ্তাহিক অফ টাইম কমিয়ে, ডিউটি একটু বাড়িয়ে করি। রাধিকা ও আমি প্রায় এক বছর রিলায়েন্স এয়ারে সহকর্মী হিসেবে আছি। রাধিকা যেমন কথা বার্তায় বেশ মেধার পরিচয় দেয়, তেমনি ফ্লাইটের যেকোন ঝামেলা মোকাবিলায় ওর বুদ্ধিমত্তায় আমি আস্থা রাখি। আফটার অল মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্রাইট রেজাল্ট নিয়ে পাশ করা গ্র্যজুয়েট। যাহোক আজকে একেবারে ব্যতিক্রমী ঝক্কি ঝামেলা দেখে রাধিকা হয়তো ভড়কে গিয়ে থাকবে। খুব সম্ভবত অবিবাহিত। আবার বিবাহিত হতেও পারে। আমরা সাধারণত কেউ কারও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কোনো প্রশ্ন কেউ কাউকে করি না। সহকর্মী হিসেবে পেশাগত কারণে যতটুকু কথা বলা দরকার ঠিক ততোটাই বলি।
রাধিকা রুমে আসায় আমি ওকে স্বাগত জানালাম। এখানে বলে রাখি, রিলায়েন্স এয়ার এর আন্তর্জাতিক রুটের ফ্লাইটে হিন্দি শেখা ও জানা বাধ্যতামূলক না। রিলায়েন্স এয়ার এর ভারতের অভ্যন্তরীন রুটের ফ্লাইটে হিন্দি জানা বাধ্যতামূলক। তবু আমি হিন্দি অনেকটা রপ্ত করেছি হিন্দি ভাষায় কেউ কিছু বললে বোঝার স্বার্থে। আমি বরাবরই বৃটিশ একসেন্টের ইংরেজিতে কথা বার্তা বলি বিদেশিদের সঙ্গে। এটা আমার বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে থাকা কালীন রপ্ত করা অভ্যাস। রাধিকা ও অপূর্বা সহ সবার সঙ্গেও কথোপোকথন বৃটিশ একসেন্টের ইংরেজিতেই করেছি। অন্যরাও যথারীতি আমার সঙ্গে ইংরেজিতেই কথা বলেছে। যদিও আমি বর্ণনা দিচ্ছি বাংলা ভাষায়। আমি রাধিকা-কে স্বাগত জানিয়ে সোফা দেখিয়ে দিয়ে বসতে বলে আপেল, আঙুর, নাশপাতি, কলা, কমলা, বড়ো মেডজুল খেজুর প্রভৃতি নানান ফলের সমাহারের বাস্কেটটি এগিয়ে দিলাম ওর দিকে। রাধিকা সব বাদ দিয়ে একটা বিশাল সাইজের কলা ঝুড়ি থেকে তুলে নিলো। কলা একটু একটু করে ছুলে খেতে খেতে, ফ্লাইটে ঘটে যাওয়া রেভারেন্ড ও এঞ্জোলা-র ঘটনা নিয়ে, দু’জন ছেঁড়া ছেঁড়া কথা বার্তা বলতে বলতে রাত অনেক হলো। গল্প শেষের এক পর্যায়ে রাধিকা আমার চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললো,
“স্যার, আমার আজ খুব ভয় পাচ্ছে। আমি আজ আপনার রুমে ঘুমোব”।
আমার তো চক্ষু চড়কগাছ! মনে মনে বলি, “মেয়েটা বলে কি”!!
মুখে বললাম, “কেন? কি হয়েছে”?
