অধ্যায়-5)
সারাদিন মাছ ধরায় ব্যস্ত, একসময় সন্ধ্যা হল। দুপুরে খাইনি, অবশ্য ক্ষুধাবোধও ছিলনা। মাছধরায় ঝোঁক ছিল, কিন্তু এরকম ছিলনা যে, নাওয়া খাওয়া ভুলে যাব! সারাদিন কেউ কল দিলনা, আমিও দেইনি, বরং এটাই স্বাভাবিক লাগল।
উঠব, এমন সময় ছিপটা টানের চোটে পানিতে তলিয়ে গেল। আমিও পানিতে নেমে পড়লাম। হাতিয়ে ছিপটি খুঁজতে লাগলাম, এক সময় পেয়েও গেলাম। উঁচু করতেই মাছের টান পেলাম।
হুইল ঘুরিয়ে মাছটা কাছে আনলাম। পুকুর হতে পারে উঠলাম। সুতা ছোট করে মাছটিকে উপরে তুলতে যাব, হঠাৎ করেই মাছ জোর খাটাল। আমিও দিলাম পাল্টা টান ! একটা হালকা শব্দ কানে আসল,”পট।”
ছিঁড়ে গেল সুতা! দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ!
রাতে খেয়ে, মাছ ছুটার আফসোস নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন সকালে দিঘীর ঘাটে বসলাম। আয়তাকার পুকুরটি উত্তর দক্ষিণ বরাবর লম্বা, ঘাটটি পশ্চিমবাহুর মাঝামাঝি। ঘাটে বসে পূর্বে তাকালে, পূর্ববাহুর সমান্তরালে সীমানা প্রাচীর। মাঝামাঝি পকেটের মত একটা জায়গা, সেখানে মিনি চিড়িয়াখানা। দেয়াল ঘেঁষে হাঁটার রাস্তাটি উভয় দিক থেকে এসে চিড়িয়াখানাতে থমকে গেছে। সেখানে ছোট একটি করে ছোট গেট আছে, প্রাণীদের খাবার দেওয়ার সময় কর্মচারীরা করে। পুকরের দক্ষিণ দিকেও উঁচু দেয়াল আছে।
চিড়িয়াখানার পুকরের দিক উন্মুক্ত, হরিণগুলো পরিষ্কার দেখা যায়। হরিণগুলো দলবেঁধে পুকুর পারে ঘাস খায় আর আমাকে দেখে। পকেটমত জায়গার একদিকে মুয়ুরের জন্য বেশ বড় একটি নেটের ঘর আছে। উচ্চতা বেশী থাকায় দুই একটা ভিতরেই উড়াল মারে।
হঠাৎ করে ঘাটের উপর চারকোনা একটা কালোবক্স দেখতে পেলাম, সাইজ অনেকটা ম্যাচবক্সের মতো। গুরুত্বহীন এ জিনিস ছুঁয়েও দেখলাম না।
স্ত্রী ও ছেলেমেয়ের কথা মনে পড়ল। দুইদিন হয়ে গেল একটা কল দিলনা, কিভাবে সম্ভব! অভিমানে আমিও কল দেইনি সারাদিন। চিন্তাটা বিস্তার লাভ করার আগে হরিণের ডাক শুনলাম। চিকন কিন্তু অনেক তীক্ষ্ণ শব্দ। এ ডাককে কেন নিক্কন বলে, বোধগম্য হলনা।
চিড়িয়াখানার গেট খুলে দিয়েছে। পার ঘেঁষে যে চিকন রাস্তা, সেখানে লাইন ধরে চিত্রা হরিণ দাঁড়ানো। একটু সামনে আগায় আবার একটু দাঁড়ায়। হরিণ খুব ভীতু প্রাণী। এতটাই ভীতু যে, বাচ্চা হরিণের গায়ে হাত বুলালেও এমনভাবে কাঁপতে থাকে যে, মনে হয় এখনি দমফেটে মারা যাবে। বেচারা বাঘের ভয়ে তটস্থ থাকায় এই অবস্থা হয়েছে।
