মিজোরাম ভ্রমণ
ভারতের উত্তর পূর্ব কোণে অবস্থিত মিজোরাম প্রদেশের দক্ষিণ পশ্চিমে বাংলাদেশ ও পূর্ব দক্ষিণে মায়ানমার, উত্তর পূর্বে ভারতের ত্রিপুরা ও মণিপুর প্রদেশ অবস্থিত। ভারতের পাহাড়ী প্রদেশ গুলোর মধ্যে আমাদের প্রতিবেশী মিজোরাম। রাজধানী আইজল। আমাদের দেশের সাথে সীমানা থাকার পরও স্থল বন্দর না থাকার কারণে আমাদের সরাসরি যোগাযোগ নেই ভারতের এ প্রতিবেশী প্রদেশটির। পাহাড়, নদী ও হ্রদের দেশ মিজোরাম। চারিদিকে উঁচু উঁচু পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে সামান্য কিছু কৃষিযোগ্য সমতল ভূমি রয়েছে যেখানে ধান, গম, ভুট্টা ইত্যাদি ফসলের চাষ হয়। আর পাহাড়ী জমিতে আদা, হলুদ, কমলাসহ নানা রকমের ফল ও সব্জির আবাদ হয়। মিজোরামে গ্রীষ্মকালীন তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৩০ ডিগ্রি এবং শীতকালে সর্বনিম্ন ৭ ডিগ্রি। মৌসুমী বায়ুর প্রভাবের ফলে মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভরপুর একটি দেশ, পর্যটন ব্যবসা উঁকি দিচ্ছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে কাজে লাগিয়ে মিজোরাম একদিন বিশ্ব পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে। মিজোরামে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা নেহাত কম নয়। জুম চাষই কৃষি ভিত্তিক অর্থনীতির প্রধান অবলম্বন। অর্গানিক কৃষি পণ্য এখানকার গর্ব। তিন ঋতুর দেশে নানা রকমের ফলের উৎপাদন হয়।
ভারত সরকারের দেশ ভিত্তিক অবকাঠামো উন্নয়নের দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনার কাজ দ্রুত চলছে। সড়ক ও বিমান যোগাযোগের পাশাপাশি রেল যোগাযোগের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। এ দুর্গম পাহাড়ে বিমান বন্দর স্থাপন করার কাজও খুব সহজ ছিল না। চারিদিকে উঁচু পাহাড়ের মাঝে সামান্য একটু সমতল ভূমিতে তৈরি হয়েছে লেংপুই বিমান বন্দর। প্রতিদিন লেংপুই থেকে কলকাতা, দিল্লি এবং গোহাটি বিমান বন্দরে বিমান চলাচল করে। এখনো লেংপুই বিমান বন্দরের কাজ চলছে। কাজ সম্পন্ন হলে সুন্দর লাগবে। ছোট হলেও যাত্রীদের ভিড় চোখের পড়ার মত। দুর্গম পাহাড়ের মাঝে বিমান বন্দর মিজোরামের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক উন্নয়নকেই নির্দেশ করে।
গাড়ি চালক এর ইংরেজি কথোপকথনে বুঝলাম এখানকার শিক্ষার গুণগত মান বেশ উন্নত। হিন্দি ভাষার প্রচলন স্থানীয়দের মুখে নেই। মিজোরামের স্থানীয় বা রাষ্ট্রীয় ভাষা মিজো। তবে শিক্ষা, প্রশাসনিক কাজে ব্যাপকভাবে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার। ব্রিটিশ আমলেই মিজো ভাষার অক্ষর তৈরি করেছিলেন খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারক গণ। তাই লেখার হরফ গুলো রোমান ও ইংরেজি অক্ষরের মতই। মিজো ভাষায় পঁচিশটি বর্ণ রয়েছে। পাহাড়ীদের সাক্ষ্যরতার হার ৯০%।
খ্রিস্টান ধর্ম যাজকরা মিজোদেরকে ধর্ম প্রদানের পাশাপাশি শিক্ষা, ভদ্রতার জ্ঞান দিয়েছে। তারা মিজোদের আদি কৃষ্টি ও সামাজিক প্রথাকে নষ্ট করেনি।
মিজোরা মঙ্গোলিয়ান- তিব্বতিয়ান জাতির অংশ। অতীতে মিজোরা যাযাবর জীবন যাপন করতো, তাই বিভিন্ন সময়ে নতুন নতুন অঞ্চলে গিয়ে সেখানকার অধিবাসীদের সংগে ঝগড়া বিবাদ লেগে থাকতো। হাজার বছরের বেশি সময় থেকেই মিজোরা বর্তমানের মিজোরাম নামক দেশটিতে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। মিজোরা ঐতিহাসিক ভাবেই সাহসী জাতি। দুর্গম পাহাড়ের বসবাস বংশ পরম্পরায় চলে আসছে। গ্রাম প্রধান শাসন প্রথায় তারা বিশ্বাসী। ব্রিটিশদের সাথেও মিজোরা যুদ্ধ করেছে, বার্মিজদের সাথেও যুদ্ধ করে আলাদা হয়েছে। ভারত স্বাধীনতার সময় থেকে অনেক রাজনৈতিক উত্থান পতনের মধ্য দিয়েই আজকের মিজোরাম একটি স্বতন্ত্র প্রদেশ হিসেবেই ভারতের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত। যুগের পর যুগ যুদ্ধ এবং স্থল বেস্টিত এ দেশটি স্বাধীন ভাবে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে তেমন উন্নতি করতে পারেনি। এখন সময় এসেছে এ পাহাড় কন্যা মিজোরাম এর অধিবাসীদের আর্থিক উন্নয়নের।
