বিপত্নীকের বউ (৮)
সৌভিক সচারাচর রাগ করে না।ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুটা হতবাক। কাউকে কিছু বলতে না পারায় তার সমস্ত
রাগ গিয়ে পরে ময়নার উপর।
লিলির কর্মকাণ্ডে বাড়ির সবাই সব ময়ম তটস্থ থাকে।কলি
পিছনে থেকে ইন্ধন যোগায়। রমা মেয়েদের বিরুদ্ধে যাবেই
না।রমার বক্তব্য হলো,শ্বশুরবাড়িতে সকল দায় দায়িত্ব এক
হাতে সামলেও অনেক কথা শুনে।বাবার বাড়ি আসে একটু
শান্তির জন্য।
সৌভিক পিছন ফিরে হিসেব করে, লিলি কলি তো সপ্তাহের
চারদিনই তো এইখানে থাকে!শান্তা একবার বলেছিল,একা
একা প্রতিদিন এতো রান্না করা,আমি আর পারছি না। শরীর
টাও ভাল নেই।
সৌভিক ভাবে, আসলেই তাই।শান্তা চলে যাবার পর কলি ও
লিলির সব আবদার পূর্ণ করে রমা।অমল মাঝে মধ্যে বলে
মেয়ে দুটো বড় অমানবিক।এতো আশকারা দিওনা ওদের।
মেয়ে দুটো বিবেকহীন।
সৌভিক তাকিয়ে দেখে ময়না বিছানায় মাথা নীচু করে বসে আছে,কোন কথা বলছে না। চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে।সৌভিক কি বলবে ভেবে পায়না।
কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে সৌভিক বললো,তুমি বড়দিকে জটিলা বলতে গেলে কেন? বড়দি তোমার মায়ের বয়সী। ওর বড় মেয়ে তোমার বয়সী ময়না! তোমার চঞ্চলতা, কথা বলা এই সব নিয়ে তো আমি বা ঘরের সবাই কখনো কিছু বলিনি।
ময়না অবাক হয়ে সৌভিকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
সৌভিক বলে,আমার স্ত্রী শান্তা চলে যাবার আজ মাত্র ষাট দিন। আমার কাছে শান্তার অস্তিত্ব অনেক বেশী সজীব।তোমাকে বিয়ে না করাটা কাকতালীয়।কিন্তু আমি ভেবে পাচ্ছি না এই মূহুর্তে আমার করনীয় কি!
ময়না কোনো কথাই বললোনা।সৌভিকের কথা তার কানে গেল কিনা জানা গেলো না।
গুড্ডুকে নিয়ে টুটুল ততক্ষণে সৌভিকের রুমে এসে দেখে ময়না মাথা নীচু আছে।সৌভিক টুটুল কে বলে,তোর বন্ধুকে জিজ্ঞেস কর তো ও কি চায়!
ময়না চোখ দুটো মুছে বললো,ভায়া ধরে কথা বলতে হবে না। আমার বিচার করতে আসছেন! এক্ষুনি আপনাদের বাড়ি থেকে চলে যাব।
বিছানা থেকে নেমে কয়কটি জামা কাপড় একটা ব্যাগে গুজে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে গেল।
টুটুল জিজ্ঞেস করে,ময়না তোর বৌভাতের কি হবে!
ময়না বলল,নিকুচি করি বৌভাতের,যে বাড়িতে মানুষ কে মানুষ বলে মনে করেনা ওখানে কেমন বৌভাত হবে জানা আছে।
বড়দিকে জটিলা বলা অন্যায় হয়ছে।কিন্তু বড়দি মেজদি যে আমার সাথে সবসময় খারাপ ব্যবহার করে, ঠিকমত খেতে দেয়না।বাড়ীর সকলেই তো জানেন। তখনতো কেউ কিছু বলেন না।। বোনেরা যখন অকথ্য গালিগালাজ করে তখন তাদের কোনো দোষ তো আপনাদের চোখেই পরে না।
আপনার বৌকে এই পরিবারে কত কষ্ট সইতে হয়েছে তা-ই বা কে জানে!চলে গিয়ে শান্তি পাইছে।আমার বাবা মা কেউ নেই। জন্মের পর পরের বাড়িতেই বড় হয়েছি।কোনোদিন আমাকে খাবার দেয়নি এমন ঘটনা ঘটেনি।
টুটুল জিজ্ঞেস করে তুই ব্যাগ গুছিয়েছিস কেন?
ময়না ঃ আমি চলে যাব।
সৌভিক জিজ্ঞেস করে,কোন চুলোয় যাবে শুনি।জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ময়না সৌভিক কে বলল,যাবার জায়গা নেই আপনাকে কে বলল?এই বাড়ি থেকেই একজন আমার ভাই কে কল করবে।একটু পড়ে আমার ভাই আমাকে নিতে চলে আসবে। গুড বাই দিয়ে চলে যাব।গুড্ডুকে নিয়ে যাব।
সৌভিক বলল,এই মেয়ে,আমার বাচ্চা নিয়ে যাবার তুমি কে!