এদের শৃঙ্খলাবোধ দেখে বেশ মজা পেলাম। নেতার মত একটা হরিণ সবার আগে আছে, সে দাঁড়ালে সবাই দাঁড়ায়। সে হাঁটা শুরু করলে সবাই হাঁটে। সরু পথ ধরে যখন পাশের খোলামাঠে আসল তখন চোখের নিমেষেই দৌড়। কোনটা যে কোথায় গেল বুঝতেই পারলাম না।
বিকেলে মনে হল আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দেখা করে আসি। গেটের কাছে আসতেই দেখি লিও ভয়ংকর চেহারা করে দাঁড়িয়ে আছে। এ ধরনের আক্রমণাত্মক ভঙ্গি আগে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়লনা।
দাড়োয়ানকে গেট খুলতে বলে গাড়িতে উঠলাম। সে গেট খুলতে গেলেই, লিও তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। অন্যান্য কর্মচারীরা দৌড়ে এসে তাঁকে রক্ষা করল। আমিও নেমে লিওকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম, একসময় শান্ত হল কুকুরটা।
দাড়োয়ান উঠে দাঁড়িয়েছে, তাঁর শরীরের বিভিন্ন জায়গা দেখলাম। নাহ, তেমন কিছু হয়নি। শুধু দু’এক জায়গায় আচড় পড়েছে, কামড়ের দাগ নাই। কুকুরটিকে ইঞ্জেকশন দেয়া আছে, তাই দুশ্চিন্তা করলাম না। তবে সেদিনের মত বাইরে যাওয়ার চিন্তা বাদ দিলাম। তবে লিওয়ের মতো পোষা কুকুরের, এ ধরনের অদ্ভুত আচরণ ঠিক মিলল না। কোন একটা সমস্যা হয়েছে, কিন্তু কি সেটা ধরতে পারছি না ?
অধ্যায়-6)
ঘুম ভাঙ্গল অনেক ভোরে। বাইরে বের হয়ে হাঁটাহাঁটি করছি। বড় পুকুরঘাটে আবার চোখে পড়ল সেই বাক্সটা, কৌতুহলে হাতে নিলাম। ম্যাচ বক্সের মত হালকা না, আবার ভাড়িও না। মাঝে একটা বাটন চোখে পড়ল। চাপ দিতেই সামনের ফাঁকা জায়গায় বাতাস কাঁপতে শুরু করল। পরমুহুর্তেই দেখি প্যান্ট আর সোয়েটার পড়া একজন মহিলা দাঁড়ান। বয়স ত্রিশের মতো, চোখমুখের গঠনটা পরিচিত লাগল। মহিলাটি বলে উঠলঃ
বাবা, আমি ফারিসা!
আমি বিস্মিত! আমার মেয়ে এতো বড় হয়েছে! খুশিতে মনটা ভরে উঠল। বলে উঠলামঃ
মা, তুমি কবে কবে এত বড় হলে। আমি কেন আগের মতই আছি।
বাবা, হাতে বেশী সময় নেই। শুধু শুনে যাও।এখন তুমি বৃদ্ধ। তুমি আর মা ওল্ড হোমে ছিলা। একপর্যায়ে তোমাদের ব্রেইনকে সুপার কম্পিউটারের সাথে যোগ করে দেয়া হয়, আর এটা করা হয় তোমাদের ইচ্ছাতেই।
কম্পিউটারের সাথে যুক্ত হলে, কম্পিউটার অতীতের স্মৃতি নিয়ে নতুন একটা ভার্চুয়াল জগত তৈরী করে। এ জগতে যে কেউ একা থাকতে পারে, আবার অন্য কারও সাথে যুক্ত হয়ে ছোট ছোট জগত তৈরি করে থাকতে পারে। আবার চাইলে একটা বৃহৎ জগতের সাথেও যুক্ত হয়ে থাকতে পারে। অনেকটা তোমাদের সময়কার মেটা ভার্সের মতো। যেভাবে একটা ভার্স আরেকটার সাথে কানেক্টেড হতো, সেরকম। অবশ্য মেটাভার্সে প্রতিটা মানুষের একটা কাল্পনিক চরিত্র বা অবতার থাকে, সেই অবতার ইন্টারনেট জগতে বিচরণ করে। কিন্তু এই জগতে সে নিজেই বসবাস করে।