মিজোদের প্রধান খাদ্য ভাত, সব্জি, বিভিন্ন প্রকার মাছ ও মাংস । মিজোবাই ও মিজোচাটনি নামের একটি খাবার যা মিজোদের খুব প্রিয়। কয়েক প্রকার সব্জি, আঠালো চাল ও সোডা দিয়ে বাই তৈরী করে। মিজোদের তিনটি বড় উৎসব মিমকুট, ছাপচারকুট ও পাউলকুট। এগুলো কৃষি ভিত্তিক উৎসব যা আবার তিন ঋতুর সময় উদযাপিত হয়।মিজোদের সমাজ পুরুষ তান্ত্রিক। বিয়েতে কনেকে পণ দিতে হয়।
আইজলের দর্শনীয় স্থান গুলোর মধ্যে মিজোরাম রাষ্ট্রীয় মিউজিয়াম, সলোমান টেম্পল, কেবি প্যারাডাইজ, হিলভিউ রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি বিখ্যাত। আইজলের দিন ও রাতের দৃশ্য চমৎকার। পাহাড়ের গা বেয়ে নির্মিত ভবন গুলোর আলো আকাশ থেকে দেখতে অপরূপ লাগে। বিমান বন্দর থেকে পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে পৌঁছে গেলাম গেস্ট হাউজে। গাড়ি থেকে নেমে রিসেপশন ডেস্কে গেলাম। রিসেপশনিস্ট জানালো থার্ড ফ্লোরে আমার থাকার ব্যবস্থা। আমি লিফ্টের বাটন চেপে অপেক্ষা করছি আর দেখছি লিফ্টের সিগন্যাল নির্দেশ করছে আমার অবস্থান সিক্সথ ফ্লোরে। প্রথমে ভাবলাম লিফ্ট ভুল সিগন্যাল দিচ্ছে। পরে দেখি যে লিফ্ট আমাকে সিক্সথ ফ্লোর থেকে নীচে থার্ড ফ্লোরে নিয়ে এলো। আসলে গাড়ি পাহাড় বেয়ে উপরে নিয়ে গেছে সিক্সথ ফ্লোরে যেখানে হোটেলের প্রধান অভ্যর্থনা কেন্দ্র। সাধারণত সমতল ভূমিতে হোটেল গুলোর অভ্যর্থনা নীচের তলায় হয়। কিন্তু আইজল- এর এ হোটেলের অভ্যর্থনা উপরের তলায় । মনে হয় ল্যান্ড স্কেপিং এর জন্য ভবনের নির্মাণ শৈলী এমন।
বৈশ্বিক পরিবর্তনের ছোঁয়া বর্তমানে অনুন্নত দুর্গম পাহাড়ের এ প্রদেশ মিজোরামে একটু একটু করে লাগতে শুরু করেছে। এ পাহাড়ী শহরে কেএফসি, ডমিনাস ইত্যাদি ব্রান্ডেড রেস্টুরেন্ট এবং নানা প্রসাধনী সামগ্রী ও ব্র্যান্ডেড কাপড়ের আউটলেট বেশ কিছু চোখে পড়ল। এখানে চলাচলের জন্য দু চাকার বাইক ও ট্যাক্সির ব্যবহার বেশি। গাড়ি ও স্কুটির শোরুম দেখে বুঝলাম এ প্রদেশের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা দিন দিন বাড়ছে। গাড়ি চালকের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম অনেক আগে থেকেই এখানকার মেয়েরা নার্স ও গৃহকর্মী হিসেবে বিদেশে চাকরি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। এদের অধিকাংশই শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস করে। গাড়ি চালকের মাসিক নীট আয় ৫০,০০০ রুপির বেশি, নির্মাণ শ্রমিক হেলপার দৈনিক ৬০০ রুপি , হেড মিস্ত্রির দৈনিক মজুরি এক হাজার রুপি। বয়লার মুরগির কেজি ৩৫০ রুপি। একটি লক্ষণীয় বিষয় হলো
আইজলের রাস্তায় কিংবা কোন পর্যটন কেন্দ্রে কোন ভিক্ষুক চোখে পড়েনি।
আইজলকে শব্দ দূষণ মুক্ত শহর বলা হয়। পাহাড়ী শহরের রাস্তা গুলো অপ্রশস্ত হওয়ার কারণেই হালকা ট্রাফিক জ্যাম চোখে পড়লো। লক্ষণীয় যে কাউকেই হর্ণ বাজাতে দেখলাম না। এ বিষয়ে গাড়ি চালক জানালো যে এটিই তাদের ট্রাডিশন। গাড়ির চালক জানালো যে সাধারণ মানুষের মধ্যে দুর্নীতির চর্চা ততটা না থাকলেও উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে দুর্নীতি বিদ্যমান। এ কারণেই উন্নয়ন অনেক সময় বাধাগ্রস্ত হয়েছিল।
সাধারণ লোকের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলে বুঝতে পারলাম এরা খুবই শান্তি প্রিয়।জাতীয় কোন সমস্যার জন্য দ্রুত একতাবদ্ধ হতে পারে।
মিজোরামে আছে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ ও শিক্ষিত জন গোষ্ঠী। এগুলোকে কাজে লাগিয়ে
কেন্দ্রীয় সরকার দ্রুত গতিতে মিজোরাম এর অর্থনৈতিক অবকাঠামোর উন্নতি সাধন করতে সমর্থ হলে মিজোরাম নিজস্ব প্রাদেশিক উন্নতির সাথে সাথে ভারতের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে ।
Leave a Reply