ময়না ঃ আমি ময়না। আমি রাখতে পারবো।আমার ছোট থেকে বাচ্চা পালনের অভ্যাস আছে।
ঃ কতগুলো বাচ্চা হয়েছে তোমার!
ঃ- এই টুটুল, তোর দাদাটা কিচ্ছু বুঝেনারে।বাচ্চা হতে হয়
নাকি?গুড্ডুর মতো পেয়েছি।
সৌভিক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,এ্যাঁ,কয় বার তোমার
বিয়ে হয়েছে।
ময়না ঃ একবারও না। বিয়ে না করেও বাচ্চা পাওয়া যায়।
টুটুল হাসতে হাসতে গড়াগড়ি করছে।
সৌভিক বলল,কি সর্বনেশে কথারে বাবা!এবার বলো এতো
গুলো বাচ্চা কোথায় রেখে এলে!
ময়না ঃ- বাচ্চাদের মায়ের কাছে।
কলি দরজায় দাঁড়িয়ে সৌভিককে ডেকে বলে বাবু, একজন আর্মি আফিসার আসছেন।
সৌভিক অবাক হয়। ব্যাপার কি? নীচে নেমে এসে সামনে
দাঁড়াতেই অমল বলে উনি ময়নাকে নিতে আসছেন।
সৌভিক তাঁকে দেখে বলে,বিল্টু তুই?
বিল্টুতো অবাক।বলল,বাবু তোর বাড়িতে ময়না বৌ হয়ে এসেছে নাকি! যাক তোর সাথে এক যুগ পর দেখা হলো।
ময়না কোথায়?
সৌভিক বলল তুই বস।বলে সিঁড়ির সিঁড়িতে চোখ পড়তেই
দেখে ডান হাতে একটি ব্যাগ ও বাম কোলে কলসির মত ধরে আছে গুড্ডুকে।দেখেই বুঝা যাচ্ছে সৌভিক লজ্জায়
পড়ে গেছে।
ময়না বিল্টুর কাছে এসে দাঁড়ায়। দাদা চল।তুমি গুড্ডুকে কোলে নাও।আমি ব্যাগে দুটো সালোয়ার কামিজ নিয়েছি।আমার হয়ে যাবে।
তুই পরের ছেলে নিয়ে যাবি কেন?
ধূর দাদা তুই বুঝিস না!আমি পরের ছেলে নিচ্ছি নাতো, আমি আমার বরের ছেলে নিয়ে যাচ্ছি।
বিল্টু চমকে উঠে। কি বলে মেয়েটা! তাহলে ময়নার বরের
আগে একটি বিয়ে হয়েছে!বিল্টু সৌভিকের কাঁধে হাত রেখে
বলল,বাবু একটি প্রবাদ আছে জানিস,অভাগা যেদিকে চায়
সাগর শুকিয়ে যায়। ময়নার বর কে? তুই!
সৌভিক হ্যাঁ বলে, বলল,ময়না কোথাও যাবেনা।ওর দায়িত্ব
আমার। তুই বস।সবাই চায়ের আড্ডাতে গল্প করি।
সৌভিক ও এক স্কুল ও কলেজে পড়তো।তার কে কোথায়
কেউ জানেনা।
বড়মা ময়নাকে লক্ষ্য করে কাছে ডাকেন।ময়না তার কাছে গিয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসে।বড়মা জিজ্ঞেস করেন,আমার দিকে চক্ষু তুলে চা দেখি।ময়না আবার চোখ টেরা করে তাকায়।
বড়মা বলে,তোর টেরা চোখ সবাইকে দেখা।সবাই আমাকে
কয় ময়নার চোখ অনেক সুন্দর। আয় এখন দ্যাখ টেরা বৌ।
ময়না এবার হেসে দিল।
বড়মা বলল,আমি খুব খারাপ রে ময়না। সবার সাথে কুট- কাচালি না করলে আমার ভালই লাগেনা।চক্ষুর দেহা আর মনের কতা মিলাবার চেষ্টা করি নাই কখনো।শুধু একখান
কথা কই তরে এই বাড়ির চইদ্দ গুষ্টির কেউ মাইয়াগো গায়ে
হাত তুলে নাই। তাই লিলিরে শাসন করা হয়নাই।লিলি কলি
রে ক্ষেমা কইরা দে।
ময়না বলল,ও বড়মা তুমি কখন কোন সময় কোন পীরের
মুরিদ হইলা!অতশত কতা শুনার সময় নাই। আজ আমি
দাদার সাথে যামুগা।
বড়মা ঃ অমল যে সবাইকে নিমন্ত্রণ দিল।আত্মীয় স্বজন