এ ধরনের ব্যবস্থা এখন স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। কম্পিউটারের সাথে কানেক্টেড ব্রেন, এমন একটা ত্রিমাত্রিক জগতে বিচরণ করে, যেখানে মানবীয় অনুভূতি এবং গুনাবলী বাস্তবের মতোই বজায় থাকে। আবার সীমাবদ্ধতাও থাকে একই রকম।
এক কথায় পৃথিবীর নিয়ম-কানুন ও সুত্র সেই ভার্চুয়াল জগতেও বিরাজ করে। শুধু মানুষ নয় অন্যান্য প্রাণীদের আচার আচরণও পৃথিবীর নিয়মেই ঘটে, ইচ্ছামত কেউ কিছু করতে পারেনা।
নিয়মের বাইরে কেউ কিছু করতে চাইলে সে অটো এক্সিট হয়ে যাবে এবং তাঁকে ভবিষ্যতে আর ভার্চুয়াল জগতে যেতে দেওয়া হয়না। যদি কোন বিপর্যয় ঘটার সম্ভবনা থাকে, তাহলে সকলেই অটো এক্সিট হয়ে যাবে।
বাহ্, বেশ মজার তো! আমি বলে উঠলাম।
তবে ফারিসা কথা বলার সুযোগ দিলনা। সে বলতেই থাকলঃ
এ ভার্চুয়াল জগত শুধু বৃদ্ধদের জন্য। তাঁরা চাইলে সেখানে থাকতে পারে, আবার যখন খুশি তখন চলেও আসতে পারে। তরুণেরা শুধু পরিচিত জনের কাছে বেড়াতে যেতে পারে, অতিথির মত দু’এক দিন থাকতেও পারে। তারপর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অটো এক্সিট হয়ে যায়। এ নিয়ম কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়।
এ প্রোগ্রামের সুবিধা হল মোবাইল টুলসের মাধ্যমে বাস্তব জগত থেকে ভার্চুয়াল জগতে ত্রিমাত্রিক কল করা যায়। আবার ভার্চুয়াল জগত থেকেও, বাস্তব জগতে ত্রিমাত্রিক কল করা যায়। যেমন আমি বাস্তব জগত থেকে কল করে কথা বলছি তোমার সাথে।
তোমাদের সময় লোকজন যেমন বিদেশে থাকত, অনেকটা সেরকম তোমারা অন্যদেশে আছো। এটা একটা প্যারালাল জগত, প্যারালাল জীবন।
অধ্যায়-7)
বন্দি শিবির।
—–————
ফারিসা বলেই চলছে,
সবকিছু ঠিকঠাক মতোই চলছিল, কিন্তু কিছুদিন আগে ওল্ড হোমের সার্ভারে সমস্যা দেখা দেয়। তখন কয়েকজনের ব্রেইন হ্যাকড হয়ে যায়, তারমাঝে তুমি একজন।
আমি উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করলামঃ
তোমার মা’র কি অবস্থা? সে কেমন আছে।
ফারিসা উত্তর দিলঃ
মা, ভাল আছে। সে হ্যাকড হয় নাই।
যাক, খুশি হলাম তোমার মা’র কথা শুনে।
বাবা, সমস্যায় আছি তোমাকে নিয়ে! যদি তোমার ব্রেইনকে রিকানেক্ট না করা যায়, তাহলে তোমাকে ডিসকানেক্ট করতে হবে। সেক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অথবা আংশিকভাবে তোমার ব্রেইন ডেমেজ হয়ে যাবে!