রাধিকা বললো, “স্যার, ঘুরে ফিরে আমার আজ কেবল রেভারেন্ড ও এঞ্জোলা ছেলে-মেয়ে দু’টোর কথাই মনে পড়ছে। কিছুতেই মাথা থেকে ওই ঘটনা নামাতে পারছি না। তাই ভাবলাম আপনার রুমে যাই”।
আমার প্রেসিডেন্টশিয়াল স্যুটে দুইটি ডাবল সাইজের খাট আছে। আমি একটাতে ঘুমাই। অপরটি সব সময় ফাঁকাই থাকে। আমি বললাম,
“ওকে। তুমি আমার রুমের অপর খাটটাতে অনায়াসে ঘুমোতে পারো”।
আমি আমার খাটে শুয়ে পড়লাম। আমার অনুমতি সাপেক্ষে রাধিকা আমার রুমের অপর খাটে কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো। রাধিকা স্লিপিং ড্রেসের উপর ওয়ার্মিং পশমি পোশাক গায়ে ও ওয়ান টাইম রুম স্লিপার পায়ে একেবারে হাত-পা ঝাড়া রিল্যক্সড হয়েই আমার রুমে এসেছে। মনে হলো ওর এই পরিকল্পনাটা তাৎক্ষণিক না। একেবারে সুপরিকল্পিত। কাজেই ঘুমোতে বাড়তি প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়নি। ওয়ার্মিং পশমি পোশাক খুলে ওয়াল কেবিনেটে ঝুলিয়ে রাখে। মেইন লাইট নিভিয়ে কেবিনেট লাইটের ক্ষীণ আলো আঁধারিতে শুয়ে পড়ে রাধিকা। প্রায় আধ ঘন্টা পর আবার বললো,
“স্যার, আমার তবু্ও ভয় পাচ্ছে। আমি আপনার সঙ্গে আপনার খাটে ঘুমাবো”।
আমি বললাম, “ও-কে। আসো। তোমার কম্বলটি নিয়ে এসে আমার পাশে শুয়ে পড়ো”।
আমি অনেকটাই সরে এসে আমার খাটেই চমৎকার গোলাপি রংয়ের স্লিপিং ড্রেস পরা রাধিকাকে বিছানায় এক পাশে জায়গা ছেড়ে দিলাম। বিমান বাহিনীতে থাকার সুবাদে আই কিউ ক্লাসের সর্বোচ্চ নাম্বার প্রাপ্তি এমনি এমনি হয়নি। কাজেই আমি মনে মনে ভাবলাম,
“মিস রাধিকা, তুমকো পিকচার আভি বাকি হ্যয়”।
কিন্তু আমি নিজে থেকে কোন প্রতিক্রিয়া দেখালাম না। আমি যা ভেবেছি তা-ই হলো। রুমে কেবল কেবিনেট লাইট জ্বালানো একেবারে হালকা আলো আঁধারি। আরও আধা ঘণ্টা পর আমি টের পাই রাধিকা ওর কম্বল পাশে ফেলে আমার কম্বলের নিচে চলে এসেছে। টের পেলেও আমি জেগে উঠতে চাই না। আমি ঘুমের ঘোরে থেকেই বুঝতে পারছি, আমার কম্বলের নিচে রাধিকার বাহুডোরে আমি পুরোপুরি আবদ্ধ। বাইরে মাইনাস ডিগ্রির ঠান্ডায় বরফ পড়ছে। ডিসেম্বর মাস। ভেতরে রুম হিটার চালু। তাই বাইরের ঠান্ডা ভেতরে অনুভূত হচ্ছে না। আমার কম্বলের নিচে রাধিকা আমাকে জড়িয়ে ধরতেই আমি ঘুমের ঘোরে স্বপ্নে দেখি-
রাধিকা ককপিটে একাজ ও কাজের ছুতোয় আমার ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। রাধিকাকে রিলায়েন্স এয়ার লাইন্স কোম্পানির লোগো খচিত পার্পল কালারের মুকুট পরিহিত ও মিহি পার্পেল কালারের বিমান বালাদের ড্রেসে অপূর্ব সুন্দর লাগছে। যেনো একটি ডানাকাটা পরী ফ্লাইটে ঘোরাফেরা করছে। স্বপ্নের ডানাকাটা পরীটি এখন কম্বলের নিচে আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে। পায়ের স্কিন টাইট মোজা এক পা দিয়ে আরেক পায়ের মোজা খুলে ফেলছে রাধিকা। আমার পায়ে ঘষা খাচ্ছে রাধিকার মোলায়েম উম্মুক্ত পা। তারপর সে একটু আলগা হয়ে দু হাত কোমরের নিচে নিয়ে প্যান্টি খুলে ফেললো, আমি স্পষ্ট বুঝতে পারি। এখন ওর নিম্নাঙ্গ সম্পূর্ণ নিরাবরণ। রাত কতো হবে? বারোটা? একটা? জানি না। ওর খালি পা ঘুমন্ত আমার গায়ের উপর। দশ মিনিট কি পনের মিনিট বাদে আলগোছে রাধিকা তার গোলাপি রঙের নাইটি সহ খুলে ফেলা মোজা, প্যান্টি, নাইটি লাল কার্পেটে মোড়া মেঝেতে ছুড়ে