বাড়িত আইতে লাগছে।বৌভাতের অনুষ্ঠানে বৌ নাই। সক্কলে অমলরে অপমান করবো।তর কেমুন লাগব ক-তো
দেহি।
ময়না চিন্তায় পড়ে গেল। কথা তো ঠিক।তারপর বলল, ঠিক আছে বড়মা। এক কাজ করি।বৌভাত তো একদিন বাকি
আছে।দাদার সাথে গিয়ে মাসীকে দেখে আসি।কত বছর
দেখি না।আজ রাতে মাসীকে জড়িয়ে ঘুমাবো। মা মা গন্ধ
পাব। আমার এখন এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না। মায়ের
কথা মনে পড়ছে। বৌভাতের দিন সকালে আসব। শেষ হলে
মায়ের কাছে চলে যাবো।
বড়মা বললেন,তুই জানোস না এই ভাবে চলে গেলে তো
তুই হাইরা গেলি,তর অধিকার তুই ছাইড়া দিলে তো তর
সব হারাইয়া যাইবো রে।
বিল্টু সৌভিককে কিছু বলে।সৌভিক ময়নাকে ডেকে বলে, ময়না তুমি সুটকেসে সুন্দর করে গুছিয়ে গুড্ডুর কাপড়,
আমার তোমার কাপড় রাখো।তোমার সাথে আমিও যাবো।
ময়না একটু খানি হাসি দিয়ে ময়না বলল,সত্যি!
ময়না দৌড়ে চলে যেতেই সৌভিক বলে,বড়মা চিন্তা করোনা
ওকে নিয়ে বিল্টুর সাথে ঘুরে আসি।নইলে সুযোগ বুঝে কোনো ফাকে গুড্ডুকে নিয়ে পালিয়ে যাবে।
বড়মা ঃ ওরে বাবা,এদেহি ডাকাইত মাইয়া।
বিল্টু বলল,মোটেও ডাকাত নয়।ঝগড়াটে বটে।
বড়মা ঃ- ঝগড়াইটা মাইয়া বুঝতে পারছি। এও বুঝতে
পারতাছি চোক টেরা না অইলেও ঘাড়ের রগ টেরা আছে।
আগের বউটার মত ঠান্ডা না।
সৌভিকের মনে পড়ে,কত কটুকথা শান্তাকে লিলি ও কলি
বলতো।উত্তর দিতো না। অসুস্থতা নিয়ে দিন রাত খোটা
শুনতে হতো।সৌভিক কিছু বলতে গেলে বলতে দিতো না।
শান্তা বলতো থাকনা বাবু,ওরা তো সত্যি কথাই বলছে,আমি
তো চির রুগ্ন। হঠাৎ কখন নাই হয়ে যাব।
বিল্টু বড়মাকে বলে,বড়মা টেনশন করার দরকার নেই। ও
কে ঘুরতে নিয়ে যাচ্ছি। রাতেই ফিরে আসবে।
বিল্টু সৌভিককে ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞেস করে, কি ভাবছিস, সব ঠিক হয়ে যাবে।ঐ দিকে চেয়ে দ্যাখ।সৌভিক ভাবনার ভীড় থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ময়না দুটো সুটকেস,টুটুল একটি সুটকেস নিয়ে নেমে আসছে।গুড্ডু মহানন্দে লাফাতে লাফাতে বলছে বেরু যাব,বেরু যাব,বেরু
যাব মনার সাথে।
সৌভিক জিজ্ঞেস করে, এতো গুলো সুটকেস কেন?
ময়না বলে,, তিনটে নয়,চারটা সুটকেস যাবে।
সৌভিক ঃ- মানে!
ময়না ঃগুড্ডুর একটি, আমার একটি, টুটুল আর আপনার
একটি।আরেকটি বড়মার।
সৌভিক ঃ বড়মা এখন বিশ্রাম নিবে।
ময়না ঃ না।আমার সাথে যাবে।
সবাই ময়নার কাণ্ডকীর্তি দেখছে।কেউ কিছু বলছে না।তার কারন বিল্টু কিনা কে জানে!লিলি কলি দুজনকেই আড়ষ্ট
দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে কলি বিল্টুর সামনে আসছে না।
মেয়েদের কারনে রমা খুব বিরক্ত। বলল, যাও ঘুরে আসো
সৌভিক বলে,একটা সুটকেসও যাবেনা।
বড়মা বলে, বাবারে, আমি যাইতে পারুমনা।আমার শরীল
খারাপ কইরে ফেলাইব।তুমরা ঘুরি আসো।
এড়মনটন কানাডা।
Leave a Reply