এখানকার কর্তৃপক্ষ অনেকদিন ধরেই এক্সপার্ট দিয়ে চেষ্টা চালাচ্ছে, যাতে তোমার ব্রেইনের কোনরকম ক্ষতি ছাড়াই উদ্ধার করা সম্ভব হয়।
আমি উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করলামঃ
সেটা কি আদৌ সম্ভব?
ফারিসা বললঃ
এক্সপার্টরা কি করছে জানিনা তবে, এখবর জানার পর থেকেই রাদিদ লেগে আছে। অনেক সার্চ করে তোমাকে এই সাইটে পেয়েছে। এটা প্যারালাল ওয়ার্ল্ডের মাঝেই সুক্ষ্মভাবে আলাদা ছিল। এ জগত হ্যাকাররা তৈরি করেছে তোমাকে আলাদা করে রাখার জন্য। এখান থেকে তুমি অন্য কারো জগতের সাথে কানেক্ট করাতো দূরের কথা, কল পর্যন্ত করতে পারবে না। বাস্তব জগতের কোন কলও এখানে পৌছাবে না।
এ কারণে তুমি এখানে একা, আপনজন কেউ নাই। তোমার এখানে আসা অনেক কঠিন লিওয়ের কারণে। লিও কাজ করে অনেকটা শিল্ডের মতো, কাউকে তোমার সাথে যোগাযোগ করতে দেয়না, আবার তোমাকেও অন্য জগতে যেতে দেয়না। তুমি এখানে বন্দির মতো, চাইলেও বের হতে পারবে না।
আমি বিশ্ময়ের শেষ সীমায় চলে এসেছি। শুধু বললামঃ
এ কারণেই দারোয়ান গেট খুলতেই লিও হিংস্র হয়ে উঠেছিল।
ফারিসার উত্তরঃ
হ্যা, বাবা!
আমি বললামঃ
মা, আমাকে হ্যাক করে এদের লাভ কি? আর এখানে তো ভালোই আছি বলে মনে হচ্ছে।
ফারিসা বললঃ
বাবা, এদের উদ্দেশ্য কখনও ভাল থাকেনা। তোমার স্মৃতির প্রজেকশন করে এ জায়গা তৈরি করা। তাই তোমার থাকতে ভাল লাগছে। সাময়িকভাবে এখানে রেখেছে হ্যাকাররা। এখন কষ্ট না হলেও ভবিষ্যতে সমস্যা হবে। ভয়ংকর কোন এক্সপেরিমেন্টের মুখোমুখি হতে হবে, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই। ফিটনেস বিহীন মহাকাশযানে তোমার ব্রেইন ব্যবহার করবে অথবা কোন পশুদের প্রোগ্রামে রান করাবে।
বলো কি! এ ধরনের নৃশংসতা সভ্য জগতের মানুষ করে কিভাবে! আর সুযোগই বা পায় কিভাবে ?
ফারিসা উত্তর দিলঃ
এ ধরনের মানুষ সব সময়ই ছিল এবং থাকবে।বিজ্ঞানীরা, প্রোগ্রামাররা দিনের পর দিন এদের সন্ধানে লেগে আছে। ধরাও পড়ছে অনেকে কিন্তু বন্ধ হচ্ছে না!
শুনে আশাহত হলাম। ভবিষ্যত পরিণতির কথা ভেবে দূঃশ্চিন্তা ভর করল।
বাবা! তুমি একদমই চিন্তা করোনা। আমরা একটা উপায় বের করেছি। এখন সবকিছু নির্ভর করছে তোমার উপর।
কি, সেটা!
