স্মৃতির পাতায়
তিস্তামুখ ঘাট শতাব্দীর ইতিহাস।
মাকে দেখতে ঈদের ছুটিতে বাড়িতে যাওয়া হলো। ঈদের পরদিন বাড়ির সকলে নৌভ্রমণের ইচ্ছা পোষণ করল। বিকেলে স্ত্রী, ভাতিজার পরিবার ও ভাগ্নিদের নিয়ে নৌ ভ্রমণের উদ্দেশ্য গেলাম ফুলছড়ি ঘাটে। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগের সেই ফূলছড়ির চিত্র এখন শুধুই অতীত কল্পনা। সেদিনের ফুলছড়ি ছিল থানা শহর। সে শহরের পাশ দিয়ে রেল পথ। শহর থেকে এক কিলোমিটার দূরে ফেরী ঘাট – যার নাম ছিল তিস্তা মুখ ঘাট। রাতে জাহাজের সার্চ লাইট এর আলো বহুদূর থেকে দেখা যেত।
রাজধানী ঢাকার সাথে উত্তর বাংলার রেল যোগাযোগের একমাত্র পথ ছিল তিস্তামুখ ঘাট। আর যমুনার ওপারে বাহাদুরবাদ ঘাট। এ দু’ঘাটে প্রতিদিন যাত্রীবাহী ফেরি আপডাউন করতো। ঢাকা থেকে ছেড়ে আসতো সেভেন আপ নামের একটি ট্রেন যার শেষ গন্তব্য ছিল দিনাজপুর। দিনাজপুর থেকে ঢাকা মুখে যে ট্রেনটি তার নাম ছিল ঢাকা মেইল। ট্রেন যাত্রী পারাপারের পাশাপাশি মালামাল বাহী ট্রেনের জন্যও এ ফেরি ঘাটটি ব্যবহৃত হতো। চব্বিশ ঘন্টা মালামাল বাহি ট্রেনের বগি এপার ওপার হতো।
ছোট বেলায় দাদুর সঙ্গে পায়ে হেঁটে ফুলছড়ি বাজারে যেতাম। দাদু নিয়ে যেতেন জাহাজ দেখাতে। প্রথম দিনের জাহাজ দেখার অনুভূতি ছিল সত্যিই অভূতপূর্ব। সে অনুভূতি এখনও মনে পড়ে। কুলিদের দৌরাত্ম্য ছিল মারাত্মক। ফেরির মালামাল তোলা ও নামানোর জন্য নম্বরওয়ালা কুলিরা কাজ করতো। ফেরি ঘাটে নোঙ্গর করার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে কুলিদের লাফ ঝাফ দেখার মত এক দৃশ্য ছিল।
ইস্টবেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানী
প্রশাসনিক, সামরিক ও বাণিজ্যের লক্ষ্যেই ব্রিটিশ সরকার বাংলায় রেল যোগাযোগের উন্নয়ন করেছিল। তার ধারাবাহিকতায় ব্রিটিশ আমল বিদায় নেয়ার পরেও দীর্ঘ কাল আমরা রেল সেবার সুযোগ পেয়েছি। বিট্রিশ শাসন আমলে ইন্ডিয়ান রেল কোম্পানি নারায়ণগঞ্জ এর সাথে উত্তর বঙ্গ ও আসামের রেল যোগাযোগ সংস্থাপন করার জন্য বাহাদুরবাদ তিস্তামুখ ঘাট ও চিলমারি ঘাটের সংযোগ স্থাপন করে । নারায়ণগঞ্জ থেকে বাহাদুরাবাদ ঘাট রেললাইন এর কাজ ১৮৮৫ সালে শুরু করে চারটি ধাপে ১৯১২ সালে এসে কাজ শেষ হয়।
খড়া মৌসুমে তিস্তামুখ ঘাট থেকে বাহাদুরবাদ ঘাট ফেরি পারাপারের সময় লাগত প্রায় তিন ঘন্টা। রাতে কুয়াশার কারণে পাঁচ ছয় ঘন্টাও লেগে যেত কখনো।
তখন বর্ষাকালে ফেরি পারাপারের মজাটাই ছিল বেশি। মাত্র ত্রিশ চল্লিশ মিনিটে তিস্তামুখ ঘাট থেকে বাহাদুরবাদ ঘাট পৌঁছে যাওয়া যেত।
শেরে বাঙলা, সোহরাওয়ার্দী ও সোনারগঁ নামে যাত্রীবাহী ফেরি ছিল। সোনারগাঁ ছিল সব থেকে আধুনিক। এসি, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর যাত্রীদের জন্য আলাদা আলাদা ব্যবস্থা ছিল। ডাইনিং রুম ছিল।
দিন দিন প্রাকৃতিক পরিবর্তন ও নিয়মিত খননকার্য না হওয়ার কারণে নদীর নাব্যতা হ্রাস, নদী ভাঙনে নতুন চর সৃষ্টি ইত্যাদি অনেক কারণেই ফেরি চলাচল বন্ধ হতে চলল। অন্যদিকে যমুনা সেতু চালু হবার পর বিকল্প হিসেবে সড়ক পথের প্রাধান্য বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য তিস্তামুখ ঘাট অবশেষে কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেল।
সেই নদীর নাম আছে অথচ ঘাট নেই , ফেরি নেই। শত বছরের তিস্তামুখ ঘাটের অস্তিত্ব লেখা রইলো আজ স্মৃতির পাতায়।
Leave a Reply