ফেলে, ঘুমন্ত পুতুল আমাকে তার বাহুডোরে পুরোপুরি আবদ্ধ করে ফেললো। আমি গভীর ঘুমের ঘোরে একটুও টু শব্দ করছি না। আমার কম্বলের নিচে নগ্ন শরীরে রাধিকা আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার চোখে মুখে উম্মাদের মতো চুমু খেতে লাগলো। এক পর্যায়ে সে উম্মত্তের মতো একে একে আমার ট্রাউজার, স্লিপিং শার্ট, স্যান্ডো গেঞ্জি সব খুলে মেঝেয় ছুড়ে ফেলা ওর কাপড় চোপড়ের উপর লাল কার্পেটে ছুড়ে ফেললো। আমি ঘুমের ঘোরেই রাধিকার উন্মত্ততায় ওকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে লাগলাম।
সেই সারারাত আমরা এক সঙ্গে কাটালাম একই কম্বলের নিচে। নিউইয়র্কের সেই রাতের পর পৃথিবীময় যে দেশের হোটেলেই থেকেছি আমরা প্রায় নিয়মিত মিলিত হতাম। আমিও কখনও তাকে জিজ্ঞেস করিনি তারা কয় ভাই-বোন? বাবা-মা কি করে? তাঁরা আদৌ বেঁচে আছে কি নেই? ওর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি? আমাকেও রাধিকা একই বিষয়ে কখনও কোনো প্রশ্ন করেনি। দৈহিক সম্পর্ক গড়ার আগের মতোই এখনও আমরা, কেউ কারো ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কোন প্রশ্ন করি না। পরস্পরের এই যৌন সম্পর্ক আমাদের দৈনন্দিন জীবন যাপনে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন আনেনি। এমনকি আমাদের সহকর্মী অন্যরাও কখনো আমাদের মেলামেশার বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায়নি। আমাদের উভয়ের সম্পর্কটা নির্জলা বাস্তবতার একেবারেই দৈহিক কাম তাড়িত সম্পর্ক। আমাদের সম্পর্কটা নির্মল শারীরিক আনন্দ উদযাপনের নিরেট সক্ষমতার সম্পর্ক। হৃদয় ঘটিত আবেগের, অনুভূতির এক ফোঁটা সংম্পর্শ এতে নেই। আমাদের সম্পর্কটা কোনো প্রকার অবাস্তব, অলৌকিক, বায়বীয়, ঐশ্বরিক প্রেম নয়। আমরা কাল্পনিক ফানুসে উড়িনি। আমরা উভয়ই প্রায় সমান দৈহিক সৌন্দর্যের অধিকারী। রাতে আমরা একে অপরের দেহকে উপভোগ করে তৃপ্ত হই। দিনের বেলায় যথারীতি পরস্পর উর্ধতন ও অধস্তন সহকর্মী। রাতের বেলায় দিনকে সামনে আনি না। দিনের বেলায় রাতকে সামনে আনি না। (চলবে)
বি.দ্র “সৌপ্তিক” শব্দের অর্থ অন্ধকারের যুদ্ধ বা রাতের বেলার যুদ্ধ। প্রতিটি মানুষের জীবন মানেই যুদ্ধ। দেশে দেশে দিনের আলোর যুদ্ধে জেনেভা কনভেনশন মেনে চলতে হয়। যে বা যারা জেনেভা কনভেনশন না মানবে তাকে বা তাদের আন্তর্জাতিক আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। রাতের যুদ্ধ হয় এলোপাতাড়ি, সেখানে আইন কানুনের কোনো বালাই থাকে না। যে কারণে দেখা যায় পৃথিবীতে জাতিতে জাতিতে যুদ্ধ সর্বপ্রথম শুরু হয় রাতের অন্ধকারে। আমাদের জীবন যুদ্ধও কোনো আইন মেনে চলে না। প্রকৃতি আমাদের জীবনকে নিয়ে অন্ধকারের যুদ্ধের মতো এলোপাতাড়ি খেলে যায়। কাজেই আমরা কেউ জেনেভা কনভেনশন মেনে চলা আইন কানুনের নিগড়ে আবদ্ধ জীবন যুদ্ধে লিপ্ত না। আমাদের প্রত্যেকের জীবন প্রকৃতির বেখেয়ালী নিয়ম মাফিক “সৌপ্তিক”।
পুনশ্চঃ এই উপন্যাসকে রূপালী পর্দায় আনতে চান? আনবেন। শর্তঃ রাধিকা চরিত্র মুম্বাইয়ের ও অপূর্বা চরিত্র সাউথের নায়িকা দিয়ে করাতে হবে। বর্তমানে বা ভবিষ্যতেও বাংলাদেশের কোনো নায়িকা-কে রাধিকা ও অপূর্বা চরিত্র চিত্রায়নে রাখা যাবে না। কেনো? আমি কোনো ব্যাখ্যা দিবো না।
Leave a Reply