এতো বিষন্ন দেখালে কিভাবে হবে, বাবা ? এখন শক্ত হও। রাদিদ খুবই ভাল একজন প্রোগ্রামার। সে তোমাকে উদ্ধার করার জন্য হ্যাকিং করছে। দিনরাত লেগে আছে কিভাবে তোমাকে বের করা যায়। অনেক চেষ্টার পর এখানে এই মোবাইল টুলসটি রাখতে পেরেছিল। এরপর থেকে আমরা দুইজন চব্বিশ ঘন্টা ধরে মনিটরে তাঁকিয়ে আছি কখন তুমি এটা ধরবে। এদিকে ভয় লিওকে নিয়ে, কখন দেখে ফেলে। সে এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। যখন সরিয়ে ফেলব সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তখনই তোমার হাতে।
যদি লিও এটাকে খুঁজে পেত, তাহলে তোমার জগতের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এমন শক্তিশালী করত যে, আমরা হ্যাক করে তোমার সাথে যোগাযোগ করতে পারতাম না। সেই সাথে তোমার বের হওয়ার পথ চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যেত।
কি বলো মা! এতো কিছু ঘটে যাচ্ছে আর আমি টেরই পেলাম না।
তোমার টের পাওয়ার কথা না, বাবা! তবে আমরা চিন্তিত ছিলাম যে আমার কথা বিশ্বাস করবে কি না?
সেটা কিভাবে সম্ভব! তুমি আমার মেয়ে, তোমার কথা অবিশ্বাস কিভাবে করতে হয়, এটাই তো জানিনা।
কথা শেষে টুলসটি তুমি পানিতে ফেলে দিবে, বাবা। ভোরের দিকে লিওকে একটু ইনএক্টিভেট করতে পারবে, রাদিদ। তখন তুমি মেইন গেটে যাবে। সেখান কামরাংগা গাছের নীচের ডালে একটা চাবি ঝুলানো থাকবে। চাবিটা রাদিদ একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ওখানে ঝুলিয়ে রাখবে। সেটা দিয়ে তালা খুলে বের হতে পারলেই তোমার মুক্তি।
কোন অবস্থাতেই এ সুযোগ মিস করা যাবেনা, বাবা। কল শেষ হলে তুমি অন্যান্য দিনের মত স্বাভাবিক আচরণ করবে। চলাফেরায় কোন অস্থিরতা যেন প্রকাশ না পায়। সন্দেহ হলে অবজারভাররা খুঁজে বের করবে এর কারণ। আমি যে হ্যাক করে এখানে এসেছি এটাও জেনে যাবে। তখন কোন উপায় থাকবে না।
বাবা! সময় শেষ! আমি গেলাম।
বলেই অদৃশ্য হয়ে গেল ফারিসা।
আমি চুপচাপ বসে পড়লাম। এতক্ষণ মনে হয় হলিউড মুভি দেখলাম! এতো অবিশ্বাস্য! কি করা উচিত আমার?
অধ্যায়-8)
দুপুরের খাবার খেয়ে মাছ ধরতে গেলাম। এতে করে, কোনরকম অস্থিরতা থাকবে না।
পরপর তিনটা বড়শি ফেললাম পুকুরে। একটা ভাসা, দুইটা লেপি। প্রথমটা ফেললাম দুরে, পরেরটা পুকুরের মাঝে। টুং ঝুলিয়ে দিয়ে কৌশলে বেশ কাছে খাড়াভাবে সেট করলাম। ভাসা ছিপটি কাছেই ফেললাম।
অনেকক্ষণ বসে আছি, মাছ তো ধরেই না, ঠোকোরও দেয়না। মাঝে মাঝে আধার পরিবর্তন করছি। সন্ধ্যা পার হয়ে রাত নামে কিন্তু মাছের সাড়া নাই, তবুও আছি। সবুজ পানি, কালচে লাগছে। আকাশের তাঁরারা ক্রমেই ফোকাস হয়ে তাদের পূর্ণ আলো বিকিরণ করতে লাগল। বায়ু শূণ্য তাই পানিও স্থির। ভিলা থেকে আলো আসলেও অন্ধকারের চাদর সরানোর জন্য বেশ দুর্বল।
যথেষ্ঠ চওড়া ধাপ ধীরে ধীরে পানিতে ডুবে গেছে। ঘাটের সর্বশেষ ধাপে আছি, মাটি থেকে তিনফুট নীচে প্রায়। রাত বাড়ে, অন্ধকারে ফ্লুরোসেন্ট টুং আরও জ্বলজ্বল করে। তাঁকিয়ে বিভ্রম দেখা শুরু করলাম। টুং এর বেশ কয়েকটি প্রতিচ্ছবি চোখে ভাসতে লাগল। দূরে ফেলানো লেপির টুংটা মনে হয় কেঁপে উঠল। সজাগ হয়ে উঠলাম, বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর যখন ধৈর্য্য হারিয়ে অন্যদিকে নজর বুলাচ্ছি তখন আরেকবার কেঁপে উঠল। হালকা নড়াচড়া করছে, আমি স্থির চোখে তাঁকিয়ে রইলাম।
টুংয়ের নড়াচড়া বাড়তে লাগল, একসময় বন্ধ! আবার পানির নীচে অল্প ডুবে আর উঠে। আবার স্থির হয়ে আছে। তারপর নাই! শুধুই পানি!
ডানেও নাই বামেও নাই, নীচে চলে গেছে! ছিপ ধরে হ্যাচকা টান দিলাম। লেপি দূরে, লম্বা সুতায় টান দেয়ার সাথে সাথে কোন রিফ্লেকশন পেলাম না, তবে হালকা একটা টান অনুভূত হল। মাছ ধরার মতো জোরাল না।
কয়েক সেকেন্ড পরেই শূণ্যে লাফিয়ে উঠল বিশাল একটা মাছ। ঝপাং! তারপরেই সুতায় প্রবল টান। হুইল লকড, এখন নব ঘুরিয়ে সুতায় ঢিল দিলাম। ঢিল পেয়ে মাছটি এমন দৌড়ে অনেক দূর চলে গেল। একপর্যায়ে ছিপে টান পড়ল, ছিপ বেকে ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হল। ছিপটিকে বন্দুকের মত বুকে ঠেকিয়ে, সামনের দিকে এগিয়ে যতটুকু সম্ভব রিলাক্স দিলাম।
সাত আট কেজিতো হবেই, তাড়াহুড়া করলাম না। ইচ্ছামত ঘুরার সুযোগ দিলাম। একবার এদিক আরেকবার ওদিক যাচ্ছে মাছটি। সুতা টানে রাখছি। আমার দিকে আসলেই হুইল ঘুরিয়ে সুতা কমিয়ে আনছি। মাছটি বোধহয় টের পেল, বেশ জোড় খাটাতে লাগল। হুইল ঘুরিয়ে কাছে আনার চেষ্টা বাদ দিয়ে ছিপ ধরে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
একটু দুর্বল হলে সন্তর্পণে হুইল ঘুরিয়ে কাছে আনলাম। একজন পানির নীচে নেট ধরল, কাছাকাছি এসে মাছ ডানেবামে ঘুরে কিন্তু নেটের গোল রিং দিয়ে ঢুকে না। দীর্ঘক্ষণ কসরত করে নেটের কাছে আনলাম, আরেকটু এগুলেই নেটে ঢুকবে। হঠাৎ করেই মাছ উল্টোদিকে দৌড়! একটানে সুতা টেনে চলে গেল পুকুরের অন্যপ্রান্তে।
পরিশ্রম এক মুহুর্তেই পন্ড। তবে মাছ ছুটেনি, ছুটতেও পারবেনা। কারণ লেপিতে চার বা চারের অধিক বড়শি থাকে। আধার দেয়া হয় অনেক বড় করে অনেকটা টেবিলটেনিস বলের মত। ছোটমাছ এ আধার গিলতে পারবেনা। বড়টা যদি গিলে, তবে একাধিক বড়শি মাছের মুখে গেঁথে যায়।
আবার হুইল ঘুরিয়ে মাছটিকে টানতে লাগলাম। দীর্ঘসময় ঘুরাঘুরি করে মাছটি অনেক ক্লান্ত হয়ে পড়ল তখন অনায়াসে নেটে ঢুকে পড়ল। উপরে তোলার পর দেখা গেল বিশাল আকারের ব্ল্যাককার্প, দশবারো কেজিতো হবেই।
কেয়ারটেকারকে ডাকলাম। এতবড় মাছ দেখে বেশ অবাক! তাঁকে বললামঃ
মাছটি কেঁটে রান্না কর, সবাই মিলে খাব।
খুশিমনে চলে গেল টিনশেডে। মাছ সেখানেই কাটাকুটি করা হয়। তখনও ঘাটে আছি, দূরে থেকে লিওয়ের ঘেউ ঘেউ শব্দ ভেসে আসল। অজান্তেই গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল।
মাছধরায় আর মনোযোগ দিতে পারলাম না, লিওয়ের ঘেউ ঘেউয়ের কারণে। রাত হওয়ায়, শব্দ কয়েকগুন বেশী শোনাতে লাগল। আতঙ্ক ভর করার আগেই সবকিছু গুটিয়ে ভিলাতে চলে আসলাম।
অধ্যায়-9)
মাছটা বেশ মজার ছিল। খেয়ে শুয়ে পড়লাম। আকাশ পাতাল চিন্তা উকি দিচ্ছে মাথায়, তাই বই পড়তে লাগলাম।
ধরফর করে উঠলাম! কখন ঘুমিয়েছিলাম জানিনা, এখনো ভোর হয় নাই, ঊষার প্রহর চলছে। দ্রুত নীচে নেমে গেটের দিকে হাঁটা দিলাম। কামরাংগা গাছটি ছিল গেটের পাশেই, নীচের ডালে চাবি ঝুলছে। হাত বাড়িয়ে ধরতে পারলাম না। গাছের গোড়ায় চারিদিকে গোলাকার প্যাটার্নে ইট সাজানো ছিল। দেরী না করে একটার উপর একটা ইট রেখে দাঁড়িয়ে চাবি নিলাম।
কাছেই গেট, কোথাও কেউ নেই নিশ্চুপ চারিদিক। তালায় চাবি ঢুকাতেই ভোরের শান্ত পরিবেশ খান খান করে ভেঙ্গে গেল ঘেউ ঘেউ শব্দে। কুকুরটি ভয়ংকর চেহারা নিয়ে দৌড়ে আসতে লাগল আমার দিকে। সারা শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল। ভয়ে, হাত থেকে চাবি পড়ে গেল! উঠানোর জন্য নীচু হতেই লিও আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমি পড়ে গেলাম মাটিতে, কামরাংগা গাছের গোড়ায়।
এটাই কি জীবনের শেষ সময়? নাহ্, এভাবে আত্মসমর্পণ করা যাবেনা। গাছের গোড়াতেই ইট ছিল। একটা হাতে নিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে লিওয়ের মাথায় আঘাত করলাম! প্রচন্ড আর্তনাদ শুনলাম। একসময় নিথর হয়ে এল লিও। মাথা ফেটে রক্ত বেরিয়ে শরীর ভিজিয়ে দিল!
চারিদিক হালকা আলোয় আলোকিত। এ আলোতে চাবি খুঁজে পেলাম সহজেই। শব্দ পেয়ে কর্মচারীরা জেগে উঠেছে। তাঁরা এদিকে এগিয়ে আসছে। যে দূরত্বে আছে তাতে করে চাইলেও দৌড়ে এসে ধরতে পারবে না। এখন তালা খুলে বাইরে বেরোলেই মুক্তি!
তালা খুলে দূরে ফেলে দিলাম। হাতল ধরে একটান দিয়ে গেট খুলে ফেললাম। মন খুশিতে ভরে উঠল।
বাইরে পা বাড়তেই দেখি অনেকগুলো রেট্রিভার কুকুর দাঁড়ানো! প্রত্যকের গলায় ঝুলছে সেই মোবাইল টুলস, যেটা আমি পানিতে ফেলে দিয়েছিলাম। কিছু বোঝার আগেই আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সব কয়টা। শেষ মুহূর্তে দেখলাম, আমি মাটিতে শুয়ে আছি আর কুকুরগুলো আমার গায়ের উপর।
চলবে,,,,,
Leave a Reply